রসমাধুরী
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

রসমাধুরীর রসাস্বদনের পরে

দীপক দাস

আস্বাদনের পরে কী হতে পারে? রসনার তৃপ্তি। আমাদের হল হারানো প্রাপ্তি। যান-চাবিটি হারিয়ে গেল…হলুদ বন আর কোথায়! মিষ্টির দোকানের সামনে। হারিয়ে ফেলল আমাদের দলের এক এবং অদ্বিতীয় গুবলেটেশ্বর ইন্দ্রকুমার। অপূর্ব সব মিষ্টি চাখার পরেও সুখ রইল না মনে।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। নিয়মমাফিক। আমাদের বেরিয়ে পড়ার দিন। ওই দিন ছিল মিশ্র সফর। মিষ্টি ও মন্দির। দীপু আর ইন্দ্রকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। সঠিক ভাবে বললে, ওরাই আমাকে নিয়ে বেরোয়। আমি যে বাইক-অক্ষম। ওরা বাইক চালাতে পারে। আমাদের লক্ষ্য ছিল মশাটের একটি দোকান। হুগলি জেলায়। দোকানটার নাম শুনেছি তিনজনের কাছ থেকে। জনাইয়ে বড় বোঁদে, নিখুঁতি খেতে গিয়েছিলাম। মনোহরার প্রাচীন ভান্ডার ললিত ময়রার দোকান। সেই দোকানে আড্ডা দেওয়া এক প্রবীণ জানিয়েছিলেন। পরে জানিয়েছিল নেট দুনিয়ার বন্ধু দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা। যাকে আমি কখনও চাক্ষুষ করিনি। ওর বাড়ি হুগলি জেলায়। তারও পরে খবর এল, ঘর থেকেই। আমাদের দলের গার্ডবাবু ওরফে সৌগত পাল ওরফে শুভ সংবাদ দিল। হুগলি জেলায় ওর শাখা-শ্বশুরবাড়ি। মাঝে মাঝে মধ্যে মিষ্টি আপ্যায়ন মেলে। সঠিক ব্যক্তি হলে একজনের সুপারিশেই চাকরি হয়। ত্রয়ী সুপারিশে বোধহয় পদোন্নতি-সহ নিয়োগপত্র দিয়ে দেবে। মিষ্টি-সফর জরুরি হয়ে পড়ল।

দোকানের চাপ দই।

মশাট বাজারেই দোকানটা। মোড়মাথার একদম কাছেই। লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। দোকানে দেখলাম বেশ ভিড়। জনপ্রিয়তার একটা বড় চিহ্ন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এই ভিড়ে কথা বলা যাবে না। দোকানদারেরাও বিরক্ত হতে পারেন। বিশাল শোকেসের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি দেখছিলাম তিনজনে। নতুন কিছু আছে নাকি? অন্তত বহিরঙ্গে দেখনদারি? তার পর স্বাদ বিচার হবেখন। যদিও আমাদের কাছে সুপারিশের একটি তালিকা আছে। তিনজনেরই সুপারিশ ছিল, এই দোকানের দই। খেতেই হবে। দীপ্তেন্দু দু’টো অতিরিক্ত নাম বলেছিল, শিঙাড়া আর ছানাঘাঁটা।

কোনটা আগে খাওয়া যায়? দই দিয়ে শুরু করা যাক। তার পর ছানাঘাঁটা। মাঝে আমাদের পছন্দ করা মিষ্টি। শেষে ঝাল ঝাল শিঙাড়া। দোকান ফাঁকা হতে দই কেনা হল। চামচে কেটে জিভে দিতেই বোঝা গেল সুপারিশের কারণ। চাপ চাপ দই। বেশ ঘন। তবে ক্ষীর দই নয়। তৃপ্তি হবে দই খেয়ে। ২০০ টাকা কিলো। ছানাঘাঁটার খোঁজ করতে দোকানদারদের এক জানালেন, এমন নামের কোনও মিষ্টি তাঁদের দোকানে নেই। ছানাঘাঁটাটা সম্ভবত ক্রেতাদের দেওয়া নাম, দীপ্তেন্দু এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। আমরাও শোকেস তন্ন তন্ন করে দেখেছি। ঘাঁটাঘাঁটির কোনও মিষ্টি দেখতে পাইনি। দোকানের একজন একটা ট্রে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এটা আছে।’’ সেটা আসলে মাখা সন্দেশ। আমরা খাইনি। সেদিন শিঙাড়াও পাইনি। শিঙাড়া সকালের দিকে হয়েছিল। শেষ হয়ে গিয়েছে। বিকেলের দিকে হবে? তাহলে ফেরার সময়ে চাখা যেত। সেদিন আর শিঙাড়া হবে না, জানালেন দোকানদারেরা।

রসমাধুরীর স্বাদ গ্রহণের অপেক্ষায়।

নতুন কোনও মিষ্টি খেতে গেলে আমরা একটা প্রশ্ন করতাম, ‘‘আপনাদের দোকানে কোন মিষ্টি ভাল?’’ প্রশ্নেই গলদ আছে। ফলে উত্তর পেতাম, ‘‘সব মিষ্টিই ভাল।’’ স্বাভাবিক। কেউ কারও পণ্য খারাপ বলেন! পরে প্রশ্ন পাল্টালাম, ‘‘আপনাদের দোকানে স্পেশাল কোনও মিষ্টি তৈরি হয়?’’ তাতে দোকানদারদের বিড়ম্বনা বাড়ত। বিশেষ মিষ্টি আর কত দোকানে হয়! পাল্টাতে পাল্টাতে এখন প্রশ্ন এসে ঠেকেছে, ‘‘আপনাদের দোকানে কোন মিষ্টি খদ্দেররা বেশি পছন্দ করেন?’’ মানে গণরুচি মেপে স্বাদ সন্ধান। লক্ষ্মীনারায়ণে অবশ্য নিজেরাই একটা মিষ্টি পছন্দ করেছিলাম। বহিরঙ্গে আকৃষ্ট হয়ে। দুধের লটে নিমজ্জিত হলুদ রঙা চৌকো মিষ্টি। দোকানে অনেকজন খদ্দের সামলাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন বললেন, ‘‘এটা রসমাধুরী।’’ খাওয়া হল। অপূর্ব স্বাদ। লট চমচম বা রসমালাই জাতীয় মিষ্টি।

আর কী খাওয়া যেতে পারে? এবার সাহায্য করলেন এক কর্মী। কেশর চাপ আর লেমন সন্দেশ খেয়ে দেখতে বললেন। আমাদের আগ্রহে সম্ভবত প্রভাবিত হয়েছিলেন। দু’টো মিষ্টির স্বাদই পছন্দ হল আমাদের। ইন্দ্র আর দীপুর ভাল লাগল লেমন চাপ। রসমাধুরী অনন্য তো ছিলই। খেতে খেতেই ওই কর্মীকে অনুরোধ করেছিলাম, কারও সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগ হবে কিনা? অনুরোধ রক্ষা হল। কথা বলতে এলেন স্বয়ং মালিক, প্রতাপচন্দ্র রায়।

কেশর চাপ। আঙুলে ধরা।

প্রতাপবাবু জানালেন, বছর সতেরো হল তাঁরা দোকানটি করেছেন। আমরা যে যে মিষ্টি খেয়েছিলাম সেগুলোর কুল পরিচয় দিলেন। রসমাধুরী আসলে কেশর রসমাধুরী। উপকরণ লাগে কেশর, ছানা আর মোষের দুধ। কেশর, ছানার মিশ্রণ নির্দিষ্ট করে পাক করতে হয়। তার পর চৌকো করে কেটে নেওয়া। আলাদা করে তৈরি করতে হয় দুধের লট। এই লট হয় বেশ ঘন। রসমালাই বা লট চমচমের রসসাগরের তুলনায় প্রতাপবাবুদের রসমাধুরীর দুধসায়র হয় বেশি ঘন। আর কেশর দেওয়ার কারণে রঙেরও বদল হয় দুধের। দামও সাধারণ মিষ্টির তুলনায় বেশি। ২০ টাকা প্রতি।

কেশর চাপ আসলে কেশর সন্দেশ। কাঁচা পাক অর্থাৎ নরম পাকের। ছানা, দুধ, চিনি আর কেশর হল মূল উপাদান। ছানা আলাদা করে কাটানো হয়। তার পর দুধে কেশর মিশিয়ে ফুটিয়ে ঘন করে তাতে ছানা দিয়ে পাক করতে হয়। পাক হয়ে গেলে নির্দিষ্ট আকারে কেটে নেওয়া। পেস্তা দেওয়া হয় কেশর চাপে।

লেমন চাপ। ইন্দ্র মুখে পুরতে হাত বাড়াচ্ছে।

লেমন চাপের পাক প্রণালী কেশর চাপের মতোই। দুধ ঘন করে লট তৈরি করে নেওয়া। সেই লটে ছানা ফেলে পাক করা। পাক নামানোর সময়ে লেবু দেওয়া হয়। বেশ স্বাদু মিষ্টি। ছানা গুণমান বোঝা যায়। লটের অস্তিত্বও। কেশর ও লেমন, দুই সন্দেশেই লটের ব্যবহার রয়েছে। প্রতাপবাবু বলছিলেন, ‘‘দু’টো সন্দেশের পাক মোটামুটি এক। কেশর দিলে কেশর চাপ। লেমন দিলেন লেমন চাপ। ক্যাডবেরি দিলে ক্যাডবেরি সন্দেশ।’’ দাম ১৫ টাকা প্রতি। দু’টোরই। এই দোকানের বিশেষত্ব হল, সব মিষ্টি হয় তাঁদের নিজস্ব ডেয়ারির দুধে। দোকানের প্যাকেটের গায়ে লেখাও আছে, ‘সুইটস মেড ফ্রম ওন ডেয়ারি মিল্ক’। ফলে ছানার এবং দুধের লটের গুণমান বজায় থাকে।

রসমাধুরী আগে কখনও খাইনি। খাওয়ার পরে একটু খোঁজখবর করেছিলাম। প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’ এবং বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মিষ্টান্ন পাক’এ পেলাম রসমাধুরী। প্রণব রায় পাক প্রণালী জানাননি। শুধু রসমাধুরীকে ‘রসের খাবার’ বলে উল্লেখ করেছেন। বিপ্রদাসে রসমাধুরী আছে পাক প্রণালী-সহ। পাক প্রণালী হল, টাটকা ছানা বেটে তাতে ক্ষীর আর ছোট এলাচের দানা গুঁড়ো করে মেশাতে হবে। ভাল করে মেশানো হলে মিশ্রণ ইচ্ছে মতো গোল, চৌকো আকার দিয়ে ঘিয়ে ভাজতে হয়। তার পর চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা। বিপ্রদাসের রসমাধুরী ভাজা এবং চিনির রসের। লক্ষ্মীনারায়ণের দুধের রসের। ভাজা নয়।

স্বাদ সুন্দর হল। কুল পরিচয় পেলাম। এবার মন্দির সফর। তখনই আবিষ্কার হল ইন্দ্র বাইকের চাবি হারিয়েছে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। দোকানের কর্মীরাও তল্লাশিতে যোগ দিলেন। কিন্তু চাবি মিলল না। ফলে দীপুকে নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা। তার আগে দাদাকে ফোন করে বলেছিল, অতিরিক্ত চাবিটা নিয়ে সে যেন এগিয়ে আসে। আমি ওদের হেলমেট নিয়ে দোকানের বেঞ্চে বসে রইলাম।

কভারের ছবি— দোকানের শোকেসে রসমাধুরী

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “রসমাধুরীর রসাস্বদনের পরে

  1. রসমাধুরীর উল্লেখ রয়েছে ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত দীনবন্ধু মিত্রের “কমলে কামিনী” নাটকে। ব্রহ্মদেশের রাজার বিরুদ্ধে মণিপুর রাজের সমর প্রস্তুতি কালে একটি চরিত্র বক্কেশ্বরের সংলাপ: ” এই অসিলতার মহিমায় আমি মোদকালয়ে বিনা মূল্যে মিষ্টান্ন ভক্ষণ করি, এই অসিলতার মহিমায় গোপাঙ্গনারা আমার উদর পরিমাণ ঘোল দান করে, এই অসিলতার মহিমায় পুরমহিলারা আমাকে ক্ষীরের ছাঁচ, চন্দ্রপুলি এবং রাধাসরোবর রসমাধুরী খাওয়াইতে বড় ভালবাসেন।”

    1. খুব ভাল তথ্য। লেখা সমৃদ্ধ হল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *