দীপশেখর দাস
সব পেয়ে গেলে জীবন নষ্ট, বলেছেন গায়ক ও গীতিকার। যদি না চাইতেই পাওয়া হয়ে যায়! তাহলে? সেরকমই তো ঘটল সিটংয়ে। আমাদের সঙ্গে।
এক ক্ষুদ্রাতি ভাইরাসের ভ্রূকুটি কিছুটা এড়িয়ে পৌঁছেছিলুম সিটংয়ে (পবিত্র অরণ্য, লেপচাঘর আর অপরূপা সিটং দ্রষ্টব্য)। সে সময়েরই এক বৃহস্পতিবারের কথা। সকালে সিটং চষে বেড়াচ্ছি ‘ঘাসপুসে’র খোঁজে। সেই কাজেই সিটং গমন। কাজ মিটিয়ে দুপুরে যেতে হবে সিটংয়ের স্কুলে। ছোট একটা পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। তাই সকালের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ১১টা নাগাদ ফিরলুম হোম স্টেতে। ফিরে খবর পেলুম স্কুলের প্রধান শিক্ষককে কী একটা প্রয়োজনীয় কাজে হঠাৎই চলে যেতে হয়েছে শিলিগুড়ি। তাই আজ আর স্কুলে কোনও কাজ হবে না। অতএব অখণ্ড অবসর।
কিন্তু মন পাহাড়ে এসে যে অবসর চায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে চায়। ফলে আশপাশের ঘোরার জায়গার খোঁজ শুরু। যুগের রীতি মেনে স্মার্টফোনে হাত রাখা। ফোনের সিধু জ্যাঠা জানিয়ে দেয় কাছেই মংপু। চারচাকায় সওয়ারি হলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। হোম স্টের মালিক রোশনজির নিজেরই টাটা সুমো আছে। অতএব গাড়ির চিন্তা নেই। স্নান-খাওয়া জলদি মিটিয়ে রওনা দিলুম মংপুর উদ্দেশ্যে।
ম্যালেরিয়ার অব্যর্থ ওষুধ কুইনাইন। কুইনাইন পাওয়া যায় সিঙ্কোনা গাছের ছালে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বিপর্যস্ত ব্রিটিশরা তাই যথেষ্ট পরিমাণে কুইনাইন উৎপাদনে মংপুতে সিঙ্কোনা গাছের চাষ শুরু করে। তৈরি করে কুইনাইনের কারখানা। উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হওয়ায় মংপুর নামটা প্রায়ই শুনতে হয়। সিটংয়ের কাছেই মংপু জেনে তাই বেরিয়ে পড়া সিঙ্কোনা বাগান আর কুইনাইন কারখানা দেখতে।
আধ ঘণ্টা মতো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এক নদীর কাছে পৌঁছলুম। জায়গাটা একটু জমাটি। হোম স্টে, হোটেল আছে। রোশনজিকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম জায়গাটা যোগিঘাট। নদীর উপর সেতু। যোগিঘাট সেতু। জায়গাটা প্রথম দর্শনে ভালই লাগল। ঠিক হল ফেরার পথে এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাব।
যোগিঘাট পেরিয়ে কিছুটা যেতেই একটা চেক পোস্ট পড়ল। চেক পোস্ট পেরোতেই সিঙ্কোনার বাগান দেখতে পেলুম। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সারি সারি সিঙ্কোনা গাছের সারি। গাড়ি থেকে সিঙ্কোনা গাছের ছবি নেওয়া শুরু হল। কারখানা এখানে নেই। রোশনজি বললেন কারখানা মংপু শহরে। আমরা এখনও সেখানে পৌঁছইনি। আরও ঘণ্টা খানেক পর শহরে প্রবেশ করলুম। শহরটা বেশ জমাটি। লোকজনও অনেক। শহরের বেশ কিছুটা আগে থেকেই লোকবসতি বাড়ছিল। যোগিঘাট থেকে লোকবসতি শুরু হওয়া পর্যন্ত যে প্রকৃতি-পরিবেশ ছিল তার সঙ্গে শহরটাকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না। এক সময়ের পাহাড়ের রানি দার্জিলিং মানুষের চাপে আজ ঘিঞ্জি শহরের পরিণত হয়েছে। মংপুকেও প্রথম দর্শনে আমার এক টুকরো দার্জিলিং মনে হল। অথচ, এর কিছুটা আগেই পরিবেশ ছিল সবুজে মোড়া। মনোমুগ্ধকর।
মংপু শহরের বাজার অংশটা পেরোতে বেশ কিছু পুরোনো আমলের ঘর বাড়ি দেখতে পেলুম। রোশনজি জানালেন এগুলো সব কারখানার অংশ। খানিকটা এগিয়েই কাঁটাতার ঘেরা একসার দু’চালা ঘর। এটাই প্রধান সিঙ্কোনা কারখানা। রোশনজি আমাদের কারখানার প্রধান দরজার সামনে নিয়ে গেলেন। কারখানার উল্টোদিকেই রবীন্দ্র ভবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত। এটা উপরি পাওনা। কিন্তু, এই পাওয়ার মধ্যেও না পাওয়া। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্র ভবন বন্ধ। কারখানার মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
তবে না পাওয়ার মাঝেও তো পাওয়া থাকে। রবীন্দ্র ভবন বন্ধ। ভবনের মধ্যে প্রবেশ করা গেল না ঠিকই। কিন্তু রবীন্দ্র ভবন চত্বরে যাওয়া গেল। ভবনের কাচের জানালা ভেদ করে যতটা দেখা গেল দেখলুম। কবির ব্যবহার করা ওষুধের ঘর, শিশি দেখতে পেলুম। কবির লেখা কয়েক ছত্র ইতিউতি ফ্রেমে বাঁধানো। ভবনের সামনের ঘাসের গালিচা। গালিচার পরে উন্মুক্ত সবুজ পাহাড়। এখন পাহাড়ে কংক্রিটের ছোঁয়া। কবি যখন এখানে এসেছিলেন সে সময় পাহাড় যে আরও সবুজ-সুন্দরী ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এ পরিবেশে তো অনন্য সৃষ্টি হবেই।
এই বাড়ি, বা বলা ভাল বাংলো ছিল কুইনাইন বিশেষজ্ঞ মনমোহন সেনের কর্মক্ষেত্রের বাসভবন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। ‘ন হন্যতে’ নামে জনপ্রিয় উপন্যাসের লেখিকা। যে উপন্যাস থেকে পরে ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ সিনেমা তৈরি হয়েছিল। মৈত্রেয়ী দেবী ও মনমোহন সেনের আমন্ত্রণেই কবি ১৯৩৮ সালে প্রথমবার মংপু আসেন। ৫-৯ জুন কবি এই বাংলোয় বসবাস করেন। এর পর আরও কয়েকবার তিনি মংপু আসেন। মংপুতে থাকাকালীন অনেক কবিতা লিখেছিলেন কবি। সেগুলো ‘জন্মদিনে’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়। এখানেই তিনি লিখেছিলেন ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ এবং ‘ছেলেবেলা’। কবিগুরুর স্মৃতি স্পর্শ করে বাংলোর মধ্যে প্রবেশ না করতে পারার দুঃখ কিছুটা মনে রেখেই গাড়ির কাছে ফিরলুম।
গাড়ি কারখানার প্রধান ফটকের সামনেই রেখেছিলেন রোশনজি। আমরা নিজেদের মধ্যে শলা করছিলুম যদি কোনও ভাবে কারাখানার ভিতরে যাওয়া যায়। কারখানার পাহারাদার আমাদের দেখে কিছু বুঝলেন বোধহয়। নিজেই আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি ইত্যাদি। বেশ কিছু কথাবার্তার পর কারখানা ঘুরে দেখা যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলুম। কারখানায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার অধিকার তাঁর নেই। আমরা যেহেতু সরকারি অফিস থেকে গিয়েছি তাই হেড অফিসারের অনুমতিক্রমে ভিতরে যেতে পারি। কিন্তু, ইতিমধ্যেই কারখানার কাজের সময় শেষ। তাই হেড অফিসারও বেরিয়ে গিয়েছেন। অগত্যা আমাদের ফেরার পথ ধরা।
কারখানার বাইরের ছবি তুলব বলে রোশনজিকে সামনে বাজারের কাছে গাড়ি নিয়ে দাঁড়াতে বললুম। আমি ছবি তুলতে তুলতে বাজারের দিকে এগোচ্ছিলুম। একটা পুরনো বাড়ির ছবি তুলছি এমন সময় পুলিশ এসে হাজির। আমার এখানে আসার হেতু আর পুরনো বাড়ির ছবি তোলার কারণ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হল। তাঁদের জিজ্ঞাসা, সন্দেহ আর কৌতূহল নিরসন করে আমার অফিসের পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবে রেহাই মিলল।
ফেরার পথে কথা মতোই যোগিঘাটে থামা হল। নদীটির নাম রিয়াং। নদী পারাপারের সেতু কংক্রিটের। সেতুর অবলম্বনের লোহার খাঁচা সাদা। সেতুতে বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা নানা রঙের কাপড় টাঙানো। স্থানীয়দের কোনও প্রচলিত রীতি বলেই মনে হল। সেতুটা বড়জোর বছর দশেক আগের তৈরি। নতুন সেতুর পাশেই পুরনো সেতু। জরাজীর্ণ অবস্থা। অথচ একসময়ে সেইই ছিল এখানকার মানুষের নদী পারাপারের একমাত্র উপায়।
সেতুর পাশ দিয়ে নদীর কাছে যাওয়া যায়। বেশ জনসমাগম হয় এখানে দেখেই বোঝা গেল। চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, জলের বোতল, থার্মোকলের থালা বাটি পড়ে রয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকটা মদের বোতলও দেখতে পেলুম। নদীর সৌন্দর্য দেখার আগেই মানুষের অসৌন্দর্যে মন খানিক বিষণ্ম হল। দাঁড়ালুম নদীর কাছে। রিয়াংকে ছুঁলুম। তিরতির করে উপরের কোনও এক জায়গা থেকে বয়ে চলেছে অবিরত। রিয়াংয়ের দু’পারেই পাহাড়, ঘন সবুজ। জঙ্গলে অজস্র পাখির কলকাকলি। আকাশে গোধূলি রঙের ছোঁয়া। মোহময় প্রকৃতি। এখানে বসেই বইয়ে দেওয়া যায় এক পৃথিবী সময়।
সময় বয়ে যায়। নদীর স্রোতের মতো আমাদেরও এগিয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যা নামছিল। দূরে পাহাড়ের কোলে জায়গায় জায়গায় অন্ধকার জমাট বাঁধতে লাগল। আমাদেরও হোম স্টের দিকে ফেরা শুরু হল। ফেরার পথে পাহাড়ের এক বাঁক পেরিয়ে দেখলুম দূরে রাস্তার উপর চারটে ময়ূরী সার বেঁধে চলেছে। দিনের কাজ শেষ করে তারাও ঘরে ফিরছে বুঝি!
কভারের ছবি- রিয়াং নদী আর পরিবেশ
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)