দীপশেখর দাস
এক জায়গায় ঘুরতে গিয়ে আরেক জায়গায় খোঁজ মেলে। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বললে। অথবা সমমনস্ক কারও সঙ্গে দেখা হলে। আমাদের দ্বিতীয়টা হয়েছিল। পাখি দেখতে বেরিয়েছিলুম একদিন। উদয়নারায়ণপুরের দিকে যাচ্ছিলুম। পথে এক চায়ের দোকানে দেখা সৌরভ দোয়ারী স্যারের সঙ্গে। ফেসবুকে পরিচয় ছিল। আর আমাদের দলের কাজকারবার নিয়ে তাঁর ধারণাও ছিল। তিনিই বলেছিলেন, আসন্ডা গ্রামে একটি প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির আছে।
পাখি দেখার ব্যস্ততায় সেদিন মন্দির দেখা হয়নি। বেরোতে হল আরেক মঙ্গলবার। সঙ্গী বড়দা মানে দীপকদা আর ছোটা ডন মানে বাবলা। আসন্ডা হাওড়া জেলাতেই পড়ে। উদয়নারায়ণপুর মোড়-রামপুর ছাড়িয়ে কুরচি সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। চেনা রুট। রামপুর পর্যন্ত যাতায়াত আছে। ২০১৭ সালের বন্যায় এদিকের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে এসেছিলাম। ইন্দ্রদা আর দীপকদার সঙ্গে দেখে গিয়েছিলাম দামোদর নদের তাণ্ডব। কুরচি সেতুতে ফাটল ধরেছিল। রামপুর সড়কের অনেক অংশে ধস নেমেছিল। লেবুতলা নামে একটা জায়গায় তো পাকা সড়কের অনেকখানি ধুয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল জলের স্রোত।
এবার একটা বাইকে তিনজনে বেরিয়েছি। ফলে গল্পগুজব, হাসিঠাট্টায় সকলেই অংশ নিতে পারছিলাম। আলাদা বাইক হলে দারুণ মজাগুলো একসঙ্গে উপভোগ করা যায় না। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম বলে চারপাশটা দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দীপকদা রিলে করছিল। আর বাবলা সায় দিচ্ছিল। ব্যাখ্যাও করছিল। ওরও এদিকটা চেনা। তবে কুরচি সেতু সারাই হয়েছে এটুকু দেখতে পেলাম। বড়দা বলল, সেতুর দু’পাশে জমিগুলোয় বন্যার পলিতে ভরে গিয়েছিল তখন। পাঁচ বছরে পলি সরেছে। চাষবাস ভালই হয়েছে। এদিকে চাষ ভালই হয়। লেবুতলার সেই জায়গাতেও সড়কের উপরে বন্যার কোনও ছাপ নেই।
রামপুরে এসে জিজ্ঞাসা করতেই হল। আসন্ডা কত দূর? জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, গ্রামটা ডিহিভুরশুটের মধ্যে পড়ে। হ্যাঁ, সেই ভুরশুট পরগনার ভুরশুট। যে পরগনায় জন্মেছিলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। প্রাচীন এক জনপদ। আমরা কথা বলে একটা স্থান-চিহ্ন পেলাম। রাস্তার পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়বে। তার পাশ দিয়ে আসন্ডা গ্রামে ঢুকতে হবে।
বিদ্যালয়ের চিহ্ন পেয়ে গ্রামের দিকে ঢুকলাম। রাস্তা থেকে একটু ভিতর দিকেই গ্রাম। ভিতর দিকে আরেকটি স্কুল আছে। এটা হাইস্কুল। তার পাশ দিয়ে ছোট জলাশয়, বাঁশবাগান পেরিয়ে মন্দির। রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে। মন্দিরটা দেখে আমরা অবাক। বহু প্রাচীন মন্দির। অসংখ্য টেরাকোটার কাজ মন্দিরের সারা শরীর জুড়ে। আমরা খুঁজে খুঁজে দেখলাম। পোড়ামাটির কাজগুলো। নৌকায় চাপা যাত্রী, রামায়ণের কাহিনি, ঘোড়সওয়ার নানা মূর্তি। আরও কাজ ছিল। কালের নিয়মে নষ্ট হতে বসেছে। কিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাঙা অংশ দেখেই সেটা বোঝা যায়। সংস্কারের অভাবে মন্দিরের গা থেকে অংশ আগাছা, লতাপাতা ঝুলে আছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সালটা দেখা যাচ্ছে। ১৭১১ শকাব্দ। উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা পড়ার সময়ে শকাব্দ থেকে খ্রিস্টাব্দের হিসেব শিখেছিলাম। হিসেব করে দেখলাম, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ বহু পুরনো মন্দির।
এতক্ষণ যা লিখলাম, তা তো খালি চোখে দেখা যায়। কিন্তু মন্দিরেরও তো একটা ইতিহাস আছে। সে সব কী ভাবে জানি! দীপকদা লোক খুঁজছিল। বাইক নিয়ে এক তরুণ যাচ্ছিলেন। তাঁর নাম রাজকুমার মেটে। তিনি শুধু বললেন, মন্দিরের নীচেও একটা ঘর আছে। রহস্যের সন্ধান? রাজকুমার আর কিছু বলতে পারলেন না। স্থানীয় এক ব্যক্তি আমাদের খোঁজখবর করতে দেখে কাছে এসে নানা কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘পিন্টু মাইতি এসব জানে।’’ কিছুক্ষণের মধ্যে ডেকেও নিয়ে এলেন পিন্টু মাইতিকে। তিনি মন্দিরের কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কাছ থেকেই মন্দিরের ইতিহাস জানলাম।
মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন ভুবনেশ্বর মাইতি নামে এক ব্যক্তি। তিনি নাকি বর্ধমান মহারাজের ‘গোমস্তা’ ছিলেন। মন্দির তৈরির পরে ৩০০ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি পেলেন বর্ধমানের মহারাজার থেকে। তখন এই জায়গাটা ছিল মাইতি পাড়া। এখন এই পাড়ায় বাইরি, আদক, মেটে ইত্যাদি পদবির লোকজন বাস করেন। তাঁরা একসময়ে মাইতিদের আত্মীয়তার সূত্রে এসেছিলেন এখানে। কেউ জামাই হয়ে বা কেউ অন্য সূত্রে।
মন্দিরের গোপন কক্ষের বিষয়টা কী? পিন্টুবাবু বললেন, মন্দিরের তিনটে ধাপ। ঢুকতেই শ্রীধরনাথে বেদির। বেদির ডানপাশ দিয়ে একটা দরজা। সেখান দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা যায়। মন্দিরের এই উপরতলায় শ্রীধরনাথের রাত্রিযাপন। বাঁ দিকেও একটা দরজা। এই দরজার পরের সিঁড়ি চলে গিয়েছে নীচের দিকে। মন্দিরের নীচের অংশে একটা ঘর আছে। কিন্তু ঘরটা তালা বন্ধ। ঘরের ভিতরে কী আছে তা নাকি কেউ জানে না। দাবি করলেন পিন্টুবাবু। মন্দিরের খিলান আর মূল মন্দিরের মাঝের ছাদটা দেখলাম অবতল। এখন প্রতিদিন দু’বার পুজো হয়। কিন্তু গোপন কক্ষটি কেন? সে রহস্য উদ্ধার হল না।
মন্দিরের পাশে একটি ছোট শিবমন্দিরও রয়েছে। জীর্ণ অবস্থা। প্রতিষ্ঠা সনটি ক্ষয়ে গিয়েছে। শুধু লেখা দেখতে পেলাম, ‘শুভমস্তু ১৭… সন’। কত? জানা গেল না। পিন্টুবাবু বললেন, শ্রীধর মন্দিরের কিছু বছর পরেই এই শিবমন্দির তৈরি হয়েছিল। দীপকদার মন্দির ছাড়াও গ্রামের নামের মানে জানার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কিছু মিলল না। এমন নামের মানে কী? পিন্টুবাবু একটা তথ্য দিলেন। কলকাতার বড়বাজারে নাকি চন্নার গুড়ের সুখ্যাতি আছে। এই চন্নার গুড় যেত আসন্ডা থেকে। আগে গ্রামে প্রচুর আখ চাষ হত।
আমাদের মনে হল, প্রাচীন কাল থেকে আসন্ডা গ্রাম সমৃদ্ধ। তার একটা প্রমাণ, বহু পুজো হয় এই গ্রামে। পিন্টুবাবু আমাদের গ্রামের রথও দেখালেন। স্কুল পেরিয়ে গ্রামে ঢোকার রাস্তাতেই রয়েছে রথটা। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে রথের সংস্কার করা হয়েছে।
পিন্টুবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। আমাদের দু’টো জিনিস দেখার ইচ্ছে। এক, নদী। দুই, হুগলি জেলা। আমাদের দলের ইচ্ছে, হাওড়া জেলার সব সীমানা দিয়ে অন্য জেলায় ঢোকা। পিন্টুবাবুর কাছ থেকে জেনেছিলাম, আর কিছুটা এগিয়ে গেলে নদীও পাব, হুগলিও পাব। কিছুটা খোঁজখবর করে পেলামও। জায়গাটার নাম যাদার ঘাট। নামের মানে জানি না। দীপকদাও খাবি খাচ্ছিল উৎস খুঁজতে। নাম যা-ই হোক না কেন যাদার ঘাট জায়গাটা অসাধারণ। এখানে অবশ্য নদী নয়। নদ, দামোদর। একটা বিশাল লম্বা বাঁশের সাঁকো নদের উপরে। সাঁকোটা হাওড়া-হুগলিকে জুড়েছে। সেদিনের আবহাওয়া ছিল বড় মনোরম। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়েছে ঝিরিঝির। আবার মেঘ সরে শরতের মতো আকাশ। মেঘের দল। নরম বিকেলে অসাধারণ লাগছিল নদের পাড়টা। সাঁকোর ঠিক নীচে দু’টো নৌকা বাঁধা আছে। চাপার উপায় নেই। সাঁকো পারাপারের জন্য যিনি টোল নিচ্ছিলেন তিনি জানালেন, নৌকা চালানোর মতো জল নেই এখন। আমরাও দেখলাম।
এপারে বেশ কিছুক্ষণ ছবি তুলে সাঁকোর উপরে উঠলাম। লোকে হেঁটে, সাইকেলে, বাইকে সাঁকো পার হচ্ছেন। খড়মড় করে আওয়াজ উঠছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের সারি। ওপারে চলে গেলাম। মানে হুগলিতে ঢুকলাম। ওপারে যেতেই বাবলা দাবি করতে শুরু করল, ‘‘এই জায়গায় আমরা আগে এসেছি।’’ এ আবার কী কথা! কবে এলাম? করোনার লকডাউনে ভুলে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। দীপকদারও বয়স হয়েছে। তা বলে এতটা ভুলে যাব? বাবলা বলেই চলল, ‘‘মনে করে দেখ, রাজবলহাটে মন্দির দেখে আমরা একটা ঘাটে এসেছিলাম। এটাই সেটা। আমরা আজ ওপারে এসেছি। সেবার এপারে এসেছিলাম। সাঁকো টপকাইনি বলে বুঝতে পারছি না।’’
আমরা প্রমাণ দাবি করলাম। বাবলা বলল, আরেকটু এগোলেই বাঁধের গা দিয়ে আমরা নেমেছিলাম দেখতে পাব। ঢালু হয়ে নেমেছে রাস্তাটা। এগিয়ে গিয়ে সত্যিই প্রমাণ পেলাম। কী মুশকিল! একটা সাঁকোর ওপার-এপার ঘুরতে এলাম দু’বার? তা-ও চিনতে পারছি না! এ তো টেনিদার গল্পের প্যালারামের মতো হয়ে গেল। যে নাকি পটলডাঙার বাইরে গেলে দিক ভুলে যায়। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠছে দাবি করে। প্রবল হাসাহাসি করতে করতে ফিরছিলাম। সাঁকোর উপরে দেখা হয়ে গেল খানচারেক বাচ্চার সঙ্গে। ওরা হুগলির। ঘুরতে বেরিয়েছে। আমাকে ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করল। ছবি তুলে দিলাম। ওদের সঙ্গে সেলফি তুললাম।
তখন সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। আকাশ লাল হয়ে গিয়েছে। চরা দেখা যাওয়া, শ্যাওলা ভরা দামোদরের জলে শেষ বিকেলের সূর্য বিশাল ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে। আকাশে আবার অন্য ক্যানভাস। তিনজনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম শুধু।
কভারের ছবি- সাঁকোর সন্ধ্যায়
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)