ইন্দ্রজিৎ সাউ
একবার মিষ্টি খেতে বেরিয়েছিলাম আমরা। অনেকবারই বেরিয়েছি। আবার বেরোব। কিন্তু এই বেরনোয় একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল। করোনাভাইরাস, লকডাউনে জেরবার আমরা। গ্রুপের লেখা জোগাড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এদিকে গাঁ-গঞ্জে আলো করে থাকা মিষ্টিগুলোর স্বাদ নেওয়া যাচ্ছে না। মার্চে তখন সবে লকডাউন কাটিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। দীপকদা একদিন বলল, ‘‘চল মিষ্টি খেয়ে আসি এক মঙ্গলবার।’’ চল বললেই চলা যায় না আমাদের। দলের সকলের সম্মতি দরকার হয়। তাদের সময় সুযোগ দেখতে হয়। সেটা দেখতে গিয়েই দেখা গেল, কারও সময় হচ্ছে না। দীপু, বাবলা, শুভ কারও নয়। সময় হচ্ছিল না নাকি ভয়ে বেরোতে চাইছিল না, কে জানে? ফলে আমাকে আর দীপকদাকে বেরোতে হল।
কী মিষ্টি খাব আমরা? দীপকদা যা বলল, তাতে আন্দাজ পেলাম, দু’টো ট্রেনের মিষ্টি আর একটা দোকানের মিষ্টি চেখে দেখব। আমরা কাটোয়া লোকাল ধরব। ওই ট্রেনেই নাকি একটা নতুন মিষ্টি বিক্রি হয়। মিষ্টিটার নাম ক্ষীরমোহন। আমি কোনও দিন নাম শুনিনি। দীপকদা ছোটবেলা থেকে কাটোয়া লোকালে যাতায়াত করেছে। ও দেখেছে। ক্ষীরমোহন ছাড়াও লোকাল ট্রেনে বিক্রি হয় কাঁচাগোল্লা। এর নাকি দুর্দান্ত স্বাদ। না খেয়ে সার্টিফিকেট দিতে পারব না। গিয়ে দেখি। দোকানের মিষ্টিটা মিলবে গুপ্তিপাড়ায়। ওর নাম নাকি গুপো। আশ্চর্য নামের মিষ্টি।
আমরা দু’বার বাস পাল্টে বালিহল্টে এসেছিলাম। বালি থেকে ব্যান্ডেল গিয়ে কাটোয়া লোকাল ধরা। হাওড়া থেকে ট্রেন ধরিনি। ওদিকে যেতে সময় লাগত। আর মিষ্টি সব ওঠে সোমড়াবাজার থেকে। ফলে বালি স্টেশনই আমাদের সুবিধা। নির্দিষ্ট সময় ট্রেন পেয়ে গেলাম। দু’জনে পরিকল্পনা ভাঁজছিলাম। কী রকম করে খোঁজ খবর নেওয়া হবে। তখনই একটা ঝালমুড়িওয়ালার দিকে চোখ পড়ল। ঝাল মশলা রাখা কৌটো, বাটি, বয়ামের মাঝে একটা পলিথিনে মুড়ি মোড়া। সেটা মিনারের মতো উঁচু হয়ে আছে। এরকম কোনও ঝালমুড়িওয়ালার কাছে দেখিনি। কথা বলতে বলতেই দীপকদা উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘‘ছবি তোল, ছবি তোল।’’ দেখি, কাঁসার থালায় থাক থাক সাজানো বাদামি রঙের মিষ্টি নিয়ে উঠেছেন একজন। এগুলোই ক্ষীরমোহন। ছবি তুলতে শুরু করলাম।
কিন্তু কথা বলা হল না। মিষ্টিওয়ালা ঝালমুড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলছিলেন। করোনার সর্বনাশের গল্প। এখনও যে ভাল বিক্রি হচ্ছে না সেটাও বললেন। লোকে ভয়ে খাচ্ছে না। আমরা আর মিষ্টিওয়ালাকে বিরক্ত করলাম না। ঠিক করলাম, এখন গুপ্তিপাড়া চলে যাই। ফেরার সময়ে সোমড়াবাজারে নেবে ভাল করে খোঁজ নেব।
গুপ্তিপাড়ায় আমরা আগে এসেছি। বিশাল দল নিয়ে। তখন এসেছিলাম মন্দির দেখতে (মন্দির নগরীতে অষ্টাদশ টোটোআরোহী)। এখন এলাম মিষ্টি খেতে। পুরনো মিষ্টির দোকানগুলো খুঁজব। তাহলে নিশ্চয় গুপোর সন্ধান মিলবে। সেই মতো প্রথম গেলাম বড়বাজার রথতলায়। নিখিল সরকারের দোকানে। কিন্তু তিনি জানালেন, তাঁর দোকানে গুপো নেই। এখানে ভাল গুপো তৈরি করে সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার। অনেক পুরনো দোকান। যাওয়া হল সীতারামে। সীতারামে গুপো নেই বলল। গুপোর ইতিহাসও কিছু বলতে পারলেন না দোকানে যিনি রয়েছেন। মালিক নাকি বেরিয়ে গিয়েছেন।
তাহলে কি গুপো বাদ দিয়েই গুপ্তিপাড়া ছাড়তে হবে! যে টোটোটা ভাড়া করেছিলাম তার চালক শ্রীদুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারে নিয়ে গেলেন। সীতারামের কাছেই। দোকানে ছিলেন রমেন ঘোষ। কম বয়সি ছেলে। দোকানের একজন অংশীদার। রমেনবাবু অনেক সাহায্য করলেন। দোকানের গুপো তৈরির অন্যতম কারিগর মানিক মালোকে ডেকে সাহায্য করতে বললেন। জানলাম, গুপো তৈরিতে লাগে ছানা, চিনি, ছোট এলাচ। শীতকালে চিনির বদলে খেজুরের গুড়। প্রথমে ছানার পাক করা হয়। একটা কাপড় জলে ভিজিয়ে বিছিয়ে দিয়ে তাতে ছানার পাক কিছুটা নিয়ে ভিজে কাপড়ে হালকা আছাড় মারতে হবে। পাকটা থেবসে গিয়ে সন্দেশ হয়ে যাবে। দু’টো সন্দেশ একসঙ্গে করে কিছুক্ষণ রেখে দিলেই গুপো তৈরি। রমেনবাবু জানালেন, গুপোকে কেউ কেউ জোড়া সন্দেশ, জোড়া মন্ডাও বলে। অনেকদিনের মিষ্টি এটা। এই এলাকা থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছে গুপো। রমেনবাবু গুপো খাওয়ালেন। আমরা বাড়ি ও দলের অন্যদের জন্য কিনলাম। কিন্তু এক জায়গার গুপো খেয়ে লেখা ঠিক হবে? তাই ফেরার পথে আরেকটা দোকানের খোঁজ করলাম। সে দোকানের মালিক মিষ্টিওলা হলে কী হবে, মুখে এতটুকু মিষ্টি নেই।
রাগে আমরা অটো ধরে সোমড়াবাজার চলে এলাম। ট্রেনে সংগ্রাম গোস্বামী নামে সোমড়াবাজারের একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটি আমাদের সোমড়াবাজার স্টেশন রোডে ঘেঁটু ময়রার খোঁজ করতে বলেছিল। অটোওয়ালা আবার বললেন, ভোলা সরকারের নাম। কাটোয়া লোকালের অনেক পুরনো হকার। এখন দোকান করেছেন। ভোলাবাবু খুশি হয়েই ক্ষীরমোহন তৈরি দেখাতে রাজি হলেন। বললেন, প্রথমে রসগোল্লা তৈরি করতে হয়। রসগোল্লাকে রসের সঙ্গেই অনেকক্ষণ ধরে জ্বাল দিতে হয়। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট লাগে। জ্বাল দিতে দিতে রসগোল্লা গাঢ় বাদামি হয়ে যাবে। জ্বাল দেওয়া থামানো হয় যখন রসগোল্লা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বের হতে শুরু করে। এবার জ্বাল দেওয়া বন্ধ করে ঠান্ডা করতে হয়। ঠান্ডা হলে একটা করে বাদামি গোল্লা তুলে রস নিংড়ে বের করে নেন। বাদামি গোল্লা আবার ফুলে গোল হয়ে যায়। রস টেপার পরে গোল্লা ফুলে উঠলে এগুলোর উপরে ক্ষীরের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্ষীরের জন্যই ক্ষীরমোহন নাম। এখন বেকড রসগোল্লা হয়। ক্ষীরমোহন যেন তাদের আদিপুরুষ। রসে বেকড।
ভোলাবাবু ক্ষীরমোহনের ইতিহাস কিছু বলতে পারলেন না। উনি নিজে কাটোয়া লোকালে ৪৫ বছর ক্ষীরমোহন বিক্রি করেছেন। লকডাউনে ট্রেন বন্ধ হতে জমানো টাকা দিয়ে দোকান করেছেন। ভোলাবাবুর বাবা ধীরেন, জেঠু অঘোরও ক্ষীরমোহনও বানাতেন। পাইকারি দিতেন। আবার রসগোল্লাও তৈরি করতেন। ভোলাবাবু জানালেন, সোমড়াবাজারে ক্ষীরমোহন অনেক বাড়িতে তৈরি হয়। কেউ নিজে ট্রেনে বিক্রি করেন। কেউ বাড়ি থেকেই পাইকারি দেন ট্রেনের হকারদের। এরকম প্রায় ৩০ জন রয়েছেন। এঁরা হলেন, বীরেন দে, গুপ্তিপাড়ার মন্টু, শ্যাম, ক্ষিতীশ সাহা। দীপকদা মিষ্টিওয়ালাদের সঙ্গে থাকা জলের জায়গার কথা জিজ্ঞাসা করল। এটাও নাকি অন্যরকম। যাতে একটা বাঁকানো নল লাগানো থাকে। ভোলাবাবু জানালেন, ডালডার টিন কেটে জলের জায়গা তৈরি করেন। বাঁকানো নলটা আলাদা করে লাগিয়ে নেন। এখন অবশ্য স্টিলের জলের জায়গাও হয়েছে। জলের জায়গার ছবি ট্রেনে আমি তুলতে পারিনি। দীপকদা ব্যঙ্গ করল ভাল ফটোগ্রাফার নই বলে। তবে একটা ছবি তুলে এনে দিয়েছিল দেবু। আমার বন্ধু আর দীপকদার ভাই। ওর এখন এ পথে যাতায়াত। শ্বশুরবাড়ি যে।
এবার কাঁচাগোল্লার পালা। এখানকার কাঁচাগোল্লা নাকি দানা দানা হয়। এরকম কাঁচাগোল্লা আমরা গুপ্তিপাড়া, কালনায় খেয়েছি। সেই মন্দির (মন্দির নগরীতে অষ্টাদশ টোটোআরোহী) দেখতে আসার সময়ে। যে সীতারাম ওঙ্কারনাথে গেলাম গুপোর খোঁজে ওই দোকানেই খেয়েছিলাম। কিন্তু ট্রেনেরটা খাইনি। আজ খেলাম। দারুণ খেতে। মুখে দিলেই দানা দানা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নলেন গুড়ের কাঁচাগোল্লা ছিল। মন ভরে গেল। ভোলাবাবু জানালেন, ছানা আর চিনি দিয়েই তৈরি তাঁদের কাঁচাগোল্লা। শীতকাল হলে নলেন গুড় ব্যবহার হয়। কাঁচাগোল্লা দানা দানা করার জন্য ছানার জল ঝরান না। যখন পাক করা হবে তখন ময়রার হাতের তাড়ুর কেরামতিতেই তৈরি হবে বিশেষ কাঁচাগোল্লা। ভোলাবাবুর দোকান থেকে ক্ষীরমোহন আর কাঁচাগোল্লা কেনা হল। ওরা না হলে খুব মারবে আমাদের দু’জনকেই।
ভাল করে খাওয়া হয়নি। দীপকদার সঙ্গে বেরোলে খাওয়াদাওয়া হয় না ভাল। বুড়োটা খেতেই চায় না। তবে দারুণ একটা সফল হল। একটা সফরে তিনটে মিষ্টি খাইনি কখনও। বাকিরা খেয়েছে। ওরা একদিন বেরিয়ে রানাঘাটের পান্তুয়া, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া খেয়ে এসেছিল।
কভারের ছবি— কাটোয়া লোকালের ক্ষীরমোহন হকার
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)
খুব ভালো লাগলো। এই সব পুরানো দিনের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এদের তৈরীর রেসিপি জোগাড় করে একত্রীকরণ করাটা বেশ ভালো উদ্দ্যোগ।
লেখকের সঙ্গী ছিলাম আমিও। তাই এই প্রশংসার ভাগ কিছুটা নিলাম। এবং আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম। আপনার মন্তব্য আমাদের উৎসাহ দেবে।
ধন্যবাদ আপনাকে। আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুবই ভাল লাগল।