দীপক দাস

কথাগুলোয় তাচ্ছিল্য ছিল! নাকি ঔদাসীন্য? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমরা। কথা বলার ঢংয়ে অনেক সময় কথার অর্থ পাল্টে যায়। অলংকার শাস্ত্রে কাকু বক্রোক্তি বলে। আবার অঞ্চল ভিত্তিক উচ্চারণ ভেদেও কথার ভাব বদল হয়। যেমন আমাদের সামনে দাঁড়ানো কর্তাব্যক্তিটি বলছিলেন, ‘‘এ সব কে বুঝবে?’’ এই বুঝবে শব্দটা তিনি এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যে আমরা সংশয়ে পড়ে গেলাম। বানানে ঠিক বোঝানো যাবে না। তবুও লেখার চেষ্টা করছি। উনি বলেছিলেন, ‘‘কে বুঝব্যেএ’’। পূর্বাপর না বললে কথাটার মানে বোঝা যাবে না। একটু খোলসা করি।
যথারীতি এক মঙ্গলবার আমরা বাইক নিয়ে সাঁই সাঁই হয়েছি। মিস্টার ঘাসপুস দীপুর বাইকে কচি ওরফে শুভ বৈদ্য। বাবলা ওরফে ছোটা ডনের বাইকে আমি। যাব রাজবলহাট। সন্ধান মিলেছে, রাজবলহাট সংলগ্ন এক গ্রামে জন্মেছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার অন্যতম সাহিত্যিক মহাকাব্য ‘বৃত্রসংহার কাব্য’এর কবি। একবার দেখে আসতে হয় এমন পবিত্রভূমি। আরও একটা জিনিস জেনেছিলাম। এই এলাকাতেই রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। নাম ‘অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালা’। নানা প্রাচীন পুঁথিতে সমৃদ্ধ। এটাও দেখা উচিত।

খুঁজে পেতে হাজির হয়েছিলাম প্রত্নশালার সামনে। ‘অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালা’ পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের স্মৃতিতে তৈরি। প্রত্নশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। গ্রামাঞ্চলে এমন সংগ্রহশালা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন বিনয় ঘোষ। প্রথমে প্রত্নশালা দেখে তার পর কবির গ্রামে যাওয়া স্থির হয়েছে। কিন্তু প্রত্নশালাটি বন্ধ। একবার দেখা যাবে না? পাশে কয়েকজন বসেছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে একটি নাম মিলল। তিনি এক শূরবীর। প্রত্নশালাটির একজন কর্তাব্যক্তি। তাঁর বাড়ি কোথায় জানার চেষ্টা করছি। যদি ধরে করে অনুরোধে প্রত্নশালাটি খোলার ব্যবস্থা করা যায়। একজন পরামর্শ দিলেন, ‘‘ফোন নম্বর দিচ্ছি। ফোন করে জেনে নিন।’’ ফোন নম্বর লেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখনই সমবেত ব্যক্তিবর্গ হইহই করে উঠলেন। ‘‘ওই তো ওই তো’’।

কর্তাব্যক্তিটি এলেন। তাঁকে আমাদের ইচ্ছের কথা জানালাম। তিনি বললেন, চাবি তাঁর কাছে নেই। তার পরেই জানালেন, দেখে কী হবে? কিছুই নেই আর। আড়াইশো-তিনশো বছরের সব পুঁথিপত্র। তার পরেই সেই উক্তি, ‘‘এ সব কে বুঝবে?’’ কোনও সংগ্রহশালার কর্তাব্যক্তি প্রাচীন পুঁথি সম্পর্কে বলছেন, ও সব কে বুঝবে! এটা ঠিক কী ধরনের উক্তি? একবার প্রত্নশালার দেওয়ালের দিকে তাকালাম। একটি রং সাত রঙের সমাহার। আরেকটি রঙে স্বপ্ন দেখার ছোঁয়া। বুঝলাম, কর্তাব্যক্তিটি কোনও গুণের কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত হননি। হয়েছেন রঙের কারণে। উনি আরও একটা তথ্য জানালেন, পুঁথিগুলো সব ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে। মানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কতদিন ধরে কতজনের প্রচেষ্টা, পরিশ্রম এরকম ঝুরঝুরে হয়ে গেল!
অমূল্য প্রত্নশালার সামনে থেকে সরে গেলাম বেশ ভারাক্রান্ত মনে। বাঙালি আর কবে ইতিহাস সচেতন হবে? সব যে শেষ হতে চলল!

অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালা থেকে সরাসরি আমরা হেমচন্দ্রের বাড়ি যাইনি। আরও কিছু জায়গা ঘুরে গুলিটা গ্রামে যাওয়ার উদ্যোগ করেছিলাম। তখন সন্ধে নেমেছে। প্রত্নশালার কাছের লোকজন কেশব দাস নামে একজনের নম্বর দিয়েছিলেন। আমরা ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, কিছুক্ষণ পরে যাচ্ছি। কিন্তু যেতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ায় তিনি গুলিটা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তবে আমরা স্থানীয় এক ‘গাইড’ পেয়ে গেলাম। এক কাকিমা। নাম করুণা দে। অতি আন্তরিক এবং মাতৃস্নেহপরায়ণা। আমরা তখন হেমচন্দ্র উদ্যানে। কচি, দীপুরা তখন অন্ধকারে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি আর বাবলা ঘুরে দেখছি। তখনই একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন কাকিমা। তাঁর কাছেই জানতে চেয়েছিলাম হেমচন্দ্রের জন্মভিটের কথা। কাকিমা জানালেন, হেমচন্দ্র উদ্যানটির জায়গাতেই কবির জন্মভিটে ছিল। এটাই তাঁর মামার বাড়ি। আশপাশে তাঁর মামার বহু বিভক্ত পরিবারের লোকজন থাকেন। কাকিমা হেমচন্দ্রের মাতুল বংশীয় পরিবারের এক বৃদ্ধার দেখাশোনা করেন।
গুলিটা আসলে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি। লোকে বলে গুলটে। এখানেই কবির জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মা আনন্দময়ী। হেমচন্দ্রের শৈশব কেটেছিল হুগলি জেলার এই রাজবলহাটেই। গুলিটা গ্রামের পাঠশালাতেই তিনি পড়েছিলেন। ন’বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতার খিদিরপুরে। পেশায় ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। ‘বৃত্রসংহার কাব্য’এর জন্যই তিনি বিখ্যাত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর।

মাত্র ন’বছর গুলিটায় কাটিয়েছেন। গুলিটা কিন্তু মনে রেখেছে তাঁদের স্বনামধন্য ভাগ্নেকে। তাঁর নামে একটি পার্ক করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে আবক্ষ মূর্তি। দেখে ভাল লাগছিল। অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালার মন খারাপের পরে এটা একটা ভাললাগা। উদ্যানের পরিসর খুব বেশি নয়। তবুও চেষ্টা দেখেই ভাল লাগল। কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কবি যে পাঠশালায় পড়েছিলেন সেটা কোথায়? কাকিমা বললেন, ‘‘তা কি আর থাকে। তাঁর নামে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে কাছেই।’’ আমরা দেখতে চাই জেনে নিজেই সঙ্গে চললেন। খুব আশ্চর্য লাগল। কাকিমার আন্তরিকতা দেখে ভাল লাগল।
অন্ধকার রাস্তায় একটু হাতড়ে হাতড়েই চলতে হচ্ছিল। কাকিমা আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘বাড়ি থেকে চর্চটা আনলে ভাল হত।’’ দীপু, বাবলা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে তা শুনে। স্কুলের পথেই দেখা হয়ে গেল স্কুলের এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। কাকিমাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম রাজকুমার শীল। রাস্তার উপরেই স্কুলটা। নাম গুল্টিয়া হেমচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালের স্কুল। একটা বিষয় নজরে এল। আমরা গ্রামের নাম গুলিটা বলে জেনে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি নামটা গুল্টিয়া লেখা। পার্কে হেমচন্দ্রের মূর্তির ফলকেও তাই লেখা। এই স্কুলেও। রাজকুমারবাবু বললেন, গুল্টিয়াই নাম গ্রামের।

বেশ সুন্দর, সাজানো গোছানো স্কুল। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রাঙ্গণে ঢুকলেই নজরে পড়ে অফিস কক্ষের বাইরের দেওয়ালে কবির মুখের ছবি আঁকা। অন্য মনীষীদের ছবিও রয়েছে। আমরা ছবি তুলছি, কথা বলছি। তখনই এলেন প্রধান শিক্ষক তপন মালিক। দুই শিক্ষক মিলে আমাদের অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। ছিমছাম সাজানো। বাচ্চাদের জন্য নানা বইয়ের সংগ্রহ। দেখে ভাল লাগল। শিক্ষকেরা স্কুলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানা কথা বলছিলেন।
স্কুল দেখে ফিরে আসছিলাম। করুণা কাকিমা তাঁদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। কাকুর সঙ্গেও পরিচয় করালেন। বড় ভাল লাগল মানব মনের এত উদারতায়। ভাল লাগছিল গুলিটা বা গুল্টিয়া গ্রামবাসীকেও। রাজবলহাটকেও। তাঁরা কবি হেমচন্দ্রের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। ‘অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালা’র পাশেই আছে কবির নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার, হেমচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার। পাঠাগারের সামনে একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে।
তথ্যসূত্র— পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি— বিনয় ঘোষ
কভারের ছবি— কবির নামাঙ্কিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ছবি— শুভ বৈদ্য ও দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)