পৌলমী রক্ষিত
তৈরি করে নিতে হল একটা মিষ্টি চক্র। মিষ্টির রাজ্যের বাসিন্দা আমি। যে জেলায় থাকি সেই জেলার মিষ্টিতে বেশ সুনাম। আবার যে জনপদে থাকি সেখানে তো বড় বড় মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী। যাঁদের নাম ধাম মাঝে মাঝে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। এমন এক জায়গা থেকে গিয়েছি দিল্লিতে। বাংলার মিষ্টির জন্য প্রাণ তো কাঁদবেই। আর আমি আবার মিষ্টি প্রিয়। খাবার পরে মিষ্টি আমার লাগেই।
দিল্লি রাজধানী শহর। দিল্লি দূষণের, দিল্লি পরিযায়ীদের, অভিবাসীদের শহরও বটে। সব রাজ্যের মানুষ এবং তাঁদের সংস্কৃতির ছোঁয়া এই শহরের এক এক কোনায় লেগে থাকে। যে যে অঞ্চল থেকে আসে, সেখান থেকে আসার সময় যেন একটু গন্ধ কাপড়ে বেঁধে নিয়ে আসে। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ তাঁদের ভাষা আর আমার ভাষার সঙ্গে মিল অমিল খুঁজে বের করা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সব কিছুর আদানপ্রদান স্থল হল অফিসের চার দেওয়াল। সেই দেওয়ালেই চলে মিষ্টির আদানপ্রদান। দিল্লিতে মিষ্টির দোকান অবশ্য আছে। সে কথায় পরে আসছি।
প্রথমে গুজরাতি মিষ্টির কথা বলি। গুজরাতি খাবার বিষয়ে আগের একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, গুজরাতি খাবারের সঙ্গে বাঙালি খাবারের অবিশ্বাস্য মিল আছে। এবার একটা গুজরাতি মিষ্টির কথা। নাম তার ‘মোহনথাল’। আমার গুজরাতি সহকর্মী বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি আমেদাবাদ থেকে আসার সময়ে নিয়ে এসেছিলেন এই মিষ্টিটি। ‘মোহনথাল’ গুজরাত এবং রাজস্থানের অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টি। ঘি, বেসন, চিনি, এলাচ বাদামের মিশ্রণে তৈরি। অনেকটা মুগ ডালের হালুয়ার মতো খেতে। মোলায়েম এবং দানাদার ভাবের একটা সংমিশ্রণ আছে এই মিষ্টিটার মধ্যে। আমার মাওয়া (খোয়া) এবং ক্ষীর বিমুখ মুখে মোহনথাল খুব প্রিয় একটা মিষ্টি। আর রংটিও বড়ই চমৎকার। একটা গাঢ় হলুদ হালকা কমলা রঙের মিষ্টি। যেন হাতের মধ্যে ডুবন্ত সূর্য এসে ধরা দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ওড়িশা থেকে যাঁরা দিল্লিতে কর্মসূত্রে আসেন তাঁদের মিষ্টি নিয়ে এক অদ্ভুত সমস্যা তৈরি হয়। কারণ আমরা এতদিন ছানাজাত মিষ্টি খেয়ে অভ্যস্ত ছিলাম। দিল্লিতেও সব মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো কতটা রসগোল্লা তা নিয়ে পূর্বাঞ্চলের লোকেদের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কিছুতেই কাটে না। ওড়িয়া সহকর্মী একদিন দেখি, এক মিষ্টি সম্পর্কে আরেক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করছে। দ্বিতীয় সহকর্মী জানায়, সেটি রসমালাই। ওড়িয়া ভদ্রলোক আমার দিকে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিনিক্ষেপ করে চোখে চোখে উত্তর জানতে চাইছেন। বেজায় মাথা গরম করে বললাম, ‘‘এটা ছানার রসমালাই নয়, রসের রসমালাই। খেয়ে নিন। এটা এখানকার রসমালাই। আর যদি আরেকবার জিজ্ঞেস করেছেন!!’’ ভদ্রলোক তার পর থেকে আর রসগোল্লা, রসমালাইয়ের নাম, আকার, মিল অমিল কিছু নিয়েই প্রশ্ন করেন না।
আমাদের মিষ্টি প্রীতির জন্যই ওড়িয়া ভদ্রলোক ভুবনেশ্বর থেকে আসার সময় ছানাপোড়া নিয়ে আসতে ভুলে যান না। বলা ভাল, আমরা ভুলতে দিই না। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক দোকানে এই মিষ্টিটা পাওয়া যায়। এটি ছানার কেক বলে অনেক জায়গায় পরিচিত। ছানাপোড়ার বাইরের অংশের ওই কড়া এবং স্বল্প কুচমুচে ভাবটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।
শীতকালে দিল্লিতে আরেকটা মিষ্টি পাওয়া যায়। হিন্দিতে সকলে ‘গোঁদ কি লাড্ডু’ বলে। বাংলায় বললে হয় গঁদের লাড্ডু। এই লাড্ডুর মূল উপকরণ গঁদ। গঁদ মানে ছোটবেলা থেকে জানতাম, গাছের ছাল থেকে পাওয়া আঠা। লাড্ডুতে ব্যবহার করা গঁদ ভোজ্য আঠা। বাবলা জাতীয় গাছ থেকেই সংগ্রহ করা হয়। গুজরাত, রাজস্থানে এর ভালরকম চল আছে। এই গঁদের সঙ্গে নানারকম বাদাম সহযোগে এই মিষ্টি তৈরি হয়। চিনি তো লাগেই। দিল্লির দোকানে খেয়েছি প্যাড়া। দেওঘরের প্যাড়ার নাম ছোট থেকে শুনে আসছি। কিন্তু এই দোকানির কোথায় বাড়ি জানি না।
শীতকালে আমার কাহিল অবস্থা দেখে প্রতিবেশী পাঞ্জাবি দাদা বৌদি আমাকে একটা গুঁড়ো গুঁড়ো মিষ্টি খাওয়াত। ওরা বলে পাঞ্জিরি। এই মিষ্টি ওরা শুধু শীতকালেই খায়। নলেন গুড়ের মোয়া, রসগোল্লা, সন্দেশের মতো হয়তো মরসুমি মিষ্টি। পাঞ্জিরি অনেক রকম হয়। তবে প্রতিবেশী ওই পাঞ্জাবি বৌদি বাড়িতে সব শুকনো ফল, বাদাম, জোয়ান মিশিয়ে পাঞ্জিরি তৈরি করে। শীতে শরীর যাতে গরম থাকে সেই কারণে পাঞ্জাবি পরিবারে পাঞ্জিরি খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। ছট পুজোর সময়ে বিহার থেকে আসা সহকর্মী নিয়ে এসেছিলেন ঠেকুয়া। বেশ খেতে।
মিষ্টি তো হল। একটু ভিনদেশি নোনতার সন্ধানও দেওয়া যাক। কথায় আছে, শেষ পাতেই মিষ্টিমুখ হওয়া উচিত। খাওয়ার সময়ে না হয় মিষ্টিই শেষ পাতে খাওয়া যাবে। পড়ার সময়ে নোনতাই শেষে থাক। যে গুজরাতি সহকর্মী আমাদের মোহনথাল এনে খাইয়েছিলেন তিনিই এবার আমেদাবাদ থেকে দিল্লি আসার সময় গাঠিয়া, পাপড়ি এবং খাকরা নিয়ে এসেছিলেন। গাঠিয়া তো কলকাতায় পাওয়া যায়। আমরা যাকে চলতি কথায় কাঠি ভাজা বলি, সেটাই। পাপড়িও বেসনের তৈরি। তবে অনেক স্বাদের এবং গন্ধের পাওয়া যায়। কোনওটা মশলা দেওয়া তো কোনটা সাধারণ। খাকরা একটা অনবদ্য খাদ্য। একটা কুড়মুড়ে ফিনফিনে রুটি এবং পাঁপড়ের যুগলবন্দি হল খাকরা। নামটা শুনে আমার মা অবিশ্যি বলেছিল কী রকম যেন খ্যাংড়া কাঠির মতো নাম। কিন্তু খাকরার স্বাদ স্বর্গীয়। গুজরাতে স্ন্যাক্স হিসাবে এই খাকরা অসম্ভব জনপ্রিয়। আমার খাকরা প্রীতি দেখে প্যাটেলজি কথা দিয়েছেন, গুজরাত ভবনে নিয়ে গিয়ে ‘খাকরা আর জালেবি কে সাথ ব্রেকফাস্ট’ করাবেন। দেখা যাক, কবে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়!
আমার অনেক কান্নাকাটির ফলে সহকর্মী ওড়িয়া ভদ্রলোক পুরীর খাজা আনিয়েছিলেন। খাজাতেও নতুন বিস্ময়। এতদিন খাজা বলতে মিষ্টি খাজার কথাই জানতাম। খাজা-গজা সব মিষ্টি। এবারে খেলাম নোনতা খাজা। এই নোনতা খাজায় জিরে দেওয়া থাকে। দেখতে মিষ্টি খাজার মতো হলেও এতে যেহেতু রসের পাক থাকে না, তাই খুব সহজে ভেঙে যায়। ভঙ্গুর যাকে বলে আর কী! তবে স্বাদে কামাল!
দিল্লিতে যেমন দূষণ তেমনই হাড় কাঁপানো শীত। বিভিন্ন প্রদেশের মিষ্টির সাহায্যে ভিন্ রাজ্যের লোকেরা মন ভাল রাখছে। আর দিল্লির শীত কাটিয়ে চলেছে।
কভারের ছবি— মোহনথাল।
ছবি- লেখিকা
(সমাপ্ত)