টেরাকোটা।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ঝিখিরার মন্দিরে মন্দিরে

দীপক দাস

ইচ্ছেটা ছিল সেই জয়পুর গ্রামে যাওয়ার পর থেকে। ১৩ লোকদেবতার গ্রাম দেখে আসার পরে তুহিন বলেছিল, আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে ভাল হত। তাহলে মোড়ে মোড়ে মন্দির দেখতে পেতাম আমরা। তুহিন এক সময় বস ছিল আমার। হাওড়ার পাক্ষিক সংবাদপত্র ‘যুগের খবর’এর প্রকাশক। ওর কথায় গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাসটা রয়ে গিয়েছে। এক সময় আমিও যে ওই পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতাম। তাছাড়া তুহিনের বাড়িও আমতার দিকে কোথাও। জায়গাটা ও ভাল চেনে।

পরামর্শ নেওয়ার পরে এক বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু ঝিখিরায় যাওয়া হয়নি। যাওয়া তো হয়নি তেমন কোথাও। তাই একদিন মঙ্গলবার দেখে বেরিয়ে পড়া গেল। ইন্দ্রর বাইকের পিছনে আমি। আর দীপু একলা। রাস্তায় জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোচ্ছিলাম। একসময় দেখতে পেলাম, ঝিখিরা-হাওড়া রুটের অনেক বাস দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, মূল ঝিখিরায় আসা গিয়েছে। না হলে দোকানের সাইনবোর্ডে আগেই ঝিখিরা নামটা পেয়েছি। এবার মন্দিরের খোঁজ। মন্দিরগুলো কি এক জায়গায় আছে? নিশ্চয় নয়। তবে এক জায়গায় অনেক মন্দির আছে, এটা শুনেছি। সেটাই পথচিহ্ন আমাদের। এক টোটোচালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই সূত্র ধরেই, এক জায়গায় অনেক মন্দির আছে কোথায়? তিনি আরেকটু এগিয়ে যেতে বললেন।

সীতারামের মন্দির।

জায়গাটার নাম রাউতাড়া। দু’টো রাস্তা গ্রামের দিক থেকে এসে মূল রাস্তার দু’পাশে মিশেছে। আমাদের সামনে তিনদিক খোলা। এবার কোনদিক? রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি একটু ভেবে গ্রামের বাঁদিকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘এখানে একটা মন্দির আছে। অনেকে দেখতে আসে।’’ কিন্তু একটা মন্দির তো। অনেক মন্দির থাকার কথা। এবার এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি দেখালেন রাস্তার ডানদিকে। ওদিকে কিছুটা গেলে ওখানে এক সঙ্গে অনেক মন্দির আছে। তবে এটাও জানালেন, বাঁদিকে রাস্তা ধরে গিয়ে একক মন্দিরটাও দেখে আসতে। বাইক বাঁকল বাঁদিকে।

সীতারাম মন্দিরের নির্মাণ ফলক।

জিজ্ঞাসাবাদ করে জায়গা মতো পৌঁছনো গেল। কিন্তু মন্দির কোথায়? আধুনিক ছাঁদের দুর্গাদালান তো! এ মন্দিরে কোনও বিশেষত্ব নেই। দেখে কী হবে! ‘ফিরে চল’ বলতেই ইন্দ্রর ঝাড় খেলাম। জ্ঞান-ঝাপটা। বলল, ‘‘আমরা তো এরকম ছিলাম না? শেষ পর্যন্ত দেখে তবেই ফিরি।’’ ভয়ে চুপ হয়ে গেলাম। বাইক দুর্গাদালান পার করতেই চোখে পড়ল অপূর্ব মন্দিরটা। পুবমুখী মন্দিরের গায়ে অপূর্ব সব টেরাকোটার কাজ। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায়। দীপু আর ইন্দ্র ছবি তোলা শুরু করল। আমি মন্দিরটা দেখতে শুরু করলাম। আটচালা মন্দির। টেরাকোটার কাজে রাম-রাবণের যুদ্ধ ধরা হয়েছে। স্তম্ভের উপরে তিনটি প্রবেশ পথ। তিনটির উপরেই রয়েছে লঙ্কাযুদ্ধের প্যানেল। আরেকটু উপরের ধাপে টেরাকোটার কারুকাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট খোপে রয়েছে আরও কিছু মূর্তি। মোট ২৪টা। এই প্যানেলের দু’পাশ দিয়ে দু’টি প্যানেল রয়েছে। সেগুলোর খোপেও এরকম মূর্তি আঁকা। মূর্তি আছে মন্দিরের দুই প্রান্ত ভাগেও। মন্দিরের খিলানেও রয়েছে টেরাকোটার কাজ।

রায়েদের নহবতখানা ও দোলমঞ্চ।

কীসের মন্দির? পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন, সীতারামের মন্দির। এছাড়াও অন্য আরও কিছু ঠাকুরের মূর্তি আছে। মন্দিরের গ্রিলের দরজার তালা দেওয়া। মন্দিরের পূজারী থাকেন পাশের গ্রামে। ফলে ডেকে আনা সম্ভব ছিল না। মূর্তি দেখা হয়নি। মন্দিরের নির্মাণ ফলকটা ভাল করে দেখছিলাম তিনজনে। মোটামুটি কিছু উদ্ধার করা গেল। মন্দিরটি তিনশো বছরের বেশি পুরনো। ফলকে লেখা আছে, ১৬২২ শকাব্দে তৈরি। অর্থাৎ ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে। মন্দির শিল্পীর নামও হয়তো লেখা আছে ফলকে। কিন্তু আমরা পড়তে পারিনি। মনে হল শেষের দিকে লেখা, ‘…পালকর্মী গঠিত’। কোনও পাল পদবিধারী মন্দির তৈরি করেছিলেন তাঁর দলবল নিয়ে? জানি না।

রায়েদের রাসমঞ্চ।

বাঁদিকের মন্দির দেখার পরে ডানদিকে চলে এলাম। গলির মতো রাস্তা পেরিয়ে এক জায়গায় এসে পড়লাম। এখানে অনেকগুলো মন্দির। মন্দিরগুলোর কাছে একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুল রয়েছে। এখানেও দেখলাম টেরাকোটার কাজে সাজানো একটা মন্দির। মন্দিরের নির্মাণ শৈলী একেবারেই আগের মন্দিরের মতো। হুবহু মিল। টেরাকোটার প্যানেলগুলো পুরো এক। মন্দিরের খিলানগুলোয় তবে এই মন্দিরটি অনেক পরে তৈরি। নির্মাণ ফলকে লেখা, ১৬৮৪ শকাব্দ। অর্থাৎ ১৭৬২ সালে। এই মন্দিরের নির্মাণ শিল্পীর নামটা পড়তে পেরেছি। শুকদেব মিস্ত্রি। মন্দিরের খিলানে টেরাকোটার কাজ রয়েছে এই মন্দিরেও।

রয়েছে রথও।

পুবমুখী মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে ডানপাশে একটি রাসমঞ্চ এবং বামপাশে দোলমঞ্চ রয়েছে দেখলাম। রাসমঞ্চ ক্ষয়ে গিয়েছে। দোলমঞ্চটি উল্লেখযোগ্য। এর গায়ে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার মুহূর্ত। দোলমঞ্চের পাশেই একটা উঁচু নির্মাণ। অনেকটা প্রবেশপথের মতো। কিন্তু সেটির দু’টো ধাপ। ভাবলাম, হয়তো কোনও তোরণ হবে। নিজেরা আলোচনা করছিলাম। রাস্তা দিয়ে এক তরুণ যাচ্ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি বললেন, এটা নহবতখানা। এবার বোঝা গেল কেন তোরণের মতো নির্মাণটার দু’টো ধাপ। দোলমঞ্চের পাশে একটি রথও রয়েছে দেখলাম।

টেরাকোটার মন্দিরের পাশে কাত্যায়নী মন্দির।

টেরাকোটার মন্দিরের পিছনে ক্যাতায়নী মন্দির। মন্দিরের চালায় তৈরি হচ্ছে মূর্তি। খড়ের কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়েছে। সামনেই হয়তো পুজো। মন্দিরের ডানপাশে একটা চূড়া দেখা যাচ্ছে। মন্দিরেরই চূড়া। কিন্তু সেটি বাড়ির ভিতরে বলে আর ঢুকলাম না। দুপুরবেলা লোকে বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু এই মন্দিরগুলো কাদের? এক জায়গায় এত মন্দির করেছেন কেন? এক ভদ্রলোক কিন্ডার গার্টেন থেকে মেয়েকে নিতে এসেছিলেন। তিনি জানালেন, এগুলো সব রায়েদের মন্দির। রাস্তার উল্টোদিকে পেল্লায় রংচঙে বাড়ি দেখিয়ে বললেন, এই বাড়িতেই থাকেন রায়েদের উত্তর পুরুষ। একজনকে ডেকেও দিলেন তিনি। কিন্তু রায়েদের কোনও এক উত্তর পুরুষ দোতলা থেকে হাঁক পেড়ে জানালেন, মন্দিরের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।

তিনটি শিবমন্দির।

মন ভেঙে গেল। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, আরও মন্দির রয়েছে কাছাকাছি। কিছুটা এগিয়ে গেলেই। এগিয়ে গেলাম। সেখানে গায়ে গায়ে লাগানো তিনটি শিবমন্দির দেখতে পেলাম। খুবই জরাজীর্ণ অবস্থা। দু’টি মন্দিরের গঠনরীতি একই রকম। একটি চালা পদ্ধতিতে তৈরি। এক ভদ্রমহিলা যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি জানালেন, এগুলো সব রায়েদেরই মন্দির। কাছেই ওঁদের বাড়ি। ওঁরাই ভাল বলতে পারবেন। ভদ্রমহিলাকে জানানো হল, রায়েদের উত্তর পুরুষের কিছু না জানার কথা। মহিলা একটু অবাক হয়ে চলে গেলেন। একটা মন্দিরের চূড়ায় দেখলাম ফলক আছে। নীচে থেকে সেদিন পড়তে পারিনি। তোলা ছবি জুম করে দেখলাম, ফলকে লেখা ‘স্বর্গীয় মহাত্মা জীবনকৃষ্ণ রায়ের ধর্মপত্নী’ সম্ভবত অনঙ্গ মঞ্জরীর সমাধিক্ষেত্র এটি। নামটা বোঝা যাচ্ছে না। কালি উঠে গিয়েছে। শুধু মঞ্জরীটা বুঝতে পেরেছি। তাঁর সমাধিক্ষেত্রে শিবমন্দির তৈরি করা হয়েছে। শিবমন্দিরগুলো একটা খোলা চত্বরে। কাছে একটা খাল রয়েছে। চত্বরে কিছু সমাধি মন্দিরও রয়েছে। সবই রায় পরিবারের সদস্যদের। এই দিকের গ্রামে সমাধি মন্দির তৈরির একটা রেওয়াজ আছে। যে রেওয়াজ দেখেছি জয়পুর জুড়ে। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছিলেন।

রায় পরিবারের কোনও এক সদস্যের সমাধি মন্দির।

রায়েরা একসময় বহু অর্থের মালিক ছিলেন, দেখেশুনে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করলাম। মন্দিরের কথা ছেড়েই দিলাম। গোটা এলাকা জুড়ে বহু অট্টালিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিছু ধ্বংসের পথে। কিছু অট্টালিকায় লোকজন বাস করেন। লোকজন বললেন, সবই রায়েদের ছিল। অনেক জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কাছাকাছি এলাকায় কোনও ভূস্বামীর এত অট্টালিকা দেখিনি।

রথতলার চারটি মন্দির।

আমাদের মন্দির দর্শনের ইচ্ছে তখনও শেষ হয়নি। মাত্র কয়েকটা মন্দির! তবে যে তুহিন বলল, আরও মন্দির রয়েছে? আবার খোঁজ। এক গ্রামবাসী বললেন, পলাশপাইয়ের দিকে যেতে কিছু মন্দির রয়েছে। কিন্তু সেই মন্দিরগুলো খুঁজে পাইনি। তবে রথতলা নামে একটা জায়গায় দীপু হঠাৎই কিছু মন্দির দেখতে পেয়ে যায়। এক বিল্ডার্সের ভিতরে বিশাল চত্বর। একদম শেষ প্রান্তে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পরপর চারটে মন্দির। একটা দুর্গামন্দির। দু’টো আটচালা মন্দির। এই দুই মন্দিরের মাঝে একটি নবরত্ন মন্দির। আকারে খুব বড় নয়। মন্দিরগুলোর বিষয়ে কিছুই জানতে পারলাম না। আশেপাশে জিজ্ঞাসা করার মতো কোনও লোক ছিল না। শুধু মন্দিরের পাশে গাছে গাছে প্রচুর হনুমান লাফালাফি করছিল।

কভারের ছবি- রায়পাড়ার টেরাকোটার মন্দির

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *