রঘুরাজপুর।
অন্য সফর ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ওড়িশার পটচিত্রের গ্রাম রঘুরাজপুরে

তনয় শীল

যাত্রা শুরু হয়েছিল জগন্নাথদেব দর্শনে। কিন্তু হঠাৎ জানা তথ্যে অটো চাকা বেঁকে গেল শিল্পীদের এক গ্রামের দিকে। দেবদর্শনের আগে শিল্পী দর্শন। সেই গ্রামেও অবশ্য দেবদর্শন হয়েছিল। জগন্নাথদেবেরই দর্শন। একটু অন্য ভাবে। সে কথা বলতেই আজ ফিরে আসা।

বাড়িগুলো সব এমন সুন্দর করে ছবিকে সাজানো।

গত ১৯ নভেম্বর, ২০২১ সাল। সন্ধ্যে ৭টা ৫ মিনিটের ‘হাওড়া-পুরী’ এক্সপ্রেস। চেপে বসেছিলাম মাকে নিয়ে। রওনা দেওয়া পুরী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ট্রেন সফর দারুণ। নির্ধারিত সময়ের আগেই পুরী এক্সপ্রেস আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিল। ভোর ৪টা ৩০ মিনিট ছিল নির্ধারিত সময়। আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ভোর ৪টেয়। পুরী স্টেশনে যখন নামলাম তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটো ধরলাম। হোটেলে পৌঁছলাম যখন তখন ঘড়ির কাঁটা দেখাচ্ছে ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেই হল। তাতে চাঙ্গা হওয়া গেল।

পট দেখাচ্ছেন শিল্পী পরিবার।

সকাল ৮টা নাগাদ বেরোলাম জগন্নাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে। হোটেল থেকে বেরিয়ে অটো ধরতে হবে মন্দিরে গেলে। অটোচালকদাদার কাছে জানতে পারলাম পুরীর কাছেই এক অফবিট জায়গা রয়েছে। অফবিট বললাম বটে। অনেকেই হয়তো জানেন গ্রামটির কথা। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ পর্যটকের কাছে পুরী বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে জগন্নাথ মন্দির, স্বর্গদ্বার, সমুদ্র সৈকত, নন্দনকানন, ধবলগিরি, উদয়গিরি-খন্ডগিরি, চিল্কা হ্রদ, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির ভ্রমণের চিত্র। নতুন এক জায়গা সম্পর্কে শুনে মনে কৌতূহল জাগল। জায়গাটার নাম ‘রঘুরাজপুর’। এই গ্রাম পটশিল্পীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। শিল্প ও শিল্পীদের টানে বেরিয়ে পড়লাম। অটোচালক ৭০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে আমাদের নিয়ে চললেন রঘুরাজপুরের পথে। সেখান থেকে আমাদের ঘুরিয়ে এনে নামিয়ে দেবেন জগন্নাথ মন্দিরের কাছে।

নানা বিষয়ের পটের সমাহার।

রঘুরাজপুর ভার্গবী নদীর তীরে। এই নদীটি মহানদীর এক শাখা নদী। রঘুরাজপুর পুরী থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। ওড়িশার একটি প্রাচীন গ্রাম রঘুরাজপুর। এই নামের উৎপত্তি হয়েছে ‘রঘুরাজ’ অর্থাৎ ‘রাজা রঘু’ অর্থাৎ রামায়ণের রঘু বংশের রাজা রামচন্দ্রের নামানুসারে।

জগন্নাথদেবের পট।

‘রঘুরাজপুর’ উড়িষ্যার একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে ওঠে। আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতো এটিও নারকেল, আম, খেজুর গাছে ঘেরা। এটা তো গেল প্রকৃতি শিল্পীর বিশাল ল্যান্ডস্কেপ। আর রয়েছে গ্রামীণ শিল্পীদের শিল্পকর্ম। প্রত্যেকটি বাড়ির দেওয়াল নানা শিল্পকাজে ভরা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। এই গ্রামের প্রায় ১০০টি পরিবারের জীবিকা পট আঁকা। ২০০০ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ সংস্থা রঘুরাজপুর গ্রামকে ‘হেরিটেজ ভিলেজ’এর স্বীকৃতি দিয়েছে। গ্রামটির পরিচিতির পরিধি বোধহয় বেড়েছে।

কেটলি-সহ নানা পাত্রে আঁকা পটচিত্র।

একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। অটো গ্রামে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই এক যুবক বাইক চেপে আমাদের অটোর সামনে দিয়ে চলতে শুরু করলেন। তিনি ছিলেন একজন পটশিল্পী। গ্রামে ঢোকার মুখে অনেক শিল্পীই এ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন পর্যটকের আশায়। তিনি আমাদের পরম আতিথেয়তায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ তো বাড়ি নয় যেন এক একটি আর্ট গ্যালারি। তিনি পট্টচিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আমাদের বললেন। আর তার তৈরি অসাধারণ সব শিল্পকর্ম আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। শিল্পকর্মগুলোর বিভিন্নরকম দাম। এখান থেকেই তিনি বিক্রি করেন। একটা জিনিস ভাল লাগল। কেনার জন্য শিল্পী আমাদের কোনওরকম জোরাজুরি করেননি। নিজের শিল্পকর্ম আমাদের সামনে তুলে ধরেই তিনি খুশি। শুধু আমাদের বললেন, তাঁর শিল্পকর্মের ছবি ক্যামেরা বন্দি করে সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরতে। এ চাওয়ায় কিছু অন্যায় দেখি না। স্বাভাবিক। আমরাও তো ভাল ছবি তুললে, পরিচিতরা ভাল কিছু করলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিই।

ভাঁজ করা পট।

পটচিত্র নিয়ে তেমন কিছু জানতাম না। শিল্পী ধৈর্য ধরে ‘পট্টচিত্র’ বা পটচিত্র বোঝালেন। পট্টচিত্র কথার আক্ষরিক অর্থ ‘কাপড়ের উপর ছবি’। ‘পট্ট’ অর্থাৎ ‘কাপড়’। আর ‘চিত্র’ অর্থাৎ ছবি। বিভিন্ন মাপের নরম কাপড়ের টুকরো ভাল ভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিয়ে তার উপরে আঁকা হয়। তেঁতুল বীজ গুঁড়িয়ে গরম জলে ফুটিয়ে এক বিশেষ ধরনের আঠা তৈরি করা হয়। সেই আঠা দিয়ে কাপড়ের টুকরো জোড়া হয়। এই কাপড়ের টুকরোকে তখন বলা হয় ‘পট্ট’। তার পর সেগুলো ভাল ভাবে পালিশ করে রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন চিত্র।

দৃষ্টিনন্দন।

রংগুলো শিল্পীরা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি করেন। সাদা, হলুদ, লাল, সবুজ, কালো রং তৈরি করা হয়। সাদা রঙের জন্য শাঁখের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়। হলুদের জন্য হরিতাল। এটি এক ধরনের পাথর। ইঁট ও টালির টুকরো গুঁড়িয়ে হয় লাল রং। সবুজ রং মেলে বিভিন্ন ধরনের সবুজ পাতা থেকে। আগুনের ভুষো কালি থেকে কালো রং। নারকেল মালার মধ্যে কয়েতবেল গাছের আঠা ও জলের সঙ্গে এই রঙ মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে তা দিয়ে কাপড়ের উপর আঁকা হয়। পশ্চিমবঙ্গে পিংলার পটচিত্রের নাম শুনেছি। সেখানেও নাকি এরকম প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়।

পটশিল্পীদের সৃষ্টি।

কাপড় ছাড়াও তালপাতা, কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল, কাচের বোতল, কেটলি ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমের উপর শিল্পীরা অদ্ভুত সুন্দর শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলেন। আঁকার প্রধান বিষয় জগন্নাথদেব। এ ছাড়া রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র বা কাহিনিও পট্টচিত্রীদের ছবির বিষয় হয়ে ওঠে। শিল্পীরা অনেকেই জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত। কেউ কেউ পেয়েছেন রাজ্য সরকারের পুরস্কারও। এক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীর ছবি দেখলাম। ছবিতে শিল্পীর পরিচয়ও দেওয়া ছিল। তাঁর নাম ‘গোপাল মহারানা, মাস্টার ক্রাফটস ম্যান, ওড়িশা ললিত কলা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেড-১৯৭৯’।

পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীর শিল্পকর্ম।

অসাধারণ শিল্পকর্ম ও শিল্পীদের সঙ্গে দু’ঘণ্টা কেটে গেল। কিছু শিল্পকর্ম কিনে নিয়ে অটো চেপে রওনা দিলাম জগন্নাথদেব দর্শনে। কথা মতো অটোচালক আমাদের মন্দিরের কাছে নামিয়ে দিলেন।

কভারের ছবি— রঘুরাজপুর গ্রামে ঢোকার পথে।

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *