ট্রেন থেকে তোলা
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

রঙ্কিণীদেবীর কিংবদন্তী আর এক স্টেশনের গল্প

দীপক দাস

সেবারের সেই ট্রেন সফরের কথা মনে পড়লে দু’টো ছবি ভেসে ওঠে। একটা ছবিতে শুধু সুন্দর…সুন্দর আর সুন্দর। ভূত দেখতে যাওয়ার রোমাঞ্চটা কবেই যেন চাপা দিয়েছে প্রকৃতি। অনন্ত, অপরূপ প্রকৃতি। আরেকটা ছবিতে একটা ফিচেল হাসি। শয়তানির হাসিও বলা যায়। অল্প প্রসারিত হওয়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরনো কথাগুলোও মনে পড়ে, ‘বাগালিয়া, কী বাগালিয়া?’ বাগিয়ে নেওয়ার ভরপুর মরসুমে ওই হাসি আর উক্তির কতরকম মানে যে হতে পারে!

বাগালিয়া স্টেশনের কথা কেন হঠাৎ মনে পড়ল বলি। ঘরে আটকা পড়েছিলাম বহুদিন। ঘোরাঘুরি তেমন হয়নি। মনটা অনেকদিন ট্রেন ট্রেন করছিল। প্রত্যেক ট্রেন সফরই আমাদের কাছে আলাদা আলাদা কারণে স্মরণীয়। শুধু দু’টো সফর চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রকৃতির কারণে। সেগুলোর একটা হল রামপুরহাট থেকে দুমকা পর্যন্ত সফর। যে সফর শুধুমাত্র ট্রেনে চাপার জন্যই হয়েছিল। এই রুটের দু’পাশের সৌন্দর্য অসাধারণ। গাছ, খোয়াই, দূরে পাহাড়, চাষ জমি, টুকরো টুকরো পল্লির চলমান দর্শন মনে গেঁথে গিয়েছে। গাঁথাই থাকবে চিরকাল। কোনও এক নিভৃত কষ্টের সময়ে এই সফরের স্মৃতি স্নায়ুর সাড় ফিরিয়ে আনে।

ট্রেন থেকে দেখা। রামপুরহাট-দুমকা সফর।

অন্য সফরটি ভূত দেখতে যাওয়ার সফর। আমরা তিনজনে ‘ঘোস্ট হান্টার’ হয়ে বেরিয়েছিলাম সেবার। ইন্দ্র, গার্ডবাবু শুভ আর আমি। বেগুনকোদর তখন ইন্টারনেট কাঁপাচ্ছে (একটি ভূতুড়ে স্টেশন ও তিন শঙ্করের কাহিনি)। এই স্টেশনে নাকি ভূত দেখা যায়। তার সঙ্গে মোলাকাত করতেই বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে। ভূতের সঙ্গে দেখা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না। পরে এই সফর আর আমাদের কাছে ভূত খোঁজার রোমাঞ্চকর সফর থাকেনি। হয়ে উঠেছিল প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর এক স্মৃতি। বেগুনকোদর স্টেশন এলাকা অতি সুন্দর জায়গা। স্টেশন থেকে পাহাড় দেখা যায়। স্টেশন আর পাহাড়ের মাঝের সমতল সবুজে সবুজ।

বেগুনকোদর যেতে পুরুলিয়া থেকে আমরা খড়্গপুর-হাতিয়া প্যাসেঞ্জারে চেপেছিলাম। এই রুটের প্রতিটা স্টেশন সুন্দর। বেগুনকোদরের আগের স্টেশন কোটশিলা। অন্যরকম রূপ। মুরগুমা হয়ে ফেরার সময়ে ঝালদা থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম। এই স্টেশন থেকেও পাহাড় দেখা যায়। পাহাড় দেখা যায় এমন স্টেশন আমার খুব ভাল লাগে। ফলে সেই ভাললাগাটাই রয়ে গিয়েছে। ভূত মুছে গিয়েছে। আমাদের সফরের পরে ইন্টারনেট থেকেও বেগুনকোদরের ভূত তাড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

বেগুনকোদর স্টেশন থেকে দেখা।

সুন্দর সব স্টেশনের মাঝে বাগালিয়া কোথা থেকে এল? এই স্টেশন তো হাওড়া-পুরুলিয়া রুটে পড়ে। বেগুনকোদরের দিকে নয়। বাগালিয়া এল আমাদের স্বভাবের কারণে। অনামা, অন্যরকম স্টেশনের নামগুলো আমরা খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। নামগুলো নথিভুক্ত করা হয়। এমন অভ্যাস থেকেই তো অনামা এক স্টেশনকে বিখ্যাত হয়ে উঠতে দেখলাম। ঠিক স্টেশন নয়। স্টেশনের নামের জায়গাটা। স্টেশনের নাম হরিণশিং বা হরিণশিঙা। রামপুরহাট-দুমকা লাইনের স্টেশন। তখন পাহাড় কেটে লাইনটা নতুন চালু হয়েছিল। আর শুভ বৈদ্য, বাবলা, ইন্দ্র, দীপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তখনও অনেক স্টেশনের নাম ঠিক করা হয়নি। তেমনই এক স্টেশন দেখেছিলাম। নামফলকহীন। পরে গার্ডবাবুই খবর দিয়েছিল, ওই স্টেশনের নাম হয়েছে হরিণশিঙা। ডেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি চালু বিতর্কে বারবার উঠে আসছে হরিণশিঙার নাম।

বেগুনকোদরের আগে।
কোটশিলা স্টেশন। বেগুনকোদর এই স্টেশনের পরেই।

বাগালিয়া নামটাও আমাদের নজর কেড়েছিল। তা নিয়েই গার্ডবাবুর সারা রাস্তা ধরে ওই মজার উক্তি, ‘বাগালিয়া, কী বাগালিয়া?’ কী বাগালিয়া বা কে বাগালিয়া জানতে পারিনি। তবে স্টেশনের এমন নাম কেন তা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছি। এই নামের সঙ্গে একটা কিংবদন্তী জড়িয়ে আছে। লোকবিশ্বাস বলাই ভাল। এর শিকড় পেয়েছিলাম ঝাড়গ্রামে। পেতে সাহায্য করেছিল সুব্রতকুমার মুখোপাধ্যায় ও সুশীলকুমার বর্মনের লেখা ‘ঝাড়গ্রাম জেলা প্রত্ন পরিক্রমা’ বইটি। গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে নানা লৌকিক দেব-দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়। বাগালিয়া নামের সঙ্গে জুড়ে আছেন দুই লৌকিক দেব-দেবী।

খড়্গপুর-হাতিয়া রুট।
বেগুনকোদর স্টেশন।

রঙ্কিণীদেবীর সন্ধান মেলে ঝাড়গ্রামে এবং ঝাড়খণ্ডে। যাঁরা ঘাটশিলা বেড়াতে যান তাঁরা দু’টো রঙ্কিণী দেবীর মন্দির দেখেও থাকতে পারেন। একটা ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গৌরীকুঞ্জের কাছেই। আরেকটা গালুডি থেকে যাদুগোড়া যাওয়ার পথে পরে। এই রঙ্কিণীদেবীকে নিয়ে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন ‘রঙ্কিণীদেবীর খড়্গ’ গল্পটি। দেবী সম্পর্কে ঝাড়গ্রামে প্রচলিত গল্পটি এরকম, নরমাংস খেতেন তিনি। তাঁর কাছে প্রতিদিন একজন করে গ্রামবাসীকে পাঠাতে হত। একবার পালা পড়ল এক ধনী কৃষক পরিবারের। পরিবারটি চিন্তিত কাকে পাঠানো যায়। ওই পরিবারে এক বাগাল থাকত। বাগাল মানে যে গৃহস্থের গবাদি পশুর দায়িত্বে থাকে। বাগাল জানাল, সে-ই যাবে দেবীর কাছে।

বেগুনকোদর স্টেশন। অপরূপ তার রূপ।

বাগাল চালাকি করল। সে কাপড়ে লোহার কড়াই বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে খাওয়ার আগে বাগাল দেবীকে ভাজা কড়াই খাওয়ার ‘অফার’ করে। দেবীকে প্রলুব্ধ করতে নিজে কাপড়ে লুকিয়ে রাখা আসল কড়াই ভাজা খেয়ে দেখায়। দেবী খেতে চাইলে তাকে কৌশলে লোহার কড়াই দেয়। তা খেয়ে দেবীর দাঁত পড়ে যায়। ভীষণ যন্ত্রণা। তখন বাগাল আবার পরামর্শ দেয়, একটু দই খেয়ে দেখতে তাহলে ভাঙা দাঁতের যন্ত্রণার উপশম হবে। কিন্তু সে দইয়ের বদলে নিয়ে গিয়েছিল চুন। তা খেয়ে দেবীর তখন মরমর দশা। যন্ত্রণায় ছুটে পালাতে লাগল। আর বাগাল তাড়া করল লাঠি হাতে। তার পর গ্রামবাসীরা মিলে তাকে ধলভূমে পৌঁছে দিল। সেখানে এক ধোপা কাপড় কাচছিল। তার পাটার নীচে লুকিয়ে পড়েছিল দেবী। গ্রামবাসী আর বাগালের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ায় দেবী সেই ধোপাকে রাজা করে দিলেন। তিনি হলেন ধবলদেব। তিনি ধলভূমগড়ে রঙ্কিণীদেবীর পুজো চালু করলেন।

বাগালিয়া
বাগালিয়া স্টেশন

পুরুলিয়া জেলায় এই জনশ্রুতির একটি অন্য সংস্করণ পাওয়া যায়। এই গল্পেও বাগাল আছে। রঙ্কিণীকে তাড়িয়ে দেওয়া সেই বাগাল নাকি এক জায়গায় গিয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাসীরা সেই পাথরকে বাগালঠাকুর হিসেবে পুজো করতে আরম্ভ করে। সুব্রতবাবুরা বলছেন, বাগালিয়া স্টেশনের কাছে বাগালঠাকুরের থান আছে। আমার ধারণা, বাগাল ঠাকুর থেকেই বাগালিয়া নাম এলাকার। স্টেশনেরও।

বাগালিয়া স্টেশনটি দেখেছিলাম চলন্ত ট্রেন থেকে। রূপসী বাংলা ওই স্টেশনে থামে না। ফলে ছবি ভাল তুলতে পারিনি। বাগালঠাকুরের থান দেখাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু গার্ডবাবুর সেই ফিচেল জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। ‘কী বাগালিয়া?’ এক রাখাল দেব মহিমা বাগালিয়া। দেবতার জন্ম হুয়া।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ, সৌগত পাল, শুভ বৈদ্য, দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *