ইন্দ্রজিৎ সাউ
আমি বাচ্চা বলে আমার কথা তো শুনতেই চাইছ না। একরাশ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে কথাগুলো আমার দিকে ছুড়ে দিল বাইচুং। আমরা এখন খয়রাবেড়া ড্যামের সামনে দাঁড়িয়ে। সময় বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি। এখানে থাকার জায়গা সেরকম কিছু নেই। ড্যামের পাশেই লোকাল অথরিটির একটা ব্যবস্থা আছে। বেশ আলিশান। যেখানে মাথা পিছু ভাড়া দৈনিক পাঁচ হাজার। এখন আমাদের ফিরে যেতে হবে অযোধ্যা পাহাড়ে। রাতে থাকার জন্য। আর এখানেই আমাদের লিটল বয়ের ভয়।
ভরতপুর পটশিল্পীদের গ্রাম ছাড়ার পর আমরা ছাতনা এসে লুচি, চপ সহযোগে সকালের মতো উদরপূর্তি করে নিয়েছিলাম। তার পর পরের গন্তব্য খয়রাবেড়ার দিকে রওনা দিয়েছি। সময় সকাল ১১টা। পথে দ্বারকেশ্বর নদ-সহ বিভিন্ন জায়গার সবুজ সুন্দর প্রকৃতি দেখতে দেখতে চলেছি। নদের অবস্থা অবশ্য খারাপ। তার কোনও ঈশ্বরত্বই বজায় নেই। শুধু চড়া আর চড়া। নদের স্রোতধারার মাঝেও চড়া। তবে জল একেবারে কাকচক্ষু। টলটল করছে।
পথে বার কয়েক দাঁড়িয়েছি। নানা কাজে। যার মধ্যে আমার প্রধান কাজ ছিল খাওয়া। একবার দিব্যেন্দুর বাইকের চাকার কিছু মেরামতির জন্য। শেষ পর্যন্ত যখন আমরা অযোধ্যা পৌঁছলাম তখন ৪টের বেশি কিছু বাজে। অযোধ্যা ঢোকার শুরুতেই আমরা ফটোশেসনের জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। ছবি তোলার মধ্যেই প্রথমে ঠিক হয়েছিল, এতটা যখন দেরি হয়ে গেছে আজ আর আমরা খয়রাবেরা যাব না। কিন্তু গুগল ম্যাপে দুরত্ব দেখে আমার মনে হল, আজ ওখানে গিয়ে আবার অনায়াসে ফিরে আসতে পারি আমরা। সেই মতোই বাইক ছোটানো। একসময় পৌঁছে গেলাম খয়রাবেরা। এটি অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। খুব ছোট একটা ড্যাম। তবে আশপাশটা খুব সুন্দর। একদিকে খাড়াই অযোধ্যা আর একদিকে জঙ্গল। সঙ্গে নিজস্ব ছোট গাড়ি থাকলে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে আসা যায়। কারণ বড় গাড়ি যাওয়ার কোনও চওড়া রাস্তা নেই।
এবার ফেরার পালা। আর এখানেই বাইচুংয়ের রাগ। কারণ আমরা যখন খয়রাবেড়া ছাড়ছি তখন ৫টার বেশি কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। যদি অন্ধকার হয়ে যায়? আমাদের আসতে হবে অযোধ্যা পাহাড়ে। এবং ওখানেই আমরা আজ থাকব। ছেলের ফেসবুকে এদিকে ‘হ্যাজট্যাগ এক্সপ্লোরার’এর ছড়াছড়ি। আর এটুকুতেই থরহরি কম্প। ওর রাতে গাড়ি চালাতে সমস্যা হয়। তার উপরে অচেনা পাহাড়ি রাস্তা। আমাদের সকলেরই এটা প্রথম পাহাড়ি পথে বাইক চালানো। তাই রাতের ভয় বাইচুংয়ের।
যাই হোক সন্ধ্যে ৬টার কিছু পরেই আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের চুড়োয় এসে পৌঁছলাম। খুঁজে পেতে একটা হোম স্টে মিলল। ঘরে ঢুকে একটু বিশ্রাম। স্নানটান করে তাজা হয়ে আমি আর দিব্যেন্দু বেরলাম। দেশি মুরগির খোঁজে। এসব জায়গায় এলে দেশি মুরগি ছাড়া অন্যদিকে আমি তাকাই না। এ সুনাম আবার বহুদিনে। দেখা আগেই ছিল। ফেরার সময়ই রাস্তার পাশে বিক্রি হতে দেখে ছিলাম। দোকানে গিয়ে শুরু হল আমার বায়না, আমাদের ছাল সমেত মুরগি কেটে দিতে হবে। দোকানদার তাতেই রাজি। গরম জল করে এনে পরিষ্কার করে কেটে দিল। আমরা হোম স্টেতে রান্না করতে দিয়ে রুমে চলে গেলাম।
তিন জনে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙল হোটেলের ছেলেটির ডাকাডাকিতে। খাওয়ার জন্য ডাকছে। আমাদের দেশি মুরগি অপেক্ষা করছে। গল্প করতে করতে খেতে খেতে কিলো দেড়েক মুরগি আর খান বারো রুটি শেষ। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ হলেও আমাদের সমতলে সে ভাবে ঠান্ডা মালুম হয়নি। কিন্তু এখানে আয়েশ করার মতন ঠান্ডা। এমন গুরুভোজনের পরে চাদরমুড়ি দেওয়া জরুরি। ফলে দ্রুত ঘুম। পরদিন সকালে পুরো অযোধ্যা ঘুরে দেখব।
খুব সকালে উঠে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। আগের দিন রাতে আমরা হোম স্টেতে যে ছেলেটি ছিল তার সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম আমাদের ব্যাগগুলো যাতে হোম স্টেতে রেখে ঘুরতে যেতে পারি। সেই মতো ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম। এর আগেও আমি অযোধ্যা পাহাড় ঘুরেছি। প্রকৃতি তখনও নয়নাভিরাম ছিল এখনও আছে। শুধু মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে যেতে হয়। কিন্তু তখন রাস্তা এত ভাল ছিল না।
আমরা প্রথমেই দেখলাম পাখি পাহাড়। একটি বিশাল পাথরের চাতাল। তার গায়ে কারা সব আলপনা দিয়ে ছবি এঁকে গিয়েছে। তার পর গেলাম টুরগা জলপ্রপাত হয়ে টুরগা ড্যাম। এই ড্যামে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আছে। টুরগা ড্যাম থেকে গেলাম লহরিয়া ড্যাম। এখানে একটি শিবমন্দির আছে। যে কারণে সব সময় মেলার মতো পরিবেশ। প্রচুর দোকানপাট। তবে এখানে যেটা আমাদের আকর্ষণ করল তা হল খেজুরের গুড় তৈরি। আমরা সটান গুড়শালে গিয়ে হাজির হলাম। শিউলিরা বড় ভাল মানুষ। আমাদের গুড় এবং গরম পাটালি খেতে দিল। তার স্বাদ এত ভাল আমাদের শুধু পেট না মনও ভরে গেল। তিনজনে প্রায় সাত কেজি গুড় নিয়ে বাকি জায়গার দিকে পাড়ি দিলাম।
গেলাম লোয়ার ড্যাম, আপার ড্যাম আর বামনি জলপ্রপাত। এগুলো অযোধ্যা পাহাড়ের পরিচিত জায়গা। এই সব জায়গার যে রূপ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার নেই। আমি নীচে থেকে যখন উপরে দেখছি পাহাড়। আর উপর থেকে সেই একই যায়গা হয়ে যাচ্ছে সুন্দর উপত্যকা। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আমার পিছনে তার রং তুলি নিয়ে সবকিছু নিমেষে পাল্টে দিচ্ছে। বামনি ফলসের জল জমে এখানে একটা নীল জলের লেকও আছে। তবে রাস্তা ভাল নয়। নামা বেশ ঝুঁকির। আর ওঠা আরও কষ্টসাধ্য। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় আমরা আর নীচে নামিনি। এটুকু উঠতেই আমাদের জিভ প্রায় এক হাত বেরিয়ে এসেছিল।
সব শেষে এলাম মার্বেল লেক। এটি অযোধ্যার পরিত্যক্ত মার্বেল খাদান। এখান থেকে রওয়ানা দিলাম মুরগুমা ড্যামের দিকে। আমরা প্রধান রাস্তা না ধরে গ্রামের ভিতরকার ঢালাই রাস্তা ধরলাম। সবে কিলোমিটার খানেক এসেছি। পিছন থেকে আমাদের ‘ব্রেভ বয়’ বাইচুং সামনে চলে এল। এসেই প্রশ্ন, ‘‘তুমি এই রাস্তা কেন ধরলে? তুমি তো মূল রাস্তা জানো?’’ আমি বললাম, ‘‘দ্যাখ না, কী সুন্দর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। দু’দিকে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে ফাঁকা সবুজ মাঠ। যেন কাশ্মীরের কোনও গার্ডেন।’’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। শেষে বাধ্য হয়ে এক দাদাকে জিজ্ঞেস করে মূল সড়ক ধরলাম। মুরগুমার পথঘাট মোটামুটি আমার চেনা। এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার এখানে যাচ্ছি। পুরোটাই পাহাড়ি এবং খুব সংকীর্ণ আর প্রচণ্ড খাড়াই চড়াই উতরাই। এবং পাহাড়ি বাঁকে ভর্তি। তাই খুব সাবধানে এখানে বাইক চালাতে হয়। তবে পুরো রাস্তাটাই সবুজে ভরা। এক অনন্য মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। আমরা একদম নীচে নেমে গেলাম।
পুরো ড্যাম এক চক্কর দিলাম তিনজনে। চলল ছবি তোলা। তার পর ফেরার পথ। কিন্তু ওঠার শুরুতেই বিপত্তি। বাইচুং আর দিব্যেন্দু এগিয়েছে। আমি ছিলাম পিছনে। ওঠার সময় আমার বাইক আস্তে আস্তে রাস্তার বাইরে চলে যাচ্ছে। যদিও গাড়ির গতি একদমই ছিল না। আর ঘটনাটা ওঠার মুখেই। সম্ভবত হাওয়ার গতির কারণেই হয়েছে। আমি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেলাম। তার পর সামান্য ব্যাক করে রাস্তায় উঠলাম। সামনেই এক দম্পতি ছবি তুলছিলেন। ছেলেটি ছুটে এসে সাহায্য করলেন। একটু উপরে উঠে ভিউ পয়েন্টে চলল ফটোসেশন। আর পেটে জ্বালানি ভরা।
হিলটপে ফিরে এসে আমরা ভাত খেলাম অযোধ্যা ফুটবল মাঠের একদম শেষ হোটেলে। যেমন খাবারে স্বাদ তেমনই প্রত্যেকের ভাল ব্যবহার। ভাত মুরগির মাংস সঙ্গে পাঁপড় আর চাটনি। খাওয়া পর্ব মিটিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে পুরুলিয়া শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ রাতটা ওখানে কাটিয়ে পরদিন বাড়ি ফিরব।
কভারের ছবি— অযোধ্যা পাহাড়ের পাকদণ্ডী
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)