দীপশেখর দাস

প্রত্যন্ত একটা গ্রামে এক জায়গায় ১২টা শিবমন্দির! বারোটি শিবমন্দির পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাতেই রয়েছে। আমরা দক্ষিণেশ্বরের কথা জানি। উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে বারো মন্দির বটতলা নামে একটা জায়গা আছে। জায়গার নাম বারোটি শিবমন্দিরের জন্য। মাজুক্ষেত্রের বারোটি শিবমন্দির একটু আশ্চর্য করে বইকী। করে জায়গাটির বৈশিষ্ট্যের কারণে আর প্রতিষ্ঠাতার কারণে।
মাজুক্ষেত্র হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লকের গ্রাম। আমাদের ব্লকেই। ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে পড়ে। কিন্তু নিজের এলাকায় এমন বিস্ময় কোনওদিন দেখা হয়নি। এক মঙ্গলবার বাইক নিয়ে বেরোতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নানা কাজে খুব বেশি দূর যাওয়ার সময় ছিল না। সেদিন আবার অন্যরা ব্যস্ত। যাব শুধু আমি আর দীপকদা। অনেক আলোচনার পরে দীপকদা মাজুক্ষেত্রের নাম বলে। তার পর আমরা বেরিয়ে পড়ি।
আমাদের ব্লকে হলেও এদিকটায় তেমন আসা হয়নি আমাদের। আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করে জায়গাটার মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমতা-রানিহাটি সড়কে উঠে গুলিয়ে গেল জায়গাটা। কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ। তার পর খালের পাশে বাঁধের রাস্তা ধরে একেবারে দ্বাদশ শিবালয়ের সামনের মাঠে পৌঁছলাম। রাস্তার পাশেই একটা খোলা জায়গা। তার দু’পাশে ছ’টা করে বারোটা শিবমন্দির। মাজুক্ষেত্র পৌঁছনো গিয়েছে। এবার খোঁজখবরের পালা। মন্দির চত্বরে বসেছিলেন দুই ভদ্রমহিলা। তাঁদের একজনকে জিজ্ঞাসা করল দীপকদা। কাদের মন্দির জানতে। কম বয়সি ভদ্রমহিলা জানালেন, মন্দিরগুলো তাঁদের বংশেরই। মন্দির বিষয়ে বলতে পারবেন এমন একজনকে ডেকে দিচ্ছেন তিনি।

আমরা চারপাশটা ততক্ষণে দেখতে শুরু করলাম। এক জায়গায় দেখলাম পাকাপোক্ত একটা ফলক। সেই ফলকে মন্দিরগুলোর প্রতিষ্ঠাতার নাম উল্লেখ করা। ফলকে মন্দিরগুলোর বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৪০০ বছর। আর লেখা আছে, মন্দিরগুলো দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার সংস্কারের সময়েই এই ফলক স্থাপন করা হয়।
আমাদের মন্দির দর্শনের মধ্যেই এক প্রবীণ এলেন। তাঁর নাম বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী। পশ্চিম দিকের মন্দিরগুলোর সিঁড়িতে বসে আমাদের মন্দির প্রতিষ্ঠার গল্প শোনা শুরু হল। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিজয়বাবুদের ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ কালীশঙ্কর চক্রবর্তী। কেন তিনি এই গ্রামে এতগুলো মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? বিজয়বাবু দ্বাদশ শিবালয় প্রতিষ্ঠার যে কাহিনি শোনালেন তা কিংবদন্তী আশ্রিত। কালীশঙ্কর চক্রবর্তী ছিলেন পুরোহিত। এলাকায় তাঁর প্রভাব ছিল। একদিন রাতে অনিল মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি পাশের শেরপুর গ্রামের বাসিন্দা। অনিল মণ্ডলের দাবি ছিল, শেরপুরের মাঠে এক যক্ষ নাকি বহু ‘টাকা’ চরাচ্ছেন। বিজয়বাবু টাকা বললেন বটে, সম্ভবত তিনি মুদ্রার কথাই বলতে চেয়েছেন। আর টাকা চরানোর অর্থ গরু চরানোর মতোই।

সেই সময়ে মাজুক্ষেত্র এবং আশপাশের এলাকায় পথঘাট তেমন ছিল না। এলাকাটি জলা জায়গা ছিল। যাতায়াতের মূল মাধ্যম ছিল ডোঙা, শালতি, নৌকা। কালীশঙ্কর এমনই এক জলযানে করে শেরপুরের মাঠে হাজির হন। তিনি সঙ্গে করে দু’টি মালসা নিয়ে গিয়েছিলেন। একটি মালসায় ছিল ভাত। আরেকটি মালসা তিনি প্রস্রাব করে ভরে দিয়েছিলেন। শেরপুরের মাঠে গিয়ে তিনি যক্ষের টাকার উপরে প্রস্রাব ছড়িয়ে দেন। তাতে টাকার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। যক্ষ তাঁর এই কাজে রেগে গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও কালীশঙ্করকে সাত ঘড়া ধনের সন্ধান দেন। আর বলেন, এই সম্পদ কালীশঙ্কর ব্যবহার করতে পারেন। তিনি সাত পুরুষ পরে সব ফিরত নিয়ে নেবেন। শেরপুরের মাঠে যেখানে সাতঘড়া ধন পোঁতা ছিল সেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় সাতঘড়াপোঁতা।

যক্ষের দেওয়া অর্থে কালীশঙ্কর নিজের সম্পদ বাড়াননি। তিনি বারোটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তখনও মন্দিরে কোনও শিবলিঙ্গ ছিল না। শিব আনতে কালীশঙ্কর কাশী যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিলেন। মন্দিরে শিবের প্রতিষ্ঠা নিয়েও একটি কিংবদন্তী রয়েছে। বিজয়বাবু জানালেন, কাশী যাত্রার উদ্যোগ সারা। যেদিন কাশী যাত্রা করবেন তার আগের দিন রাতে এক ব্যক্তি নাকি বারোটি শিব ছ’টি ষাঁড়ের পিঠে চাপিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মন্দির চত্বরে এক বেলগাছের নীচে শিব রেখে খবর দেন কালীশঙ্করবাবুকে। তাঁর সঙ্গে দরদাম চলে। আগন্তুক যত দাম বলেছিলেন কালীশঙ্করবাবু তার অর্ধেক দিতে রাজি হন। একসময়ে সেই দামেই রাজি হয়ে যান আগন্তুক। দাম মেটানোর পরে তিনি ষাঁড়-সহ নাকি অদৃশ্য হয়ে যান। বারোটি শিব প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। বর্ধমানের মহারাজা ৭২ বিঘে সম্পত্তি শিবের নামে দেবোত্তর করে দেন। সেই ৭২ বিঘে জমির অনেকটাই অবশ্য এখন দখল হয়ে গিয়েছে। কালীশঙ্করবাবুর উত্তরাধিকারদের হাতে রয়েছে মাত্র ১২ বিঘে জমি। বিজয়বাবুর বাবা-কাকারা চার ভাই। গোবিন্দ, সুবল, সুধন্য ও বিনন্দ। এই চারজনের ছেলেরা এখন পালা করে শিবের সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করেন। পরে মন্দির চত্বরে বিজয়বাবুর দাদা কমলাকান্ত চক্রবর্তী দুর্গা, মনসা, শীতলা মন্দির তৈরি করেন।

মাজুক্ষেত্রের ১২টি শিব মন্দির আটচালা রীতিতে তৈরি। চারশো বছরের পুরনো মন্দির। বিজয়বাবু জানালেন, মন্দির সংস্কারের জন্য তাঁরা কখনও সরকার থেকে কোনও অনুদান পাননি। দ্বিতীয়বার মন্দির সংস্কারের জন্য বিজয়বাবুদের দু’বিঘে জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।
আমরা বিজয়বাবুর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সাতঘড়াপোঁতার অবস্থানটা জেনে নিলাম। সেখানে গিয়ে বোঝা গেল, সত্যিই এলাকাটি একসময়ে জলাভূমি ছিল। পর পর কিছু জলাশয় তার প্রমাণ। জায়গাটার কাছেই আমতা-উলুবেড়িয়া সড়ক। আমরা সেই রাস্তা ধরেই এসেছি। সড়কের দু’দিকে তাকালেও জলাভূমির অস্তিত্ব বোঝা যায়। রাস্তার পাশের জলা জায়গাগুলোয় পানিফলের চাষ হয়।

ফেরার সময়ে দীপকদার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল বারোটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এত বছর পরে কিংবদন্তীর আড়াল থেকে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করা মুশকিল। তবে অনুমান করা যেতে পারে, কালীশঙ্করবাবু কোনও গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিলেন। অথবা হঠাৎ অন্য কোনও ভাবে তাঁর অর্থ প্রাপ্তি হয়েছিল। না হলে এক পুরোহিতের পক্ষে বারোটি শিব মন্দির তৈরি করে তার নিত্য সেবা সম্ভব! বিজয়বাবু বলছিলেন সেই সময়ে এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থাও ভাল করে গড়ে ওঠেনি। জলে ভরা এলাকা। এমন প্রত্যন্ত এলাকায় এতগুলো মন্দির প্রতিষ্ঠা বেশ শক্ত কাজ। এ কথা মানতেই হবে, অর্থ লাভ করে কালীশঙ্করবাবু ব্যক্তিগত কাজে খরচ করেননি। গ্রামে এক ঐতিহাসিক ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন।
কভারের ছবি— পশ্চিমদিকের ছ’টি মন্দির
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)