দীপশেখর দাস
শুরুতেই গোলযোগ। আমাদের না বিমানের। উদ্ভিদবিদ্যার এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে সদলবলে বেরিয়েছি। গন্তব্য পুণের হরিশচন্দ্রগড়। সকাল সাড়ে ৯টায় উড়ান। যাব মুম্বই। সেখান থেকে চারচাকায় হরিশচন্দ্রগড়। মুম্বই থেকে হরিশচন্দ্রগড় সড়ক পথে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। সকলেই সাড়ে ৭টার মধ্যে বিমানবন্দরে হাজির। বাড়ি থেকে বিমানবন্দরের পথ আমারই সবথেকে বেশি। তাই ভোরের যাত্রাপথের ঝঞ্ঝাট এড়াতে আগের রাত্রে হাওয়াই আড্ডার কাছে এক বন্ধুর বাড়ি ঠাঁই নিয়েছিলুম। বিয়ের পর থেকেই বন্ধু আর বন্ধুর বর ওদের বাড়ির আসার নিমন্ত্রণ করে এসেছে। কিন্তু নানা কারণে সে নিমন্ত্রণ রাখা হয়ে উঠেনি। এবার দায় আমার। তাই যেচে নিমন্ত্রণ নিয়ে বকেয়া নিমন্ত্রণের ভার কিছুটা লাঘব করলুম।
আমাদের তাড়া ছিল সময় মতো মুম্বই পৌঁছনোর। বিমানের ছিল না। বিমানবন্দরে পৌঁছে সব শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলা পেরিয়ে জানলুম যার উদরস্থ হয়ে আমাদের যাত্রা তিনি তখনও মুম্বইয়ে বিরাজ করছেন। কোনও কল বা কবজা বিকল হওয়ায় মুম্বই থেকে সকালে হাওয়ায় ভাসা হয়নি তার। কল কবজা ঠিক হলে তিনি এসে আমাদের মুম্বই নিয়ে যাবেন। অন্য বিমানেও যাওয়ার উপায় নেই। সেসবের আসন সব আগেই অধিকৃত। অতএব এখন অপেক্ষা অন্তহীন।
আমাদের সাত সকালে শুরু হওয়া অপেক্ষা শেষ হল গোধূলি লগ্নে। সাড়ে ৫টা নাগাদ জানানো হল বিমান আসছে। সাড়ে ৬টা নাগাদ মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবে। যথা সময়েই বিমান উড়ল। আকাশ তখন গোধূলির সোনালি রঙে রঙিন। আকাশ থেকে কলকাতা দেখলুম যতক্ষণ দেখা গেল। ঘণ্টা দুয়ের একটু বেশি সময়ের আকাশ সফর শেষে মুম্বই পৌঁছলুম রাত ৮:৩০ নাগাদ। ঝাঁ চকচকে মুম্বই বিমানবন্দর নজর কাড়ল। পুণে যাওয়ার গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সভার আয়োজকেরাই ব্যবস্থা করেছিলেন। তড়িঘড়ি রওনা দিলুম হরিশচন্দ্রগড়ের উদ্দেশ্যে। আলোকোজ্জ্বল মুম্বই নগরীর মায়া কাটিয়ে উঁচু সব অট্টালিকা পাশে রেখে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলা। মাঝে থেমে এক ধাবায় খেয়ে নেওয়া হল।
শহর পেরোতেই চারিপাশ নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। আন্ধেরি নামে মুম্বইয়ে জায়গা আছে শুনেছি। কিন্তু এ যে আন্ধেরা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখলুম ইতিউতি ছড়ানো গাছপালা আর ছোট ছোট টিলার পাশ দিয়ে চলেছি। যত এগোতে থাকলুম গাছপালা আর টিলার সংখ্যা বাড়তে থাকল। কোথাও কোথাও মনে হল, টিলা কেটে তার মাঝখান দিয়েই রাস্তা বানানো হয়েছে। প্রায় ৬ ঘণ্টার সফর শেষে গন্তব্যে পৌঁছলুম। রাত তখন ৩টে। কলকাতার হাওয়াই আড্ডায় বিরক্তিকর এবং বাধ্য হওয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, তার পর এই মোটর বাহন শরীর আর বইছিল না। তাই থাকার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে চটজলদি বিছানা নিলুম। কাল সাত সকালে উঠেই সভায় যোগ দিতে হবে।
আলোচনা সভা ছিল তিনদিনের। হরিশচন্দ্রগড় কালসুবাই অভয়ারণ্যের পার্শ্ববর্তী এক রিসর্টে। আয়োজকদের তরফে মাঝে একদিনের দ্বিতীয় অর্ধে অভয়ারণ্য ঘোরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সভায় আগত সকলে দু’টো বাসে অভয়ারণ্যে গেলুম। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বর্ধিত অংশে এই অভয়ারণ্য। ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রাম। সমগ্র এলাকাটাই বেশ রুক্ষ। সবুজের ভাগও বেশ কম। রুক্ষ মাটিতে কিছুটা প্রাণ সঞ্চার করেছে কয়েকটি জলাশয় আর জলধারা। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল এক প্রকৃতি উদ্যানে। সুবিশাল এক জলাধারের পাশে এই উদ্যান। সাজানো গোছানো ছোট ছোট ঘরে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। আর সুবিন্যস্ত এলাকায় বেশ কিছু স্থানীয় কিন্তু বিরল উদ্ভিদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
সেখান থেকে আমরা গেলুম পাহাড়ের উপরে এক ভিউ পয়েন্টে। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। প্রান্তর শেষে অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের চূড়াটা ছুঁচালো। সেই চূড়ার মাথায় একটা গোলাকার আকৃতি পাথর বসানো যেন। কথিত যে, এটা একটা আগ্নেয়গিরি ছিল। আর ওই গোলাকার পাথরটা অগ্ন্যুৎপাতের শেষ বিন্দু। এই পাহাড়টা রুক্ষ। গাছপালা নেই তেমন। ভিউ পয়েন্টের অপর দিকে অন্য দৃশ্য। সেদিকে পাহাড়টা খাড়াই নেমে গিয়েছে নীচে। এদিকটায় যতদূর চোখ যায় ঘন সবুজের আবরণ। এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
ভিউ পয়েন্টে আরও কিছুক্ষণ থাকা যেত। কিন্তু, কোথা থেকে হঠাৎ একরাশ আঁধার কালো মেঘ ছুটে এসে তুমুল ঝড় বৃষ্টি নামাল। দুদ্দাড়ে ছুটে সবাই বাসে চড়লুম। এবার বাস থামল এক ড্যামের কাছে। কিন্তু তখনও মুষলধারা চলেছে। অনেকেই নামল না। যাঁরা রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন তাঁরা কয়েকজন আর আরও কয়েকজন নামলুম। মুষলধারায় অর্ধসিক্ত হয়ে কোনওক্রমে ড্যাম দর্শন করে বাসে ফিরলুম।
চাকা গড়াল আবার। নতুন পথে চলতে শুরু করল বাস দু’টো। এদিকে সবুজের ভাগটা একটু বেশি। করমচা গাছের ঝোপ ইতিউতি। শেষ বিকেলে এক সুবিশাল জলাশয়ের পাশে বাস দু’টো দাঁড়াল। বারিধারা তখন থেমেছে। ভেজা প্রকৃতির শীতল হাওয়ায় শরীরে প্রশান্তি। আর সামনে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যে চোখে মুগ্ধতার আরাম। জলাশয় ছাপিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সেইসব ফেলে আসা পাহাড়শৈলী। আর তার কোলে পশ্চিমে ঢলে পরা কমলা সূর্য। সেই রঙে রেঙে জলাশয়ের জল এক অনন্য সুন্দর রূপে সজ্জিত। মনে তখন হেমন্ত মুখার্জির গান বেজে উঠেছে ‘সন্ধ্যা নামার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো’। গোধূলির রঙে এ জায়গা তখন সত্যিই স্বপ্নের দেশ। প্রাণ ভরে, চোখ ভরে সে দৃশ্যের স্বরূপ দর্শণ করে বাসে ফিরলুম। সন্ধ্যা নেমেছে। এবার ফিরতে হবে সভাস্থলে।
পরের দিন সভা শেষে মধ্যাহ্নের আগেই রওনা দিলুম মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে। কাল দেখা সেইসব পাহাড় পাশে রেখেই পথ চলেছে মুম্বইয়ের দিকে। আসার সময় অন্ধকারে এই সব পাহাড়শৈলীর সন্ধান পাইনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রতি সফর শেষেই আমার এমন হয়। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার চিন্তায় শরীর-মন ভারাক্রান্ত হয়। বিকেল ৫টার মধ্যেই মুম্বই পৌঁছে গেলুম। ৮টা নাগাদ বিমান উড়ল। কাচের জানলা দিয়ে রাতের মুম্বই দেখলুম।
আরব সাগরের তীরে তখন সহস্র আলোর রোশনাই। নিকষ কালো আকাশে একরাশ সার বাঁধা নক্ষত্রের মতোই।
কভারের ছবি— সানসেট পয়েন্ট
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)
কাজের মধ্যে একটু ঘোরাঘুরির গল্পটা বেশ লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।