শনপাপড়ি
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

সবুরে মেলে শনপাপড়িও

দীপক দাস

যেন রামের বনবাসের পরে অযোধ্যা নগরীতে হাজির হয়েছি আমরা। রাজা ভরত। কিন্তু তিনি রামের নামে রাজত্ব চালাচ্ছেন। নিজে কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সব রামের নামে। অথচ রাজ্যের লোক ভরতের জয়ধ্বনি করেই গগন ফাটাচ্ছে।

শনপাপড়ি খেতে বেরিয়েছি। চালতাখালি এলাকায়। খাওয়ার সঙ্গে খোঁজও চলবে। আগে একবার এসেছিলাম এই দিকটায়। ‘কাস্তে কবি’ দিনেশ দাসের পূর্বপুরুষের ভিটের সন্ধানে। ইন্দ্রর বন্ধু বাপ্পাদিত্য বালি খবর দিয়েছিল, শনপাপড়ি গ্রাম পেরিয়েই আমরা গিয়েছি কবির বাড়ি। যে বাঁধ দিয়ে আমাদের যাত্রা তার দু’পাশে ঘর ঘর শনপাপড়ি তৈরি হয়। একে মিষ্টি তা-ও আবার কুটির শিল্পের মতো? অভিযান করা অবশ্য কর্তব্য। না হলে ওয়েবসাইটের খাদ্য সফর বিভাগ অপমানিত বোধ করবে।

দূরের কড়াইয়ে হচ্ছে চিনির পাক। কাছে বেসন আর ঘিয়ের মিশ্রণ তৈরি।

এদিকে সময় আর দল বাঁধা হয় না কিছুতেই। দীর্ঘ টালবাহানার পর দল পাকানো গেল। কয়েক মাস ধরে বেশ অস্বস্তিতেই ছিলাম। বাঙালি হয়ে দল পাকাতে পারছি না! প্রবল এই সাজাত্যভিমানের যুগে পীড়াদায়ক ঘটনা। দল অবশ্য পীড়াপীড়ি করেই পাকাতে হয়েছিল। মানসিক পীড়া। আমার মঙ্গলবার ছাড়া সময় নেই। ইন্দ্রবাবুর মঙ্গলবার কলকাতা যাত্রার দিন। দীপুবাবু ঘাসপাতার বিশ্লেষণে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হপ্তাভর বাইকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। ছোটা ডন, বাবলা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত এবং সম্প্রতি অসুস্থ। ‘মঙ্গলে উষা আর বুধে পা’ কিছুতেই হয় না। শেষে ‘ইমোশনাল অত্যাচার’ করতে হল। ‘যাব না আমরা শনপাপড়ি, শনপাপড়ি খাব না?’ মানসিক পীড়াপীড়িতে কাজ হল। অতিরিক্ত সঙ্গীও জুটল। ইন্দ্রর বন্ধু অতনু। এই প্রথম সে সফর সঙ্গী।

জিজ্ঞাসাবাদ করে বাপ্পাদিত্যের নির্দেশিত শনপাপড়ি গ্রামে পৌঁছলাম। চালতাখালি আমতা ১ ব্লকে পড়ে। বাঁধের উপর বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি জানালেন, আরেকটু এগিয়ে গেলেই অমুকের কারখানা। গেলাম। বাঁধের নীচেই কারখানা। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই দেখি, শনপাপড়ির এলাহি যজ্ঞ চলছে। মাখছে, ভাজছে, কাটছে। সুগন্ধে মন আনচান। খোঁজ করতে অমুক এলেন। জানালাম, শনপাপড়ির খোঁজে এসেছি। অমুকের প্রথম প্রশ্নই হল, ‘‘কতটা নেবেন?’’ বললাম, ‘‘নেব কম। লিখব।’’ তখনই বোঝা গেল, এই অমুক আসলে শনপাপড়ি ব্যবসার জগতের ভরত। দাদা রামের ভরসা। অথচ বাঁধের লোকটি এঁরই নাম বলেছিলেন। অমুক বললেন, ‘‘লেখার বিষয়ে দাদাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।’’ দাদা কোথায়? কলকাতায়। মুশকিল। বলতে আপত্তি কোথায়? অমুক বললেন, ‘‘এখানকার দু’জন এসেছিল বই লিখবে বলে। আমি বলিনি।’’ না বলায় গর্ব কোথায় বুঝতে পারলাম না। আর লেখালেখি কি খারাপ জিনিস?

চিনির পাকে তৈরি মণ্ড।

এমন ভাবে হাঁকিয়ে দেওয়ায় মন খারাপ লাগছিল। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। সে আলোচনা মোটেও সুশীল ছিল না। তবে হাল ছাড়া যাবে না। টিনটিনের কমিকসের ক্যালকুলাসের মতো আরও পশ্চিমে যেতে হবে। দু’জন বসেছিলেন কাছে। তাঁদের কাছ থেকে আরেক শনপাপড়িওয়ালার ঠিকানা জানা গেল। তিনি আবার নামে সত্যিই রামের ভাই। গিয়ে দেখি, তিনি বাড়ি নেই। একজন বাইকে বড় বড় ব্যাগ নিয়ে শনপাপড়ি কিনতে এসেছিলেন। তিনি ফোনে ধরলেন রামের ভাইকে। জানতে চাইলেন, কারখানায় অপেক্ষা করবেন কিনা? আমাদের কথাও বললেন তিনি। রামের ভাই বোধহয় আমাদের আগমনের হেতু বুঝতে পারছিলেন না। ক্রেতাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। ক্রেতা আবার আমাদের প্রশ্ন করলেন, ‘‘কেন এসেছেন?’’ বললাম, শনপাপড়ির খোঁজখবর। কথাটা বোধহয় বিশ্বাসযোগ্য হল না রামের ভাইয়ের। শনপাপড়ির আবার কেউ খোঁজখবর করে? মিষ্টি লোকে খেতে আসে। খোঁজে কে আসে? ফলে ফোন ধরিয়ে দেওয়া হল আমার হাতে।

চলছে মণ্ডের দলাইমালাই।

ফোনে সন্দেহজনক গলাটি বেশ টের পাওয়া গেল। রামের ভাইয়ের জিজ্ঞাসা, ‘‘কেন খোঁজখবর করছেন?’’ যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘‘এখানে কেন এত শনপাপড়ির কারখানা? কবে থেকে হল? কী ভাবে তৈরি হয়? কোথায় যায়? এসব জানতে চাই।’’ সব শুনে রামের ভাইয়ের সটান উত্তর, ‘‘আমি এখন যেতে পারব না।’’ বুঝলাম ইনিও লেখায় ভয় পাচ্ছেন। লেখালেখি কি খারাপ? হাল কি আমরা ছেড়ে দেব?

অভিজ্ঞতা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ইতিহাসকে এঁরা হয় সন্দেহের চোখে দেখছেন। নয়তো ভয় পাচ্ছে। কীসের ভয় কে জানে? অবশ্য মাধ্যমিকে ইতিহাস নিয়ে আমার যথেষ্ট ভয় ছিল। সাধে কি বলে বাঙালি ইতিহাস বিস্মৃত জাত? সুতরাং ইতিহাস দিয়ে এঁদের কাত করা যাবে না। অর্থনীতি দিয়ে কাত করতে হবে। হুগলির গাংপুরে রাবড়িগ্রামে রাবড়ি খেতে গিয়ে এমন তাড়া খেয়েছিলাম। তখন অর্থনীতিই আমাদের বাঁচিয়েছিল। রামের ভাইয়ের ক্রেতার কাছ থেকে আরেক শনপাপড়ি কারখানার হদিস জেনে নিয়েছিলাম। সে দিকে যেতে যেতে ঠিক করে নিলাম, পরের কারখানায় আমাদের বক্তব্য হবে, শনপাপড়ি কিনতে এসেছি। খোঁজখবর শব্দটিকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। কেনায় নরম হলে কথায় এগোব।

মণ্ডের ব্যূহে ঢালা হচ্ছে বেসন-ঘিয়ের গরম মিশ্রণ।

পরের মালিকও বাড়ি নেই। দরজা খুলে এক মহিলা জানালেন। তবে আশার কথাও শোনা গেল। মালিকের ফিরতে দেরি হলেও মালিকের বাবা কাছেপিঠেই আছেন। মিনিট দশেক অপেক্ষা করলে তিনি চলে আসবেন। লোকে সুদিনের জন্য জীবনভর অপেক্ষা করেন। শনপাপড়ির জন্য আমরা ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে পারব না? কচুরিপানা ভরা পুকুর পাড়ে ঘোরাঘুরি এবং একে অপরের পা টেনে কালক্ষেপ করলাম। সবুরে নিশ্চয় শনপাপড়ি মিলবে।

কিছুক্ষণ পরে এলেন এক প্রবীণ ব্যক্তি। আসার সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দিয়ে দিলাম। মাথা পিছু ২০টা করে। ইন্দ্র আর অতনু আলাদা করে আরও ২০টা নিল। অতনু যাবে শালির বাড়ি। আর ইন্দ্র যাবে দাদার শ্বশুরবাড়ি। ভদ্রলোক মিষ্টির প্যাকেট করতে গেলেন। আমরা অপারেশনের কার্যপ্রণালী ঠিক করে ফেললাম। মিষ্টি হাতে পাওয়ার পরে গল্পের ছলে কিছু কথা জেনে নিতে হবে। খাতা-পেন বার করলে আবার যদি হাঁকিয়ে দেন। তাই প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে প্রতিটি কথা শুনবে। চল্লিশ পেরিয়েছে। চোখের সঙ্গে মনেও ছাতা পড়েছে। তথ্য ভুলে যেতে পারি। তবে ভদ্রলোককে নরমসরম বলেই মনে হল। তবুও সাবধানের মার নেই।

চিনির মণ্ড আর গরম বেসনের মিশ্রণ হয়ে ওঠে এমন তন্তুময়। এই পদ্ধতির নাম টানা।

প্যাকেট এল। দাম মিটল। তার পর প্রবল সৌজন্য মাখানো স্বরে শুধালাম, ‘‘শুনেছি, এই গ্রামে নাকি ঘর ঘর শনপাপড়ি তৈরি হয়?’’ প্রবীণ ব্যক্তিটি বললেন, ‘‘ঘর ঘর নয়। খানতিনেক কারাখানা আছে।’’ প্রশ্নের উত্তর যখন দিয়েছেন তখন লাইনে ট্রেন গড়িয়েছে। এবার একে ‘নন-স্টপ’ চালাতে হবে। শুরু হল প্রশ্ন। আমাদের প্রশ্নের ট্রেন একসময়ে গন্তব্যে পৌঁছল। প্রশ্ন-যাত্রায় শনপাপড়ি বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা করা গেল।

শনপাপড়ি চালতাখালিতে কুটির শিল্পের মতো নয়। বরাবরও নেই। বছর পনেরো বা তার কিছুটা আগে শুরু হয়েছিল। এখানকার শনপাপড়ি বিভিন্ন জায়গায় যায়। বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, হলদিয়া, কলকাতা। প্রবীণ ব্যক্তিটি বললেন, তাঁদের শনপাপড়ি কলকাতার দু’টি বিখ্যাত দোকানে যায়। দু’টি দোকানেরই সন্দেশ তৈরিতে বেশ নাম রয়েছে। এ ছাড়াও হকারেরা কারখানাগুলো থেকে শনপাপড়ি নিয়ে বিভিন্ন মিষ্টির এবং মুদি দোকানে সরবরাহ করেন। এখন কোনও মিষ্টির দোকানই নিজেরা শনপাপড়ি তৈরি করে না। শনপাপড়ি তৈরির কারিগরেরা আশপাশের গ্রাম বা একটু দূরের গ্রাম থেকেও আসেন।

টুকরো করা হচ্ছে বাদাম ইত্যাদি।

কথা বলতে বলতে প্রবীণ ব্যক্তিটি ঘরে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরলেন বেশ কিছু শনপাপড়ি নিয়ে। সেগুলো সাধারণ শনপাপড়ি নয়। উপরটা কালো মতো। হাতে নিতে বুঝলাম, চকলেট শনপাপড়ি। ফিউশন মিষ্টির এখন চল হয়েছে। বেচারা রসগোল্লার উপরে নানা পরীক্ষা চলছে। তাপিয়ে (বেকড), চাপিয়ে (চকলেট) রসগোল্লাকে বিশ্বায়িত করার চেষ্টা দুর্নিবার। শনপাপড়িও সেই দলে নাম লিখিয়েছে দেখছি। এ বিষয়ে আমি একটু গোঁড়া। তবে চেখে দেখতে আপত্তি নেই। ভদ্রলোক খুশি হয়ে আমাদের খেতে দিয়েছেন চকলেট শনপাপড়ি। প্রবীণ ব্যক্তিটির ব্যবসা উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হোক।

লেখা হবে বলে তথ্য জোগাড় করিনি তাই প্রবীণের নাম দিলাম না। কিন্তু এই তথ্যে যে আমাদের কাজ হবে না। কেমন করে শনপাপড়ি তৈরি হয় জানা হল না যে। এই ভদ্রলোকের কারখানায় সকালের দিকেই শনপাপড়ি তৈরি হয়। তখন এলে দেখাতেনও হয়তো। এখন কী করা যায়? সমাধান বাতলাল ইন্দ্র। ওর দাদার এক তুতো শালা ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে আমাদের যেতে হবে পেঁড়োয়। সেখানেও কয়েকটা শনপাপড়ি কারখানা রয়েছে। তবে কয়েকদিন পরে আসতে হবে। কারখানা মালিকের বাড়িতে রাসপুজো রয়েছে। কাজ করতে গেলে দাদা-দিদি ধরতে হয়। আমাদের শালা ধরতে হল।

শনপাপড়ি।
পাটায় বাদাম ইত্যাদির টুকরোর উপরে শনপাপড়ির তন্তু।

এক মঙ্গলবার আবার পেঁড়ো যাত্রা। এবার দীপু আর ইন্দ্র। ইন্দ্রর দাদার শালা পুষ্কর মান্না পেঁড়ো থেকে পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন নজরখাঁ গ্রামে। কার্তিক পালের শনপাপড়ি কারখানায়। তখন পুরোদমে শনপাপড়ি তৈরির কাজ চলছে। কার্তিকবাবু জানালেন, তাঁর বাবা জয়দেব পাল এই কারখানা চালু করেছিলেন। জয়দেববাবু ছিলেন বড়বাজারের গুপ্ত ব্রাদার্স মিষ্টির দোকানের হেড কারিগর। কাজ ছেড়ে তিনি নিজের ব্যবসার দিকে ঝোঁকেন। এই গ্রামে খানতিনেক শনপাপড়ির কারখানা রয়েছে। গ্রামে প্রথম শনপাপড়ির কারখানা করেছিলেন গোপাল ঘোষ নামে একজন। কার্তিকবাবুদের শনপাপড়িও কলকাতায় যায়। তবে ব্যবসায়িক কারণেই কোন কোন দোকানে যায় তা বললেন না। বড় দোকানের তাতে বিক্রিতে ভাটা পড়তে পারে।

আমরা জানতাম শনপাপড়ি দু’রকমের হয়। মিষ্টির দোকানে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোকে কার্তিকবাবুরা বলেন, চাপা বা পেটা মাল। ছোটবেলায় টিনের বাক্সে করে শনপাপড়ি বিক্রি করতে দেখেছি। হালকা সুতো ওঠা। এই শনপাপড়ি এখন মুদি দোকানেও পাওয়া যায়। এগুলোকে বলে হাওয়াই মেঠাইয়ের মতো শনপাপড়ি। পুষ্করদার মিষ্টির দোকান রয়েছে। তিনি জানালেন, বর্ধমানে নাকি কাঠি শনপাপড়ি মেলে। আমরা দেখিনি কোনওদিন।

চলছে মসৃণ করার কাজ।

কী ভাবে তৈরি হয় শনপাপড়ি? পুরো প্রক্রিয়াটা কারখানার মালিক এবং কর্মী যত্ন নিয়ে দেখালেন। মূল উপকরণ বেসন, ময়দা, ঘি, চিনি। মেশানো হয় পেস্তা, কাঠ বাদাম, চিরঞ্জি দানা (এটা কী জানি না)। প্রথমে বেসন, ময়দার মিশ্রণকে ঘিয়ে গরম করতে হয়। কম দামের শনপাপড়িতে ডালডা মেশানো হয়। মিশ্রণ গরম করার সময়েই অন্য কড়াইয়ে চিনির পাক করা চলে। চিনি নাড়তে নাড়তে জেলির থেকেও কিছুটা আঁট করে নিতে হয়। বড় বারকোশে চিনির মণ্ডটা ফেলে কর্মীরা সেটি লাঠি দিয়ে দলে আরও করতে থাকেন। কিছুক্ষণ দলাই মালাইয়ের পর চারজন চারদিক থেকে লাঠি দিয়ে টেনে ধরে মণ্ড বারকোশ জোড়া গোলাকার করেন। সেই গোলের মাঝে বেসনের মিশ্রণটি ঢেলে দেওয়া হয়। তার পর একটানা লাঠি দিয়ে টানাটানি চলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিনির মণ্ড আর বেসনের মিশ্রণ মিশে পাটের মতো লম্বা আঁশ আঁশ হয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে সেই আঁশগুলো একটা স্টিলের পাটায় রাখা হয়। তার আগে অবশ্য ওই পাটায় পেস্তা, কাঠ বাদাম, চিরঞ্জি দানা ইত্যাদি ছড়িয়ে দেন কেউ। পাটের মতো মিশ্রণটিকে লাঠি দিয়ে পিটে, ঠেসে চার কোণা মসৃণ করেন করে নেন কর্মীরা। সেই কাজ শেষ হলে হেড মিস্ত্রি শনপাপড়ি কাটতে শুরু করেন। একটা পাটা থেকে খদ্দেরের অর্ডার অনুযায়ী শনপাপড়ি কাটা হয়। একটা পাটা থেকে ৪২০-৪৮০টা পর্যন্ত শনপাপড়ি বার করা যায়। সংখ্যায় বেশি হলে শনপাপড়ির আকার ছোট হয়। কাটার পরে পাটা ওল্টালেই শনপাপড়ি তৈরি। পাটায় ছড়ানো পেস্তা ইত্যাদির টুকরোগুলো উপর দিকে চলে আসে। শনপাপড়িতে যেমন দেখি আমরা।

তৈরি শনপাপড়ির পাশে মালিক কার্তিক পাল।

কার্তিকবাবু আমাদের আপ্যায়নের জন্য ঘিয়ের তৈরি শনপাপড়ি খাওয়ালেন। সাধারণ শনপাপড়ির সঙ্গে স্বাদের তফাৎ বেশ বোঝা যায়। দামেরও তফাৎ রয়েছে। ঘিয়ের শনপাপড়ি বাজারে ১২ টাকা পিস। আমরা যে যার বাড়ির জন্য কিনলামও। কারখানার ম্যানেজার সৌরভ পাল একটা প্যাকেটেই সকলের মিষ্টি গুছিয়ে দিলেন। কার্তিকবাবু বললেন, প্যাকেটে করেই দোকানে দোকানে যায় শনপাপড়ি। প্যাকেটে বা বয়ামে রাখলে অনায়াসে এক মাস থেকে যায়।

সব প্রসাধন শেষে শোভন পাপড়ি।

শনপাপড়ির পাক প্রণালী জানলাম। এবার একটু ঠিকুজি কুলজির সন্ধান নেওয়া যাক। মিষ্টান্নটি বাঙালি নয়। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য তা-ই বলছেন। গত বছরের ‘এবং জলঘড়ি’ পত্রিকায় বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের ‘বাঙালির মিষ্টান্ন: সংস্কৃতির একদিক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি বলছেন, শনপাপড়ির শন শব্দটি এসেছে সোহন থেকে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে সোহন হালুয়া পাওয়া যায় সেই সোহন। শোভন শব্দটি থেকে সোহনের উৎপত্তি। শনের তন্তুর মতো দেখতে বা সোনার মতো রং বলে শন নয়। পাপড়ি এসেছে পাঁপড় থেকে।

চালতাখালিতে প্রবীণ ব্যক্তির দেওয়া চকলেট শনপাপড়ি।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে এক চিকিৎসকের পোস্ট দেখছিলাম। তিনি দাবি করেছেন, ধোকলা চলবে না বাংলায়। শনপাপড়ির দিকে এখনও তাঁর নজর পড়েনি। খাবারদাবারে সাজাত্যবোধে এত অভিমান ভাল লাগে!

কভারের ছবি— শনপাপড়ি কাটছেন কার্তিক পালের হেড মিস্ত্রি

ছবি- দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *