কোচবিহার
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

কোচবিহারের রাজকীয় প্রাসাদে একদিন

ঋতুপর্ণা ঘোষ

পায়ের তলায় সর্ষে কথাটা মনে হয় তখনই ঠিক হয় যখন কিছুটা মনের কোণেও সর্ষে থাকে। মানে ওই ঘোরার ইচ্ছে আর কি…। তা এই মাসের মাঝে আমারও তেমনই এক যোগ এসেছিল। কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই ঘুরে এলাম কোচবিহার।

পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঘুরে এলাম উত্তরের এই ছোট্ট শহরটা থেকে। আমাদের ঘরের ট্রেন তিস্তা তোর্সা চেপে। এবারের বেড়ানোটা যদিও একটু আলাদা। দলের অনেকের দায়িত্ব ছিল। তার সঙ্গে ছিল অনুষ্ঠানের দায়িত্বও। তবুও ট্রেনের চাকার গতিতে মন ও কেমন যেন বোহেমিয়ান হয়ে যায়।

রাজপ্রসাদ।

ট্রেনে তো কত গল্প হয়। দল বেঁধে থাকলে মজা হয় দ্বিগুণ। গল্প, মজা, ঘুম সব মিলিয়ে এসে পৌঁছলাম গন্তব্যে। বেশ মিষ্টি শীতের হিমেল হাওয়া এসে লাগল গায়ে। যেন আমাদের অভিবাদন জানালো প্রাচীন এক জনপদ। এখন পুরোপুরি শহর। কোচ জনজাতির বাসভূমি। তাঁদের নামেই জনপদের নাম কোচবিহার। এখন তো পুরো শহরের নাম কোচবিহার।

রাজকীয় প্রতীক।

আমাদের থাকার জায়গা হয়েছিল গেস্ট হাউসে। পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রের ঠিক করে দেওয়া সরকারি গেস্ট হাউস সেটা। রুমে ঢুকে চটপট খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। তার পর দল বেঁধে ঘুরে এলাম রাজপ্রাসাদ দেখতে। কোচবিহার শহরে এলে অবশ্যই দ্রষ্টব্য এই প্রাসাদ। এটি যেন কোচবিহারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ।

প্রাসাদের গঠনশৈলী, রীতি নিয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না। রাজপ্রসাদের পরিচয়জ্ঞাপক একটি বোর্ড লাগানো আছে। তা থেকে কিছু তথ্য জানতে পারলাম। ইতালিতে নবজাগরণের পরে নানা বিষয়ে উন্নতি হয়েছিল। স্থাপত্যরীতিও উৎকৃষ্ট হয়েছিল। নবজাগরণের পরের ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি প্রাসাদটি। উইকিপিডিয়া অবশ্য বলছে, প্রাসাদটি ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে তৈরি। প্রাসাদ তৈরি করেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। ১৮৮৭ সালে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। পাশ্চাত্য শিল্পকলার বহু নিদর্শন এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে। রাজপ্রাসাদের বোর্ড বলছে, দরবার কক্ষটি রোমের সেন্ট পিটার গির্জার অনুকরণে তৈরি। প্রাসাদের ভিতরে শয়নকক্ষ, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড বোর্ড দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কী রাজকীয় বৈভব!

অনন্য সুন্দর কারুকাজ।

এ সব দেখে আমার আবার মনের মাঝের রানি হওয়ার ইচ্ছাটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আর কী! দেখলাম কোচবিহার রাজাদের রাজকীয় প্রতীক। এমন প্রাসাদে থাকতে পারলে কী ভালই না লাগত। জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবী ছিলেন কোচবিহারের রাজকন্যা। ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যে গায়ত্রী দেবী অতুলনীয়। প্রাসাদ যিনি তৈরি করেছিলেন সেই নৃপেন্দ্র নারায়ণের নাতি জিতেন্দ্র নারায়ণ। জিতেন্দ্র নারায়ণের মেয়ে গায়ত্রী দেবী।

মদনমোহনের মন্দির।

প্রাসাদ দেখে আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম মদনমোহন মন্দিরে। মদনমোহন কোচবিহারের আরাধ্য দেবতা। আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে বড় রাস উৎসবের মেলা হয় এই কোচবিহারে। ঘুরে এলাম সুন্দর বাগান। বাগানের ভিতর রয়েছে সাগরদিঘি। সে-ও বড় সুন্দর। বাগানে প্যাগোডা রীতিতে বানানো রানির সমাধি। প্রকৃতি, ইতিহাস, আভিজাত্যের এক সুন্দর মিলন ভূমি এই কোচবিহার। ঘুরতে আসিনি। অনুষ্ঠান করতে এসেছি। তাই আশপাশের এলাকা ঘোরা হল না।

সাগরদিঘি। বাগানের ভিতরে।

সারাদিন ঘুরে শেষে রাজকীয় ভূরিভোজ করা হল। সুন্দর স্মৃতিতে থেকে গেল কোচবিহার।

ছবি— লেখিকা ও সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *