দীপক দাস
কাঠামোয় খড় বাঁধা শুরু হলেই আমাদের পুজো পুজো ভাব জাগত। খড় বাঁধার আগেও অবশ্য একটা ধাপ ছিল। দুর্গাদালান পরিষ্কার করা। বেশ বড়সড় দালান। বহু পায়রার আশ্রয় দালানে। সারা বছর ধরে কবুতরের কৃতকর্মের একটা পুরু স্তর পড়ে যেত দালানের মেঝেয়। একদিন দেখা যেত, দালান পরিষ্কার করতে লোক লেগেছে। পাড়ার ছোটরা বুঝত, এবার ঠাকুর তৈরি করতে আসবে।
এ টি দেবদের বাড়ির পুজোর কথা হচ্ছে। বিখ্যাত অভিধান, দেব সাহিত্য কুটীর, ‘শুকতারা’, নবকল্লোল’এর এ টি দেব। হাওড়ার পাতিহাল গ্রামে আমাদের পাড়াতেই পৈতৃক বাড়ি তাঁদের। গ্রামের অন্যতম জমিদার। আমাদের ঠিকানাতেও স্থানচিহ্ন হিসেবে উল্লেখ থাকে মজুমদার পাড়ার। পুজোর মরসুমে এ টি দেবের বাড়ির পুজোর গল্প শোনা যেতে পারে। শোনা যেতে পারে রায়ের বাড়ির পুজোর গল্পও। পাতিহালের রায়েদের বাড়ির পুজো সবচেয়ে প্রাচীন। তাঁরাও গ্রামের জমিদার। পুজোর গল্পের শুরুটা হোক পাড়া থেকেই। এ টি দেবদের বাড়ির পুজোর সঙ্গে পারিবারিক একটা যোগও রয়েছে।
আশুতোষ দেব তথা এ টি দেবরা এ গ্রামের আদি বাসিন্দা নন। তাঁরা এসেছিলেন হুগলি থেকে। পাণ্ডুয়ার ইলছোবা-মণ্ডলাই গ্রামে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। এক অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে পাতিহাল গ্রামে আসতে হয়েছিল মজুমদারদের। এসেছিলেন শোভারাম দে। তাঁর বাবা ছিলেন এলাকার নামকরা পণ্ডিত। মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর পরামর্শ নিতেন বলে শোনা যায়। শোভারাম বাবার কারণেই পাণ্ডুয়ার সেরেস্তায় চাকরি পেয়েছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়স তখন তাঁর। কাজে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তাই ফৌজদার তাঁকে মজুমদার উপাধি দেন। দে থেকে মজুমদার হন তাঁরা। তখন আলিবর্দি খাঁয়ের আমল। গ্রামের বাড়িতে সম্পত্তি কেনেন শোভারাম।
গুছিয়ে বসেছিলেন শোভারাম। দুই সন্তানের জনক হলেন। ছেলে উমাপ্রসাদ আর কন্যা স্বর্ণপ্রভা। ন’বছরে মেয়ের বিয়ে দিলেন। দু’বছরের মধ্যে স্বর্ণপ্রভার স্বামী মারা যান। স্বর্ণপ্রভার জীবনের চরম বিপর্যয় ঘটে ফৌজদারের শ্যালকের লালসায়। এমন অবমাননাকর ঘটনার অভিঘাতে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন শোভারাম। অপুত্রক ফৌজদার তাঁর প্রিয় শ্যালককে কিছু বলবেন না। মিলবে না ন্যায়বিচার। ইলছোবা-মণ্ডলাইয়ের ব্রাহ্মণ সমাজের বিধানকেও ভয় পেতেন। সামাজিক ও আত্মীয়স্বজনের কুকথার ভয়ও ছিল। রাতারাতি ইলছোবা ছাড়লেন শোভারাম। এলেন পাতিহালে। ধীরে ধীরে পাতিহালেও প্রচুর সম্পত্তি করেন শোভারাম। হয়ে গেলেন জমিদার। তাঁর পুত্র উমাপ্রসাদের ছেলে বরদাপ্রসাদ। বরদাপ্রসাদের ছেলে আশুতোষ দেব তথা এ টি দেব। বরদাপ্রসাদ দে পদবি ব্যবহার না করে ‘দেব মজুমদার’ ব্যবহার করতেন। আশুতোষের পরিচয় দেব হিসেবেই।
কী ভাবে শুরু হয়েছিল এ টি দেবদের বাড়ির পুজো, তা জানা যায় না। কে শুরু করেছিলেন সে বিষয়েও কোনও লিখিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন পরোক্ষ সূত্রে একটা অনুমান করা যায়। আর পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ের পুজো সংক্রান্ত কিছু স্মৃতিচারণ। পরোক্ষ অনুমান হল এ টি দেবদের বসতবাড়ির সামনে একটি মন্দির। মন্দিরটি মজুমদার বংশেরই। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলক অনুযায়ী, এটি ১৭০৩ শকাব্দে তৈরি। বঙ্গাব্দ ১১৮৮। অর্থাৎ অর্থাৎ ২৪০ বছরের পুরনো। শোভারাম পাতিহালে এসেই দেবালয় তৈরি করেছিলেন, এটা হতে পারে না। তবে তিনি ছেলে উমাপ্রসাদকে সভ্রান্ত রায়ত হিসেবেই দেখে গিয়েছিলেন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সালের থেকে মজুমদারদের পাতিহালে জমিদারি আরও পুরনো হওয়ার কথা। উমাপ্রসাদের আমলেও পুজো শুরু হতে পারে। সেই হিসেবে পুজোর বয়স ২৫০-৩০০ বছর হওয়া অসম্ভব নয়।
এ টি দেবদের একচালার প্রতিমা। প্রতিমার একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এঁদের গণেশের চারটি নয়, দু’টি হাত। এমন রীতির পিছনে একটি গল্প আছে। আগে মজুমদারদের প্রতিমা আসত কুমোরটুলি থেকে। নৌকা যোগে। পাতিহালের সঙ্গে নৌ যোগাযোগ ছিল। এই গ্রামে এখনও নোলোর খটি নামে একটি জায়গা রয়েছে। এটি ছিল নৌ যোগাযোগের বাণিজ্য কেন্দ্র। এই নোলোর খটিতেই রয়েছে বদর পিরের থান। এই পির মাঝি-মাল্লাদের উপাস্য। এই পথেই প্রতিমা আসত। সেখান থেকে মজুমদারদের প্রজারা দুর্গাদালানে প্রতিমা বয়ে আনতেন। একবার প্রতিমা আনার সময়ে গণেশের একটি হাত ভেঙে যায়। তিন হাতের গণেশ পুজো অশুভ। তাই গণেশের হাত হয়ে যায় দু’টো। এখনও সেই রীতি চলছে। গণেশের দু’টো হাত বিষয়ে কাহিনিটি শুনিয়েছিলেন মজুমদার বংশের বিস্তৃত শাখার এক কন্যা, সাধনা বাগ। সম্ভবত গণেশের হাত ভাঙার পরে কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্গাদালানেই তৈরি হতে শুরু করে প্রতিমা।
জমিদারি আমলে পুজোর বেশ জাঁক ছিল। পাত পেড়ে গ্রামের লোককে খাওয়ানোর প্রথা ছিল। বছর তিরিশ আগে পাড়ার লোকে পুজোর অষ্টমী-নবমীতে বাবুর বাড়িতে দুপুর বাড়ি খেতেন। এ টি দেবদের বাড়িটি বাবুর বাড়ি নামে পরিচিত। পুজোর সময়ে বাবুর বাড়িতে কাজ করতে আসতেন তাঁদের চাকরান ভোগ প্রজারা। এই রীতি আমরাও দেখেছি। আমার ঠাকুরদাও এই পুজো বাড়িতে কাজ করেছেন। আমরা শরণার্থী পরিবার। এই জমিদাররাই থাকার জায়গা দিয়েছিলেন ঠাকুরদাকে। তাই প্রজা হিসেবে কাজ করতে হত ঠাকুরদাকে। এখন সেই জাঁক আর নেই। এক পুরোহিত পরিবারকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে পুজোর। তাঁরাই বংশানুক্রমিক ভাবে পুজোর দেখভাল করেন। এখন পুজোর দায়িত্বপ্রাপ্ত চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, করোনার কারণে এই দু’বছর প্রতিমা দালানে তৈরি করানো হচ্ছে না। প্রতিমা আনা হয় বাগনানের বাইনান থেকে। এ বছরও সেখান থেকে এসেছে।
এক সময় মজুমদার বাড়ির পুজোর সময়ে চাঁদের হাট বসত। কলকাতার ঝামাপুকুর লেন থেকে কর্তাব্যক্তিরা আসতেন। এ টি দেব আসতেন। সুবোধ মজুমদার এসেছেন। এসেছেন সাহিত্যিক মধুসূদন মজুমদার। যিনি ‘দৃষ্টিহীন’ নামে পরিচিত। পারিবারিক পুজোয় আসার রীতি এখন আর নেই।
পাতিহালের রায় বংশ মজুমদার বংশের থেকেও প্রাচীন। সেই প্রাচীনত্বের প্রমাণ মজুমদার বংশের ইতিহাসই। শোভারাম দে পাণ্ডুয়া থেকে পাতিহালে এলেন কোন সূত্রে? সেই সূত্রটাই হল রায় বংশ। সম্ভবত রায়েদের সঙ্গে শোভারামের পরিচয় ছিল। রায়েরাই তাঁকে পাতিহালে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। স্বাভাবিক ভাবেই রায়েদের পুজোর বয়সও বেশি। তবে রায়েরাও পাতিহালের আদি বাসিন্দা নন। এই বংশের পাতিহালে আগত আদি পুরুষ গোপীমোহন দত্ত। তিনি পাতিহাল গ্রামের পত্তনি পান। পাতিহাল একসময়ে বর্ধমান রাজ এস্টেটের অধীন ছিল। পরগনা বালিয়া। গোপীমোহনের পৌত্র বলরাম দত্ত ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি পান। তার পর থেকে এই বংশ রায় পদবি ব্যবহার করে।
রায়েরা পাতিহাল গ্রামের রূপকার। এঁরাই গ্রামে নবশায়ক সম্প্রদায়কে এনে বসিয়েছিলেন। জলা জায়গা পাতিহাল ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়। জমিদারও দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। এক সময়ে বেশ জাঁক ছিল পুজোর। হাঁটাল, হুগলির লক্ষ্মণপুরে রায়েদের জমিদারি ছিল। লক্ষ্মণপুর থেকে পুজোর সময়ে আসত ধান। হাঁটাল থেকে মাছ। প্রজারা দিয়ে যেতেন নারকেল। জমে পাহাড় হত জমিদার বাড়িতে। ধান থেকে খই ভাজানো হত। নারকেল থেকে হত নাড়ু। সপ্তমীর দিন গ্রামের লোকের মধ্যে বিলি করা হত খই-নাড়ু। চারদিন ধরে অতিথি, অভ্যাগত, প্রজাদের আগমনে গমগম করতে পুজো প্রাঙ্গণ।
কবে শুরু হয়েছিল রায়ের বাড়ির পুজো? সঠিক সাল জানা যায় না। পরিবারের সদস্য তরুণ রায় বা সুজয় রায়েরা জানান, তাঁদের পুজোর সূচনা আনুমানিক ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ। এই হিসেবে পুজোর বয়স ৪৭৭ বছর। অসম্ভব কিছু নয়। একটি জনপদ তৈরির সময় থেকে যে বংশ জড়িত তাঁদের পুজোর বয়স চারশো অতিক্রান্ত হতে পারে। পুজো হয় কালিকা পুরাণ মতে। দুর্গা সিংহবাহিনী এবং চতুর্ভুজা। পাতিহাল গ্রামের কাছে নিজবালিয়া গ্রাম। প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক এলাকা। এই গ্রামের সিংহবাহিনী প্রাচীন দেবী। কথিত আছে, নিজবালিয়া গ্রামের সিংহবাহিনী প্রভাবিত রায়েদের পুজো। সে জন্য একসময়ে নিজবালিয়ার সিংহবাহিনীর পুজো আরম্ভের পরে রায়ের বাড়ির নবমীর পুজো হত। সিংহবাহিনীর পুজো শুরুর পরে তোপধ্বনি হত। সেই আওয়াজ শুনে রায়বাড়ির ব্রাহ্মণ পুজোয় বসতেন। তোপধ্বনির চল এখন নেই। তবে নবমীতে সিংহবাহিনীকে পুজো পাঠানো হয় এখনও। এই জমিদার পরিবার এখনও পাতিহালের বাসিন্দা। দুর্গাপুজো, দোল উৎসব এখনও হয়। তবে জমিদারি আমলের সমারোহ স্বাভাবিক ভাবেই কমেছে।
পাতিহাল গ্রামে আরও কয়েকটি বনেদি বাড়ির পুজো রয়েছে। যেমন পূর্বপাড়ায় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পুজো। এই পরিবার মজুমদার, মিত্র-সহ বহু পরিবারের কুল পুরোহিত ছিলেন। এঁদের পুজোর বয়সও অন্তত পক্ষে ২৫০ বছর। দাবি করলেন বংশের বর্তমান প্রজন্ম চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনিই এ টি দেবদের পুজোর দায়িত্বপ্রাপ্ত চন্দন। তাঁর কথায়, বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের দুর্গার নামে দেওয়া সম্পত্তির আয় থেকে পুজোর সিংহভাগ খরচ আসে।
গ্রামে মণ্ডলার কাছে আছে ঘোষাল বাড়ি। এঁদের পুজোও বেশ প্রাচীন। আরেক অভিজাত বংশ ঢ্যাং পাড়ার ঘোষেরা। তাঁরা এখন শহরবাসী। তবে পুজো এখনও হয়। বংশের বর্তমান প্রজন্ম পুজোর সময়ে গ্রামে আসেন। ঘোষবাড়িতে রাজরাজেশ্বরের একটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরের ফলকে লেখা, এটি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তৈরি। এই ফলক থেকে পুজোর বয়সের একটি আনুমানিক আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: ১। ‘বই ব্যবসা ও পাঁচ পুরুষের বাঙালি পরিবার’— রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ২। ‘ইতিহাসে মোড়া পাতিহাল’— যুগের খবর’।
কভারের ছবি— রায়বাড়ির পুজো।
(সমাপ্ত)