ইন্দ্রজিৎ সাউ
‘‘হ্যালো দীপকদা, ভরতপুর পটশিল্পীদের গ্রাম, ব্যাপারটা কী?’’ হোটেল রূমে ঢুকেই ফোন করলাম। তার আগে জানিয়ে রাখি, এবারে আমরা ম্যারাথন সফরে বেরিয়েছি। সঙ্গে দিব্যেন্দু আর বাইচুং। আমাদের দলের সদস্যরা একেবারে বসে গিয়েছে। নড়তে চায় না কোথায়? তিনজন নিজের নিজের আধুনিক পক্ষীরাজ নিয়ে। উদ্দেশ্য, পাহাড়ি রাস্তায় বাইক চালিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা। সেই জন্যই আমাদের প্রথম গন্তব্য শুশুনিয়া।
ভরতপুর গ্রামটি শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। ছাতনা থেকে শুশুনিয়া আসার পথে পড়ে। ভরতপুর থেকে শুশুনিয়া কিলোমিটার খানেক বা একটু বেশি হবে। তবে শিল্পীদের গ্রামে গেলে মূল সড়ক থেকে কিছুটা ভিতরে ঢুকতে হয়। শুশুনিয়া ঢোকার সময়ই আমি বোর্ড দেখে ফোন করি। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ, ‘‘খুব ভাল জায়গা। এখানে বেশ কয়েক ঘর পটশিল্পী আছেন। ছবি আর তথ্য নিয়ে আয়। আমাদের গ্রুপের জন্য খুব ভাল লেখা হবে।’’ এর পরে ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অমান্যি করি কী করে! এমনিতেই দলে আমার সৌরভের দাপটে বিরাট কোহলি অবস্থা।
শুশুনিয়ায় পৌঁছলাম। রাতে থাকার জায়গা মিলল। সঙ্গীদের প্রস্তাব দেওয়া হল, ভরতপুরে পটশিল্পীদের গ্রামে যাওয়ার। রাজি হল ওরা। এর আগে একবার শুশুনিয়া এসেছিলাম আমরা। দলের সঙ্গে। তখন সদ্য ঘোরাঘুরি শুরু করেছি আমরা ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’। সেবার বাঁকুড়া জেলার অনেকটা চষে ফেলেছিলাম। কিন্তু কাছের ভরতপুর যাওয়া হয়নি। তখন সম্ভবত ক্যাপ্টেনেরও জানা ছিল না শিল্পীদের গ্রামের কথা। এবার আমি সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নই।
পরদিন সক্কাল সক্কাল গিয়ে হাজির হলাম ভরতপুর পটশিল্পীদের গ্রামে। সামনে সুন্দর শুশুনিয়া পাহাড় আর চারপাশটা গাছ গাছালিতে ভরা। একটা নির্জন শান্ত একটি ছোট গ্রাম। গ্রামে যাওয়ার পথটিও খুব সুন্দর। রাস্তার দু’পাশটাই সবুজে ভরা। টিন, টালি দিয়ে ছাওয়া মাটিক বাড়ি রাস্তার দু’পাশে। একটা দু’টো পাকা বাড়িও চোখে পড়ল। মাটির বাড়ির দেওয়ালেও সুন্দর ছবি আঁকা। পটচিত্রের মতোই ছবি।
গ্রামে ঢোকার সময়ে ভেবেছিলাম পুরোটা গ্রাম জুড়ে পটশিল্পীদের বাস। ভুল ভাঙল শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে। এখানে মাত্র ১৮ ঘর শিল্পীদের বাস। যদিও এখানে আরও বেশ কিছু বাড়ি আছে। তবে সেগুলো আদিবাসী পরিবারের। শিল্প নিয়ে জানতে হলে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বললাম দরকার। খোঁজ করতে পেয়ে গেলাম, অনিল চিত্রকর, শম্ভুনাথ চিত্রকর, বরেন চিত্রকর আর গোলাপি চিত্রকরকে। ছিলেন আরও কয়েকজন পটশিল্পী। পরিবারের প্রায় সব মহিলা এবং পুরুষ পটচিত্র তৈরি করতে পারেন। তবে এঁরা এখানকার আদি বাসিন্দা নন। বেশ কয়েক পুরুষ আগে এঁদের পূর্বপুরুষ কালিপাহাড় থেকে এখানে চলে আসেন। এবং স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। আর কিছু বলতে পারলেন না তাঁরা। শিল্পীরা জানালেন, এঁরা সকলেই ভূমিহীন। সাঁওতালদের দান করা জমিতে এঁরা বসত করে আছেন।
কবে থেকে ভরতপুরের পটশিল্পীদের শিল্পকর্ম শুরু তা জানতে পারলাম না। শিল্পীরা জানালেন, তাঁদের শিল্পচর্চা কয়েকশো বছরের পুরনো। মূলত দেব দেবী আর সাঁওতালদের জীবনযাত্রার ছবি এঁদের আঁকা পটে দেখতে পাওয়া যায়। শিল্পীরা পট আঁকেন। আবার গানও বাঁধেন। পটশিল্পী বরেন চিত্রকর জানালেন, সাঁওতালদের গান, কৃষ্ণলীলা গান, যমরাজার গান আর মনসামঙ্গলের গান আছে। এই সব গান ওঁদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে।
কী ভাবে পট আঁকেন সেটা বুঝিয়ে দিলেন অনিল, বরেন, গোলাপি চিত্রকরেরা। পট আঁকতে একটু মোটা কাগজ ব্যবহার করেন। আঁকার রং সবই প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করা। কাগজ বাদে সমস্ত উপাদানই নিজেরা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করেন। সে সব দিয়ে বাড়িতেই রং তৈরি করে নেন। কোনও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহত হয় না। রং তৈরি করেন বিভিন্ন পাথর গুঁড়ো করে। এ ছাড়া গাছের পাতা, ফুল আর গাছের ছাল বেটে তৈরি হয় রং। আর কালো রংয়ের জন্য ব্যবহার করেন লম্ফের ঝুল। ঠিক যেমন আগেকার দিনে মা ঠাকুমারা কাজল তৈরি করতেন। আঠা হিসাবে ব্যবহার করেন বাবলা, বেল, আর নিম গাছের আঠা। এখন শিল্পীরা পট আঁকছেন মাটির পাত্রের উপরেও। আমরা মাটির একটা লম্বাটে পাত্র দেখলাম। তাতে সুন্দর সাঁওতালি জীবনের ছবি আঁকা।
একটা বিষয়েই খুব কষ্ট লাগল। শিল্পীদের অবস্থা খুবই করুণ। কোনও রকমে নিজেদের এবং এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। একসময়ে পট নিয়ে বাড়ি বাড়ি পটের গান করে ভিক্ষাবৃত্তি ছিল প্রধান জীবিকা। এখনও পট নিয়ে গ্রামে গ্রামে গান করে ভিক্ষা করেন। কেউ কেউ জনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নিজেদের ঠিক মতো প্রচারের আলোয় আনতে না পারায় এঁদের পট খুবই কম বিক্রি হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরে পিংলার নয়া গ্রামে পটশিল্পীদের বসত রয়েছে। সেখানে একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতি বছর মেলার আয়োজন করত। করোনার জন্য এখন বন্ধ। তবে ওই মেলা পিংলার পটশিল্পীদের অবস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে। এঁদের জন্য যদি সেরকম কিছু ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ভাল হয়। টিকে যেতে পারে বহু প্রাচীন শিল্পকলা।
আশার কথা, বর্তমানে সরকার পটশিল্পীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। প্রত্যেক শিল্পীকে ভাতা দেওয়া হয়েছে। বাড়িও করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মেলায়, বিভিন্ন সংস্থায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)