দীপক দাস
তাকে দেখেছি জয়পুরের জঙ্গলে। কিন্তু সে দেখা, ‘চল চপলার চকিত’ চমক ছিল। তার পর দেখা সমাজ মাধ্যমে। সে দেখা আবার পরশুরামের গল্পের চাটুজ্জেমশাইয়ের মতো। চাটুজ্জেমশাই দূর থেকে মেমসাহেব দেখেছিল বিস্তর। তার পর একদিন ট্রেনের কামরায় দেখা। যাকে বলে এক হাতের তফাতে। সেই দর্শনেই জন্ম নেয় মেমসাহেবকে করা চাটুজ্জেমশাইয়ের বিখ্যাত আশীর্বচন, ‘ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হোক’। কিন্তু আমাদের এমন সুযোগ হয়নি। দুধরাজের দেখা পাইনি আমরা এক হাতের মধ্যে। এক হাত না হোক খান পঞ্চাশেক হাতের তফাতে হলেও মনে শান্তি হত। এত সুন্দর পাখি! এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য। সাধে কী ইংরেজি নামের সঙ্গে প্যারাডাইস শব্দটা যুক্ত! প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, বাংলায় দুধরাজ।
বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলে একটা দুধরাজ ডাক ছেড়েছিল। দীপু চিনতে পেরেছিল ডাক। তখন আমরা একটা ইঞ্জিন ভ্যানে। ভ্যান থামিয়ে দীপু ক্যামেরা নিয়ে লাফ দিয়ে পড়তে না পড়তেই দু’বার উড়াল দিয়ে শাল জঙ্গলে হারিয়ে গেল স্বর্গের পাখিটা। আর কোনওদিন দুধরাজ দর্শন হয়নি। ঝাড়গ্রামে বিভিন্ন সময়ে বারতিনেক গিয়েছি। কিন্তু দুধরাজের মরসুমে যাওয়া হয়নি। এদিকে প্রতি বছর সহকর্মী দেবরাজদা আর পাখিপ্রেমী বিশ্বরূপদা দুধরাজের অপরূপ সব ছবি দিয়ে মন ভরিয়ে দেয়। এ বছরও দিয়েছে। ঝাড়গ্রাম আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
না দেখার দু:খ ছিল। তবে আশাও জাগছিল। গত দু’বছরে ফেসবুকের ‘হাওড়া জেলার কথা’ গ্রুপে দেখি দু’জন দুধরাজের ছবি পোস্ট করছেন। হাওড়ায় হাজির দুধরাজ! যেতেই হয়। করোনার কারণে অভিযান করা যায়নি। এ বছর মরসুম শুরু হতে দলবলকে ধরলাম। চল একটু দেখে আসি, পাখির জগতের সাহেব, মেমদের। দলের অধিকাংশের সময় হল না। যেতে রাজি শুধু দীপুবাবু মানে আমাদের মিস্টার ঘাসপুস, ওর বোন নন্দিতা। এদিকে আমি আর আমার ছোট ভাই। ১ মে শ্রমিক দিবসে চারজনে বেরিয়ে পড়লাম পাখি দেখতে। এইদিনটা আবার আমাদের ওয়েবসাইটের জন্মদিন। একদিনের সফর দাবি করে। দীপু জানাল, আরও কিছু পাখি এদিক ওদিক দেখা যাচ্ছে। রুটটা এমন ভাবে ঠিক হোক যাতে সব ক’টাই দেখে নেওয়া যায়। যেমন নতুন ধরনের বাঁশপাতি। যা আমরা আমাদের গ্রামে দেখিনি। আর ভুতুম প্যাঁচা। যার শুধু নামই শুনেছি। দেখতেই তো বেরনো। সুতরাং আপত্তির কিছু নেই।
উদয়নারায়ণপুরে যেতে এক আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল প্রজাপতি বিশারদ সৌরভ দোয়ারী স্যারের সঙ্গে। উনি আমাদের বরাবরের উৎসাহ দেন। অজ্ঞ আমাদের জীবজগৎ নিয়ে সিরিজের পাখি-প্রাণী নিয়ে ভুল করলে শুধরে দেন। আমাদের পরিকল্পনা শুনে খুশি হলেন। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ বাড়ানোর চেষ্টায় উৎসাহ দিলেন। দীপুও খুশি হয়েছিল। সৌরভবাবু জানতে চেয়েছিলেন, দলে দীপশেখর কার নাম? যদিও নামটা ভুল বলেছিলেন, দীপশঙ্কর। তাতে দীপুর খুশি কম হয়নি। ওকে নাকি নতুন পরিচিতরা দীপশঙ্কর বলেই ডাকেন।
আমাদের যাত্রা হাওড়া থেকে হুগলির দিকে। দামোদর নদ ঘেঁষে বাইক ছোটানো। এই জায়গাটার অসাধারণ রূপ। কিন্তু শীতে একরকম। গ্রীষ্মে আরেকরকম। তবে সব কালেই সবুজের কমতি নেই। এদিকটায় প্রচুর চাষবাস হয়। গাছপালাও রয়েছে প্রচুর। নদের চরে প্রচুর চাষ। এখন বাদাম হয়ে আছে। মাঠের সবুজ আর দামোদরের জল অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করেছে। ফটোসেশন চলল কিছুক্ষণ। ছবি তুলতে তুলতেই মিস্টার ঘাসপুস আবিষ্কার করে ফেলল, বাঁধের রাস্তায় একটা বিশাল রক্তচন্দন গাছ। দীপু গাছগাছালি নিয়ে পিএইচডি করছে। কিন্তু দলে ওর অবস্থা ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’র মতো। আমার ভাই রাজা ইন্টারনেটে খুঁজে দেখে নিল ঘাসপুস ঠিক বলছে কিনা। ঠিকই বলেছে। দাদার সাফল্যেই কিনা জানি না, নন্দিতা হঠাৎ লাফ দিল কাদা পেরোতে। শেয়ার বাজারের সূচকের মতো টালমাটাল হয়ে পতন সামলে বিজয়ীর হাসি হাসল বটে, কিন্তু জুতো তখন কাদায় ভর্তি।
পৌঁছলাম নীল লেজ বাঁশপাতির ডেরায়। হুগলি জেলা। জায়গাটা অপরূপ। স্পটে ঢুকতে না ঢুকতেই কারেন্টের তারে একটা বাঁশপাতি বসে আছে দেখলাম। কিন্তু বাইক রেখে ক্যামেরা বাগিয়ে ফিরে আসতে আসতে পাখি উড়ান দিয়েছে। উড়েছিল জমির দিকে। আমরাও আল বেয়ে তালসারির দিকে। জমির মাঝে মাঝে লাইন দিয়ে তালগাছ। তাতে ছোট ছোট পাখি উড়ছে, বসছে। আরেকটু দূরে কারেন্টের তারে এক ঝাঁক বাঁশপাতি। থেকে থেকে তারা গ্লাইডারের মতো উড়ছে একটা ঝোঁপ লক্ষ্য করে। দীপু যতটা যাওয়া যায় গিয়ে ক’টা ছবি তুলল বটে কিন্তু তেমন জুতের হল না।
আবার খোঁজ খোঁজ। এবার দেখা মিলল নদীর পাড়ে। বেশ কয়েকটা। কেউ জলের উপর উড়াল দিচ্ছে। কেউ সঙ্গীকে নিয়ে মরা গাছের ডালে বসে রয়েছে। কেউ কেউ পাড়ের কোনও খোঁদলে ঢুকছে বলেও মনে হল। মুখে খাবার। হয়তো বাসা আছে। খাবার সময়ে লোকজন এলে আমরাই মনে মনে বিরক্ত হই। পাখিগুলোরও নিশ্চয় রাগ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সরে এলাম। দেখা তো হয়ে গিয়েছে। বাঁশপাতি এমনিতেই দেখতে সুন্দর। নীল লেজ বাঁশপাতির রূপ যেন আরও সুন্দর।
এত সুন্দর জায়গাটার একটাই দোষ। বড্ড মদ্যপদের আনাগোনা। এখন তো কোনও ছায়া মিললেই বোতল খুলে বসে পড়ার চল। এরা রাজকোষ ভরছে ঠিক কথা। তবে অন্য নাগরিকদের কথা ভেবে কিছুটা আড়াল দরকার আছে বলেই মনে হল। রাস্তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই আলোচনা করছি, হঠাৎ একটা গাছে প্রবল আলোড়ন। কয়েকটা ফিঙে কোনও একটা পাখিকে তাড়া করেছে। দীপু ছবি তুলল। একটা শিকরে পাখি। ছবি তোলা শেষ হতেই দীপু আবিষ্কার করল, ওর বাইকের পিছনের চাকা লিক হয়ে গিয়েছে। বিপত্তি। ঘুরতে গিয়ে গাড়িঘোড়া বেগ দেয় আমাদের। কিন্তু বাইক বেগ দিল এই প্রথম। দীপু বাইক সারাতে চলে গেল। আমরা তিনজনে হাঁটতে থাকলাম ভুতুম প্যাঁচার সন্ধানে।
ঘণ্টাখানেক পরে ফিরল দীপু। ততক্ষণ আমরা প্যাঁচার পাশাপাশি চলে গিয়েছি। কিন্তু খুঁজে আর পাই না। কোনও প্যাঁচানি তার খাসা চেঁচানি দিয়েও আমাদের সাহায্য করছে না। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে এসে বেশ কিছুক্ষণ প্যাঁচা খোঁজা চলল। একটা গাছে নন্দিতা সাদা সাদা দাগ দেখতে পেয়েছিল। ওর আশপাশে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দীপু দেখতে পেল বিশাল একটা গাছের মগডালের কাছে বসে আছেন তিনি গম্ভীর মুখে। প্যাঁচা না প্যাঁচানি জানি না। মুণ্ডুটা নাড়াচ্ছিল। মনে হল মুণ্ডুতে দাড়ি আছে। অনেকটা আমার মতোই সাদা দাড়ি। মানে পালকের বোঝা। এত বড় প্যাঁচা কোনওদিন দেখিনি। হাওড়ার জয়পুর গ্রামে লক্ষী-জনার্দন মন্দিরের পাশে একটা লক্ষ্মী প্যাঁচা দেখেছিলাম। এটা মনে হল সেটার থেকেও বড়। একটা আছে যখন ওর জুড়িদারও রয়েছে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়েও দেখতে পেলাম না।
এবার দুধরাজ। এ খোঁজা পুরো গোয়েন্দা গল্পের মতো। সূত্র মিলিয়ে মিলিয়ে। গ্রামের নামটা শুধু জানি, মানশ্রী। মানশ্রীতে পৌঁছে সুবিধা হল না। পাখি কোথায় পাওয়া যায় জানা গেল না। হাতের রয়েছে আরেকটি সূত্র, যিনি পোস্ট করেছিলেন দুধরাজের ছবি। বিশ্বজিৎ পাত্র। বিশ্বজিৎ ভাইয়ের সহপাঠী ছিল বিএডে। বিশ্বজিতের বাড়িটা খুঁজে বার করলে কিছু সুরাহা হতে পারে। এক দোকানদার সন্ধান দিলেন। কিন্তু বিশ্বজিৎ বাড়িতে নেই। আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছেন। তাহলে উপায়? বাড়ি থেকে মিলল আরেকটি সূত্র। কোথায় ছবি তুলতে যান বিশ্বজিৎ। ফোন নম্বর জোগাড় হয়েছিল বটে। কিন্তু ওঁর ফোন বন্ধ পেল ভাই।
পৌঁছে গেলাম সেই জায়গাতেও। এবার হল মুশকিল। এখানে রাস্তা যে চারদিকে ছুট লাগিয়েছে। দুধরাজ খুঁজতে গেলে চারজনকে চারদিকে গরু খোঁজা খুঁজতে হবে। কী করি? আবার সূত্রের খোঁজ। পাখির পোস্টগুলো দেখলাম। একটা বাঁশবাগান। কঞ্চিতে বসে আছে দুধরাজ। কিন্তু আশপাশে কোনও বাঁশগাছ নেই। কী করা যায়? এক দম্পতি ছাগল চরাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আশপাশে কোনও বাঁশঝাড় আছে? তাঁরা বললেন, আরও কিছুটা যেতে হবে। আরেকটা প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁদের? এখানে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে আসেন কেউ? ইতিবাচক উত্তর মিলল। কোনদিকে আসেন? হাত যেদিকে উঠল, সেদিকেই বাঁশবাগান।
বাইক নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বাঁশঝাড় মিলল। কিন্তু দুধরাজের দেখা নেই। না থাক। জায়গাটা আমাদের ভাল লেগে গিয়েছে। প্রচুর গাছগাছালির ছায়া ঘেরা সবুজ এক গ্রাম। দূরে দূরে জনবসতি। নির্জন, শীতল, মনোরম গ্রাম। এই জায়গা নিয়েই এক সপ্তাহ লেখা হতে পারে। তিন জোড়া চোখ আমাদের স্বপ্নের পাখি খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখি, দীপু ক্যামেরা বাগিয়ে বাঁশবাগানের দিকে তাক করেছে। পেলি নাকি? দীপু ঘাড় নাড়ল। তার পর পাখিটাকে দেখাল। একটা নাইটজার মানে রাতচরা। হেলে পড়া বাঁশের উপরে চুপটি করে বসে আছে। কিন্তু দুধরাজ?
মিলল। রাস্তাটা যেদিকে বাঁক নিয়েছে সেদিকে যেতেই দেখতে পেলাম একজনের ওড়াউড়ি। তার পরে আরও একজন। মনটা ক্রিকেটে উইকেট পাওয়ার মতো, ইয়েস করে উঠল। হাত দু’টোও মুঠো হল। যারা দর্শন দিল তারা খয়েরি। সাদা গা, কালো মাথা, লেজঝোলা পাখিগুলো? দেখা মিলল না। দেখা হয়তো মিলত। অপেক্ষা করলে। কিন্তু ছোটভাই সম্প্রতি সাহেব হয়েছে। ঘড়ি ধরে ওর খাওয়াদাওয়া। ফলে ফেরার তাড়া। তবুও ভুলিয়েভালিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কেউ দেখা দিল না। খয়েরিগুলোও দীপুর ক্যামেরার জন্য পোজ দিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে।
ফেরার পথ ধরলাম। স্বর্গীয় শুভ্রতার চমক না দেখেই। মনটা একটু খারাপই লাগছিল। চাটুজ্জেমশাইয়ের মতো দূর থেকেই মেমসাহেব দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হবে! দুধরাজ তো পাখিদের দুনিয়ার সাহেব-মেমই।
কভারের ছবি- দুধরাজ
ছবি— দীপশেখর দাস ও নন্দিতা দাস
(সমাপ্ত)