জনাই।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মনোহরার পাশে জনাইয়ের আরও তিন

দীপক দাস

মিষ্টি-নামে অনেক কিছু এসে যায়। এ হল মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে ঘোরাঘুরির কিঞ্চিৎ প্রত্যয়। না হলে একটা মিষ্টির গোঁফ কামাতে ৭-৮ বছর লাগে! তা-ও গুপো আর গুঁফোর আধার কার্ডের তথ্যে ভুল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। গুপো আর গুঁফো একই দেহে ভিন্ন নাম? নাকি কুল আলাদা? সঠিক জেনে উঠতে পেরেছি, এমন দৃঢ় দাবি করার আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি না। এসব দেখেশুনেই দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা বলেন, ‘মিষ্টিরিয়াস’। দীপ্তেন্দুবিকাশ খাদ্যরসিক ও খাবার খোঁজাড়ু।

কেন মিষ্টি নামে কিছু এসে যায়? সে রহস্যের সূত্র আকর্ষণের আগে আরেকটু ঢুঁ মেরে নেওয়া যাক মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে। জনাই অবশ্য আনাচকানাচ নয়। এ জনপদ মিষ্টিমহলের বিশাল প্রাঙ্গণ। যে প্রাঙ্গণে শামিয়ানা টাঙিয়ে মিষ্টি মহোৎসব করা যায়। হবে না কেন? এখানেই তো আবাস ছিল বাঙালির রসনা তৃপ্তির অন্যতম রসিক ভীম নাগের। আমার জনাই যাত্রা এ নিয়ে দ্বিতীয়বার। প্রথমবার এসেছিলাম দল বেঁধে। সে ছিল শুধু মনোহরা সফর। কিন্তু যত দিন গিয়েছে জানতে পেরেছি, জনাই শুধু মনোহরার একার নয়। মনোহরাকে জনাইয়ের মিষ্টি-জমিদারির বড় তরফ বলা যেতে পারে। দাবিদার আরও রয়েছে। চার আনা, আট আনার শরিক। সেই শরিকদের স্বাদের খোঁজে দ্বিতীয় যাত্রা। এবার একাকী। সঙ্গীরা সকলেই ব্যস্ত যে বড়!

ভাজা চলছে বড় বোঁদে।

জনাইয়ে মনোহরা ছাড়ার মেলে আরও তিনটি মিষ্টি। তিনজনেই সুস্বাদু। তবে দু’জন বাইরে বেশ নাম করেছে। একজন নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায়। প্রথম দু’জন হল বড় বোঁদে আর নিখুঁতি। তৃতীয়জন গুটকে। শুরুটা করলাম কমল ময়রার দোকান থেকেই। মনোহরার অভিজাত দোকান। যদিও এখন জনাইয়ের মনোহরার সব আলো টেনে নিয়েছে অন্য একটি দোকান। এক সিরিয়ালের দৌলতে। দোকানের সামনে বড় হোর্ডিংয়ে তার সগর্ব ঘোষণা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু মনোহরা নিয়ে সিরিয়ালে কমল ময়রার দোকান বাদ? কারণ তাঁর দোকান ঝাঁ চকচকে নয়। কমল ময়রা ও তাঁর ছেলেরা দোকানের বিজ্ঞাপনে বিশ্বাসী নন। গুণমানে বিশ্বাসী। তাতেই খদ্দের আসেন। সে প্রমাণ আগেরবারেও পেয়েছি। এবারেও পেলাম। লোকজন আসছেন। মিষ্টি কিনছেন। এদিকে সিরিয়ালের জন্য দরকার বড় দোকান। রকমারি মিষ্টি। কমল ময়রার দোকানে আইটেম কম। মনোহরাটা তাঁরা মন দিয়ে করেন। ফলে…

বড় বোঁদে তৈরি।

কমলবাবুর ছেলে নবকুমারের সঙ্গে আগেরবার দেখা হয়েছিল। এবার দোকান চালাচ্ছিলেন তাঁর ভাই। দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন বয়স্ক। তাঁদের কাছে আসার অভিপ্রায় জানানো হল। আড্ডাধারীদের একজন জ্যোতিন্দ্রনাথ দাস। তিনি দেখিয়ে দিলেন কোন দোকানের বড় বোঁদে ভাল। কোন দোকানে মিলবে স্বাদু গুটকে আর নিখুঁতি। কমলবাবুর দোকানে এই মিষ্টিগুলো নেই।

বড় বোঁদের দোকানটির নাম অমিয়া মিষ্টান্ন ভান্ডার। কমল ময়রার দোকানের উল্টোদিকের রাস্তায় ঢুকেই ডানহাতি। অমিয়ায় গিয়ে দেখি, তখন বড় বোঁদে ভাজা চলছে। ভাজছেন দোকানের কর্মী সূর্য ঘোষ। দোকান সামলাচ্ছিলেন জয়দেব সাউ ও তাঁর ছেলে সুদীপ। অমিয়া এলাকায় পুরনো মিষ্টির দোকান। ১৯৫৬ সালে চালু হয়েছিল। দোকানে মনোহরা, রসগোল্লা-সহ নানা মিষ্টি মেলে। তেলেভাজাও। শুধু গুটকে পাওয়া যায় না। না যাক। খবর অনুযায়ী, এঁদের বড় বোঁদে ভাল। সুতরাং বোঁদেয় বুঁদ হওয়ার চেষ্টা।

অমিয়া মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুদীপ।

মিষ্টির স্বাদ গ্রহণে আমাদের আগ্রহ থাকেই। তবে আমাকে বেশি টানে মিষ্টির ইতিহাস, স্রষ্টা আর নামকরণের উৎস। বোঁদে, দরবেশ থাকতেও বড় বোঁদের দিকে কেন ঝুঁকলেন জনাইয়ের ময়রারা? জয়দেববাবু দার্শনিক উক্তি করলেন, ‘‘হয়তো ময়রার খেয়াল। এখানকার কেউ হয়তো নতুন ধরনের ফুলুরি করতে চেয়েছিলেন। সেটাই রসে চুবিয়ে বড় বোঁদে হয়ে গেল।’’ ময়রার খেয়ালে অনেক রকম মিষ্টি তৈরি হয়েছে। মিষ্টির ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু বড় বোঁদের খেয়ালিটি কে? জানা গেল না। ফিরলাম পাক প্রণালীতে। সেটা সহজলভ্য। চোখের সামনে কিছুটা তো দেখতেও পাচ্ছি।

বড় বোঁদের পাক প্রণালী জানালেন সুদীপ। মটর ডালের বেসন লাগে। এই ডালের বেসন ছাড়া বড় বোঁদে তৈরি হয় না। বেসন ভাল করে অন্তত ১৫ মিনিট ধরে ফেটাতে হয়। ভাল করে ফেটালে হলদে বেসন ধীরে ধীরে ফিকে হবে। যত ফেটানো হবে ততই হালকা হতে থথাকবে বেসন গোলা। তেলে দিলে তবেই ভাসবে বোঁদের বড় বুন্দ। বুন্দ থেকেই তো বুন্দিয়া। বড় ফুটোর ছাঁনচা ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের উপর ধরে ধীরে ধীরে ফেটানো বেসন ঢালতে হবে। তাহলেই তেলে পড়তে থাকবে বোঁদের ঝাঁক। এই বোঁদে ভাজতে হয় দু’বার। প্রথমবার হালকা করে ভাজা। তার পর আবার একবার। রংটা যতক্ষণ না হলদে থেকে খয়েরি মতো হয়। ভাজা হয়ে গেলে ঠান্ডা করা হয় বোঁদেগুলো। ঠান্ডা হলে পান্তুয়ার রসে চুবিয়ে মিনিট ৪৫ ধরে ফোটাতে হবে। ঘন হবে রসটা। বোঁদের গায়ে লেগে থাকা রসটা চটচটে হয়ে যাবে। এবার রস থেকে তুলে শুকনো কড়াইয়ে ফেলে বোঁদেগুলো ঘষতে হবে। ঘষলে বড় বোঁদের গায়ে চিনির একটা আস্তরণ জমে যায়।

রাধাকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের গুটকে।

দেখতে কেমন বড় বোঁদে? অনেকটা শঙ্কুর মতো। মনে হয় সবচেয়ে ভাল উপমা বুলেটের মতো। যদিও বুলেট সিনেমা বা ছবি ছাড়া দেখিনি। কেজিতে বিক্রি হয়। আমি ১৮০ টাকা কিলো কিনেছিলাম। সুদীপ জানালেন, প্রতিদিনই তৈরি হয় বড় বোঁদে। তবে বিজয়া দশমীর দিনে প্রচুর বিক্রি হয়। ফ্রিজ ছাড়াই দিন দশেক রাখা যায়। খেতে কেমন? চিনির স্তর থাকায় বড় বোঁদের উপরটা খড়খড়ে। কামড় দিলে ভিতরের নরম অংশের স্বাদ মেলে। ভিতরের অংশ রসস্থ। স্বাদে শুকনো বোঁদে যেমন হয়। দরবেশের মতোই। খেতে ভাল।

গুটকে আর নিখুঁতির খোঁজে যেতে হল রাধাকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে। অমিয়ার ঠিক উল্টোদিকে। এটাও পুরনো দোকান। চার পুরুষের ব্যবসা। লোকে ছকুদার মিষ্টির দোকান নামে চেনে। কথা হল তাঁর ছেলের সঙ্গে। নিজের নামটা কিছুতেই বলতে চাইলেন না তিনি। তাঁর সাফ কথা, ‘‘এ দোকান বাবা দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর নাম না করে নিজের নাম বলা ঠিক হবে না।’’ দোকানে ছিলেন তাঁর ছেলে, অর্থাৎ ছকুদার নাতিও। নিজের ছেলের নামটা কিন্তু বললেন, আকাশ।

জনাইয়ের নিখুঁতি।

যথারীতি শিকড় খুঁজে পাওয়া গেল না গুটকে আর নিখুঁতির। নামকরণের উৎসও। তবে মিষ্টি দু’টোর বংশ পরিচয় বোঝা গেল। পাক প্রণালী আর উপকরণ থেকে। গুটকে আসলে সন্দেশ গোত্রীয়। উপকরণ ছানা, চিনি, গুড়। বাকিটা পাক নির্ভর। তবে এটি সাধারণ সন্দেশের মতো চ্যাপ্টা নয়। গোলাকার। আকারে ছোট। সে কারণেই হয়তো গুটকে নাম। মিষ্টি গোল হলেও গা ক্ষীরের চাদর জড়ানো মিষ্টির মতো মসৃণ নয়। দানা দানা। এই দানা দানা ভাবটা আবার কাটোয়া লোকালের কাঁচাগোল্লার সঙ্গে মেলে। তবে গুটকের দানা কাঁচাগোল্লার দানার মতো পেলব নয়। গুটকে খেতে অতি সুস্বাদু। মুখে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। জনাইয়ের গুটকের সন্ধান দীপ্তেন্দুবিকাশই দিয়েছিলেন।

নিখুঁতি ভাজা এবং শুকনো মিষ্টি। উপকরণ লাগে ছানা, ময়দা, খাবার সোডা, অল্প চিনি। এই উপকরণগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে মাখতে হয়। ভাল করে মাখার পরে কাটা হয় গোছ করে। তার পর পাকিয়ে লম্বা করতে হয়। এর পর ভাজার পালা। ভাজতে হয় হালকা আঁচে, দম দিয়ে। দম দিয়ে মানে সময় নিয়ে। গরম রস করাই থাকে। ভাজাগুলো রসে ফেলা হয়। তার পর চামচে একটা একটা করে তুলে রাখতে হয় ট্রেতে। তুলে রাখলে ধীরে ধীরে নিখুঁতির গায়ে চিনির শুকনো আস্তরণ জমা হয়। ভাল ভাজা আর চিনির স্তরের জন্য নিখুঁতির উপরের অংশটি মসৃণ নয়। তবে ভিতরটা বেশ নরম ও স্বাদু।

শ্রীরামপুরের গুটকে।

এবার মিষ্টি-নাম সংকীর্তন। এক নামে একাধিক মিষ্টি রয়েছে। যারা আকারে প্রকারে এবং গোত্রে আলাদা। ফলে মিষ্টিকে যা খুশি নামে ডাকলে মিষ্টিপ্রেমীদের মনে সংশয় জাগে। এই যেমন, গুটকে। কেউ ‘আমি গুটকে খেয়েছি’ দাবি করলে আমার প্রশ্ন জাগবেই, ‘‘কোন গুটকে? শ্রীরামপুরের না জনাইয়ে?’’ এমন প্রশ্নে মিষ্টি রসিকটি রেগে যেতে পারেন। আমার কিছু করার নেই। কারণ দু’জায়গার গুটকের যে কোনও মিল নেই। যদিও উপকরণ এক। তবে পাক ও স্বাদ আলাদা। শ্রীরামপুরের গুটকে বিখ্যাত মহেশচন্দ্র দত্তের দোকানে। এই দোকানের গুটকে চ্যাপ্টা এবং দু’টো সন্দেশের সমাহার। অর্থাৎ জোড়া। জনাইয়ের গুটকে গোলাকার এবং একক। শ্রীরামপুর কড়াপাকের। জনাই নরমের দিকে।

আবার আমরা নিখুঁতি বলতে সাধারণত সীতাভোগের উপরে জেগে থাকা খেজুরের মতো ছোট ছোট ডিমালো মিষ্টির কথা জানি। কেউ কেউ বটফলও বলে থাকেন। নিখুঁতি কোথাও কোথাও আলাদা ভাবেও বিক্রি হয়। যেমন এই হুগলি জেলারই জাঙ্গিপাড়ায় হাটুইদের দোকানে। কিন্তু জনাইয়ের নিখুঁতি লম্বা। ল্যাংচার মতো লম্বা। যদিও ল্যাংচার সঙ্গে তফাৎ আছে। ল্যাংচা মোটা। নিখুঁতি সরু, আঙুলের মতো। ল্যাংচা হয় পাতলা রসে। নিখুঁতি মোটা রসে। ল্যাংচা ভিজে, নিখুঁতি শুকনো। তাহলে আলাদা মিষ্টির একই নামে ‘বুঝভুম্বুল’ (ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী কৃত শব্দ) ঘটবে কিনা? মিষ্টি-নামে কিছু এসে যাবে কিনা!

জাঙ্গিপাড়ার হাটুইদের দোকানের নিখুঁতি।

জনাইয়ের মিষ্টির একটা বৈশিষ্ট রয়েছে। এখানকার বহু মিষ্টিই ফ্রিজ ছাড়া কয়েকদিন রাখা যায়। এই তিনটি মিষ্টি তো আছেই, মনোহরাও। মনোহরার চিনির কোটিং তো বেশিদিন রাখার জন্যই। বাড়ি ফেরার পথ ধরেছিলাম। ইতিহাস ও স্রষ্টার নাম জানতে পারায় মনটা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। কী মনে হল আবার কমল ময়রার দোকানে গেলাম। জ্যোতিন্দ্রবাবুরা তখনও ছিলেন। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কেমন কাজ হল?’’ বললাম। সেই সঙ্গেই জানালাম, মিষ্টিগুলো কে তৈরি করেছিলেন জানা গেল না। উনি বললেন, ‘‘অন্যগুলো কে তৈরি করেছেন জানি না। তবে বড় বোঁদে তৈরি করেছিলেন মানিকলাল দাসের ছোট ছেলে বীরেন্দ্রনাথ দাস। কী মনে হওয়ায় তেলে বেসন একটু লম্বাটে করেই ছেড়েছিলেন। তার পর রসে ডুবিয়ে দেখেন খেতে ভালই। পরে তিনি কলকাতা থেকে বড় ফুটোর পাওনা তৈরি করে আনেন।’’ পাওনা কী? আমাকে হাঁ করে থাকতে দেখে জ্যোতিন্দ্রবাবু বললেন, ‘‘পাওনা হল ছাঁনচা। যার উপর দিয়ে তেলে বেসন ফেলা হয়।’’ বড় বোঁদের বয়স ৪০-৫০ বছরের বেশি হবে না বললেন তিনি। এ কাহিনি যাচাইয়ের সুযোগ হয়নি। তবে পাওনার প্রযুক্তিগত বিষয়টার জন্য বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হল।

মনোহরা
চিনির কোটিং ছাড়া মনোহরা। জনাই।

ও হ্যাঁ, একটা কথা। কমল ময়রার দোকানের মনোহরার উপরে এখন আর চিনির কোটিং দেওয়া হয় না। লকডাউনে কাজের লোকের অভাবের জন্য এই পরিবর্তন। তাতে অবশ্য স্বাদের কমতি হয়নি। চিনির আস্তরণটা তো শুধু মনোহরাকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখার জন্য। স্বাদে তার কোনও প্রভাব নেই। আস্তরণ না থাকায় সুবিধেই কিছুটা, বলছিলেন কমল ময়রার ছোট ছেলে। সরাসরি জিভ মনোহরার স্বাদ পায়।

কভারের ছবি— বড় বোঁদে, গুটকে, নিখুঁতি।

ছবি— লেখক ও শুভ বৈদ্য

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *