ঋতুপর্ণা ঘোষ
‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ তবে মনে মনে না, এবারে বাস্তবে। অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন পরিকল্পনা করেও বেড়াতে যাওয়া ঠিক হয়ে উঠছিল না। এই শনিবার, মানে ২৫ জুন, হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়া হল। প্রস্তুতি বলতে মানসিক প্রস্তুতি। আগের দিন রাত ১১টায় মোবাইল বাণী ভেসে এল। আমি শুধু এটাই জানলাম যে পরের দিন ঠিক সকাল ৭.৩০ মিনিটে আমাকে তৈরি হয়ে যেতে হবে।
শনিবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। মনে বেশ আনন্দ। কিন্তু গন্তব্য কোথায়? তা জানি না, সেটা জানে আমাদের দলপতি সন্তু। দু’টি বাইকে আমরা চারজনে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। আমরা এগোচ্ছিলাম পাশের জেলা বীরভূমের দিকে। পথে কান্দিতে সেরে নিলাম জলযোগ। একদম সাধাসিধে খাবার। কচুরি, ডালপুরি আর কান্দির স্পেশ্যাল ল্যাংচা।
কচুরি যোগের পরে বাইকের চাকা আবার গড়াল। যত এগোতে লাগল পাশের ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনও চোখে পড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে মাটির রং লাল হচ্ছিল। মাটিও পাথুরে হতে লাগল। রাস্তায় পড়েছিল ছায়া ঘেরা এক ছোট আশ্রম। সেখানে অল্প সময় বিশ্রাম নিলাম। তার পর আবার চলা শুরু।
এলাম দুই ধারে শাল বন ঘেরা রাস্তায়। এক অপার মুগ্ধতা। দু’পাশের জঙ্গল রাস্তাটাকে মোহময় করে তুলেছে। কিছুটা সময় কাটালাম গনপুর ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত এই জঙ্গলে। জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে পথে পড়েছিল দ্বারকা নদ। এই এলাকার কাছে গনপুর গ্রাম। এই গ্রামে কিছু টেরাকোটার মন্দির আছে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে এলাম সুন্দর কিছু টেরাকোটা মন্দিরে। গ্রামটি নিজেও খুব সুন্দর। টিনের চাল দেওয়া মাটির দোতলা বাড়িগুলো দেখে আমার মতো শহুরে মানুষের উৎসাহ আর দেখে কে! আমার সারথিকে তো চুপি চুপি জানিয়ে দিলাম, এই রকম মাটির বাড়িতে আমার থাকার ইচ্ছা।
ছোটখাট এই সব হাসি ঠাট্টার মধ্যেই এলাকাটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। মন্দির চত্বরে জোড় বাংলা, এক চালার সুন্দর সুন্দর শিবমন্দির। মন্দিরগুলোর গায়ে আছে অসাধারণ কারুকার্য। রামায়ণ, বিষ্ণুর অবতারের বিভিন্ন কাহিনি। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে বাংলা হরফে খোদাই করা আছে মন্দিরের সময়কাল ও প্রতিষ্ঠাতার নাম।
আমাদের দলের একজন পুরাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা করে। তাই তার বর্ণনায় প্রতিটি মন্দির ও মূর্তিগুলি হয়ে উঠেছিল আরও আকর্ষণীয়। ওর কাছেই জানতে পারলাম, মন্দিরে পূজিত মূর্তিগুলো প্রায় সবই সেন যুগের। এগুলো ব্যাসল্ট শিলা দিয়ে নির্মিত। কাছাকাছি জঙ্গলে শিবপাহাড়ি মন্দিরও খুব শান্ত। এখানের পরিবেশও বেশ সুন্দর। মন্দিরের লোকজনেরা আমাদের সঙ্গে আলাপ করল।
গেলাম আরেকটা জায়গায়। জায়গাটার নাম মল্লারপুর। মল্লেশ্বর মন্দিরে কাটালাম বেশ কিছু সময়। এখানেও রয়েছে ১৬টি টেরাকোটা মন্দির। মল্লেশ্বর মন্দিরের গায়ে খোদাই করা আছে এর প্রতিষ্ঠাকাল। ১১১৪ শকাব্দ। তবে টেরাকোটার কারুকাজ কালের নিয়মে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ঠিক ভাবে সংরক্ষণ হয়নি।
এবারে আমাদের ফেরার পালা, রাস্তার একটি খাবার দোকানে ভূরিভোজ সেরে ফিরে এলাম নিজের জায়গায়।
বর্ষার শুরুতে একবেলার ছোট এই সফরে একমুঠো অক্সিজেন পেয়েছিলাম। যা দৈনন্দিন জীবন কাটাতে উৎসাহ দেবে। অপেক্ষা করাবে পরবর্তী বেরিয়ে পড়ার দিনের জন্য। রাঢ় অঞ্চলের এই দুই গ্রামের কথা মনে থাকবে অনেক দিন।
ছবি- লেখক ও সন্তু ঘোষ
(সমাপ্ত)