দীপক দাস
দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারমূলক কাহিনিতে নদী নৌকার যোগ আছে। এই মুহূর্তে দু’টো কাহিনির কথা মনে পড়ছে। কাহিনি দু’টোর মধ্যে তফাৎও রয়েছে। একটি কাহিনি সাহিত্যিক। অন্যটি যথার্থ কিংবদন্তী। মানে লোককথা ও বিশ্বাসে উৎপত্তি। সাহিত্যিক কাহিনিটি সকলে জানেন। সেই যে ভারতচন্দ্র রায়ের ‘সেইখানে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী’, ‘কাঠের সেঁউতি হল সোনার সেঁউতি’— মানে অন্নদামঙ্গল। এই ঘটনার পরে দেবী অন্নদা বা অন্নপূর্ণার পুজো প্রচলন হল। দ্বিতীয় কাহিনিটি হল, রাজবল্লভী দেবী সম্পর্কে। হুগলি জেলার রাজবলহাটের রাজবল্লভী। আশ্চর্যজনক হল, ভারতচন্দ্রের সঙ্গে রাজবলহাটের যোগ রয়েছে।
আমাদের এবারের গন্তব্য রাজবলহাট। শুভ বৈদ্য তথা কচি, ছোটা ডন তথা বাবলা, মিস্টার ঘাসপুস তথা দীপুকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করেছিলাম কিছুদিন আগে। রাজবলহাট বাছার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, ঘরের কাছের জায়গাটা দেখা হয়নি। দ্বিতীয়ত, এখানে বিখ্যাত রাজবল্লভী ছাড়াও কয়েকটি মন্দির ও অন্য দর্শনীয় স্থান আছে। নদী আছে। আর সর্বোপরি এলাকাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে নানা দিক থেকে। ফলে বাইকে গমন।
আমরা কিন্তু বাইক নিয়ে রাজবল্লভী মন্দির পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই। প্রথম লক্ষ্য ছিল ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো চাক্ষুস করে নেওয়া। কী নিদর্শন? সে কথা বলতে হলে রাজবলহাটের ইতিহাসের দিকে একটু ফিরতে হবে। দামোদর এবং রণ নদের তীরে অবস্থিত রাজবলহাট সুপ্রাচীন এক বাণিজ্য নগরী। এই নগরীর পত্তনই হয়েছিল বাণিজ্যের সুবিধার জন্য। রাজবলহাটের আগে নাম ছিল রাজপুর। ইতিহাস বলছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজা সদানন্দ রায় বাণিজ্যের সুবিধার জন্য জঙ্গলে ঢাকা একটি জায়গা পরিষ্কার করিয়ে এক নগর পত্তন করেন। জায়গাটি ছিল দামোদর ও রণ নদের তীরে। নগর তৈরির পরে একটি হাটও বসান রাজা। রাজার তৈরি নগর বলে জায়গাটির নাম হয় রাজপুর।
ভূরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট রাজবংশের সঙ্গে রাজবলহাটের যোগ তৈরি হয়েছিল এভাবেই। এই রাজবংশের বসন্তপুর শাখার সরাসরি যোগ রাজবলহাটের। বসন্তপুর রাজবংশের রাজবলহাটে একটি গড়বাটি ছিল। সাত বিঘে জমির উপরে তৈরি হয়েছিল সেই গড়। এ ছাড়াও রাজবল্লভীর নামে দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল ৫০০ বিঘে। এই বসন্তপুর হাওড়ায়। লোকমুখে যা পেঁড়ো-বসন্তপুর নামে পরিচিত। এই বংশেই জন্মেছিলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়। সদানন্দ রায় যে বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটালেন তা দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে ধরে রেখেছিল রাজবলহাট তথা রাজপুর। ব্রিটিশ আমলেও সেই ধারা বজায় ছিল।
একসময়ে নীল চাষ হত রাজবলহাটে। রাজবল্লভী মন্দিরের কাছেই নাকি নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ ছিল। ১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজবলহাটে একটি কমার্শিয়াল রেডিসেন্ট খুলেছিল। বহু তাঁতি থাকার জন্য এখানে আড়ং বা ফ্যাক্টরি ছিল। এখান থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করে তা কলকাতায় চালান দেওয়া হত। রাজবলহাটের ইংরেজ রেসিডেন্ট অত্যাচারী ছিলেন। গ্রামবাসীরা অভিযোগ করায় ১৭৯০ সালে রাজবলহাট থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট বা বাণিজ্যকুঠি হরিপালে চলে যায়। হরিপালে কোম্পানির একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট ও একজন চিকিৎসক থাকতেন।
এই যে গড়বাটি, নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ বা ইংরেজ রেসিডেন্টের বসত— এগুলোর কোনও স্মৃতিচিহ্ন দেখাই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। তাই মন্দির ছাড়িয়ে এগিয়ে চলা। কিন্তু মিষ্টির দোকান, মোড়ের মাথার পথিক, অমূল্য প্রত্নতত্ত্বশালার সামনের লোকজন, বহু জিজ্ঞাসাবাদেও মেলেনি কোনও চিহ্ন। সকলেই বলেছেন, ছিল। এখন আর নেই। কী আর করা! বাধ্য হয়েই এগিয়ে যাওয়া। প্রথমে অন্য দু’টি মন্দির দেখা। তার পরে তালমিছরি সম্রাটের বাড়ি।
অমূল্য প্রত্নশালা ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম শ্রীধর দামোর মন্দির দেখতে। এলাকাটার নাম শীলবাটী। লম্বোদর শীল প্রতিষ্ঠিত শ্রীধর দামোদরের মন্দির। মন্দির চত্বরটি বেশ সুন্দর। মন্দিরটিও। দুই বৃদ্ধা মন্দিরের চাতালে বসে বৈকালিক গল্পগুজব করছিলেন। শ্রীধর দামোদর টেরাকোটা কাজের মন্দির। টেরাকোটার প্যানেলে রামায়ণের নানা কাহিনি। একটি প্যানেলে লেখা, মন্দির প্রতিষ্ঠার সাল, ‘সকাব্দ ১৬৪৬’। অর্থাৎ ১৭২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৈরি হয়েছিল মন্দিরটি। টেরাকোটার কাজগুলো এখনও অক্ষত রয়েছে দেখে ভাল লাগল।
মন্দিরের চাতালে বসে থাকা বৃদ্ধাদের কাছে তালমিছরি সম্রাটের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তালমিছরি বললে একজনের নামই ভেসে ওঠে। দুলালচন্দ্র ভড়। সারা বাংলাকে কচিকাঁচাদের যিনি তালমিছরির স্বাদে ভুলিয়েছেন তাঁর বাড়ি রাজবলহাটেই। ছোটবেলা থেকে বাবার মুখে শুনেছি। বৃদ্ধারা বললেন, মন্দিরের ঠিক পিছনেই বাড়ি ভড়েদের। গেলাম চারজনে। গিয়ে অবশ্য মন খারাপ হয়ে গেল। বিশাল বাড়িটির প্রায় শূন্য। রাস্তার পাশের একটি ঘর। সেটির জানলাগুলো খোলা ছিল। আমরা উঁকি দিয়ে দেখলাম, দুলালচন্দ্রের ছবি টাঙানো দেওয়ালে। এ বাড়িতে এখন আর কেউ থাকেন না। সকলে কলকাতাবাসী। শুধু কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে তালমিছরি সম্রাট দেওয়ালে ঝুলছেন।
পরের গন্তব্য রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দিরে। একটি মাঠের পাশে মন্দিরটি। মাঠে তখন ছেলেরা পুরো দমে ফুটবল খেলছে। দীপু বাবলাকে ইশারা করল, নেমে পড়বি নাকি একবার? বাবলা তেমন একটা উৎসাহ দেখাল না। ওর উৎসাহে ভাটা চলছে বেশ কিছুদিন। রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দির দেখে আমাদের একটু মন খারাপ হল। এটিও টেরাকোটার মন্দির। কিন্তু বড়ই বিবর্ণ। শ্রীধর দামোদরের মন্দিরের মতো উজ্জ্বল নয়। টেরাকোটার ফলকগুলোও ক্ষয়ে গিয়েছে। মন্দিরের কাছে দেখা হল অমল শীলের সঙ্গে। অমলবাবু জানালেন, মন্দিরটি ঘটকেরা দেখভাল করতেন। কিন্তু এখন তাঁরা কেউ থাকেন না। মন্দিরে আগে কষ্টি পাথরের মূর্তি ছিল। সে মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছে। রক্ষার দিকে বাঙালি কখনই পারদর্শী নয়। এ তো সত্য কথা। সে ইতিহাস হোক বা ঐতিহাসিক নিদর্শন।
রাজবলহাটের সঙ্গে দামোদর নদের যোগাযোগ নিবিড়। বাণিজ্যনগরী হিসেবে সুনাম তো এই নদের কারণেই। তাকে একবার চোখের দেখা না দেখলে চলে! এদিকে বিকেল পেরিয়ে গোধূলি। আরও অনেক কিছু দেখার আছে। দামোদর বেশ কিছুটা দূরে। গেলাম আমরা জিজ্ঞাসা করতে করতে। বাঁধের রাস্তা থেকে নেমে মাঠের মতো এলাকা পেরিয়ে নদের কাছে দাঁড়ানো। একটা বাঁশের সাঁকো। এ সাঁকো হাওড়া-হুগলির শেষ প্রান্তে বহু দেখেছি। এটাই এপার-ওপারের সংযোগ মাধ্যম। বাঁশের উপর দিয়ে খড়মড় শব্দ তুলে বাইক, সাইকেল আসা যাওয়া করছে। হেঁটে পার হওয়া মানুষের চলাতেই জানান দিচ্ছে সাঁকো। তবে যে আওয়াজে সাইকেল, বাইকের মতো ব্যস্ততা নেই। তার বুকের উপরে এত ব্যস্ততা। কিন্তু নদ একেবারে নিশ্চুপ। দামোদরের অবস্থা খুব খারাপ। প্রায় বদ্ধ জল। সহস্র কেন লক্ষ লক্ষ শৈবাল, ঝাঁঝি জলকে জাপটে ধরে আছে। সূর্য ডোবার ম্রিয়মান আলোয় দামোদরকে দেখে মন খারাপই হল।
রণ নদকে আর দেখা হয়নি সেদিন। আমরা ফিরে এসেছিলাম রাজবল্লভী মন্দিরে। তখন পুরোপুরি সন্ধে নেমেছে। মন্দিরের ভিতর বেশ ভিড়। দীপু আর কচি ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি আর বাবলা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। মূল মন্দিরের পাশে কয়েকটি শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরের গায়ে গায়ে শিবের নাম, বাণেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর, সোমেশ্বর, রাজরাজেশ্বর বা নন্দীশ্বর।
রাজবল্লভী মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে দু’টি জনশ্রুতি প্রচলিত। একটির সঙ্গে এলাকার নামকরণও যুক্ত। জনশ্রুতি বলছে, ভুরশুটের রাজা কমলদিঘি নামে একটি জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। দিঘির পাড়ে ছিল ফুলবাগান। রানি ছিলেন গৌরী দেবীর ভক্ত। রানির পুজোর জন্য ফুলবাগানে এক মালিনী রোজ ফুল তুলত। একদিন এক ব্রাহ্মণ কন্যা এসে মালিনীর কাছ থেকে ফুল চায়। মালিনী জানায়, গৌরী দেবীর পুজোর ফুল দিলে রানি রেগে যাবে। শুনে ব্রাহ্মণ কন্যা বলে, তিনি রাজবল্লভী। তাঁকে ফুল দিলে রানি যদি রাগ করে তাহলে তাকে সরিয়ে তিনিই অধিষ্ঠান করবেন। মেয়েটির কথা শুনে মালিনী ভয় পেয়ে চোখ বোজে। চোখ খুলে দেখে, সেখানে রাজবল্লভী দাঁড়িয়ে। সেদিন রাতে রাজাকে দেবী স্বপ্নে আদেশ দেন, তিনি রাজপুরে যাচ্ছেন। রাজপুরে যেন রাজবল্লভীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর রাজপুরের নাম বদলে নগরের নাম দেওয়া হয় রাজবল্লভীহাট। পরে রাজবল্লভীহাট হয়ে দাঁড়ায় রাজবলহাট।
অন্য জনশ্রুতিটির সঙ্গে দামোদরের সংযোগ। এখানেও দেবী ব্রাহ্মণকন্যার ছদ্মবেশে ছিলেন। কোনও এক পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতেন। সেই সময়ে দামোদর দিয়ে বাণিজ্য হত। একদিন এক বণিক সপ্তডিঙা নিয়ে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিল। বণিকটি এখানকার ঘাটে থেমেছিল। সে ব্রাহ্মণকন্যার রূপ দেখে তাকে বজরায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মেয়েটিকে নিয়ে ছয় ডিঙা পার হয়। আর দেখে মেয়েটির পায়ের স্পর্শে পরপর ছ’টি ডিঙিই ডুবে গেল। সপ্তম ডিঙায় তোলার আগেই বণিকের চৈতন্য হয়। সে ক্ষমা চায়। দেবী বণিকের নৌকাগুলো আবার ভাসিয়ে দেন। আর বণিক দেবীর আদেশে রাজবল্লভীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজোর ব্যবস্থা করে। এই জনশ্রুতিতে কিন্তু রাজপুর বা রাজবলহাটের বাণিজ্যকেন্দ্রের পরিচয়ই পাওয়া গেল।
রাজবল্লভী চণ্ডীরই একটি রূপ বলে মনে করা হয়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে রাজবল্লভীর কথা উল্লেখ করেছেন। রাজবল্লভীর গায়ের রং ‘শরতের জ্যোৎস্নার মতো। তাঁর ডান হাতে ছুরি আর বাঁ হাতে রক্তপাত্র’। মন্দির কর্তৃপক্ষ সম্ভবত বণিক সংক্রান্ত জনশ্রুতিকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ এখনও প্রতি বছর অষ্টমীর পুজোর আগে সাতটি ছোট ছোট ডিঙি তৈরি করে দেবীর দিঘিতে ছ’টি ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তার পরে পুজো শুরু হয়।
রাজবলহাট বরাবরের সমৃদ্ধ নগরী। এলাকার প্রচলিত কথা, ‘চার চক চৌদ্দ পাড়া, তিন ঘাট/এই নিয়ে হয় রাজবলহাট’। এই চারটি চক হল— দফর চক, সুখর চক, বৃন্দাবন চক, বদুর চক। ১৪টি পাড়ার নাম, নন্দী পাড়া, দে পাড়া, মনসাতলা, শীল বাটী (এখানেই শ্রীধর দামোদরের মন্দি), ভড়পাড়া (সম্ভবত দুলালচন্দ্র ভড়েদের পাড়া), উত্তর পাড়া, দিঘির ঘাট, কুমোর পাড়া, বাঁড়ুয্যে পাড়া, দাস পাড়া, কুঁড় পাড়া, নস্কর ডাঙা, সানা পাড়া ও পান পাড়া। তিনটি ঘাট হল, দিঘির ঘাট, মায়ের ঘাট আর বাবুর ঘাট। জনপদটির বাণিজ্য কমে যায় সম্ভবত দামোদরের ধারা শুকিয়ে যাওয়ার পরে।
এখন রাজবলহাট দু’টো পরিচয়ে বিখ্যাত। রাজবল্লভীর মন্দিরের জন্য। আর তাঁতের শাড়ির জন্য। এখানকার তাঁতের কাজ ব্রিটিশ আমলেও বিখ্যাত ছিল। এই যাত্রায় এক তাঁতি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। করুণা কাকিমা ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে। তাঁরা মন্দিরের পাশের পাড়া গুল্টিয়ার বাসিন্দা।
তথ্যসূত্র: ১। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি- বিনয় ঘোষ ২। হুগলি জেলার ইতিহাস- সুধীরকুমার মিত্র
কভারের ছবি— রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দির
ছবি— দীপশেখর দাস, শুভ বৈদ্য
(সমাপ্ত)