দীপক দাস
পানিফলের আর শিঙাড়ার সংস্কৃত নাম একই। শৃঙ্গাটক। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় বলছেন, পানিফলের মতো দেখতে হয় বলে এর নাম শিঙাড়া হয়েছে। নামের উৎস যা-ই হোক না কেন, একটা বিষয় পরিষ্কার, খাদ্যবস্তুটি প্রাচীন। সংস্কৃত নামে তারই ইঙ্গিত। সংস্কৃতের দিন গিয়াছে। ভাষাটি থেকে আরও ভাষার জন্ম হয়েছে। আর শৃঙ্গাটক শিঙ্গাড়া > শিঙাড়া হয়ে সিঙাড়া হয়েছে। শুধু উচ্চারণেই বদল হয়নি। খাবারটির জাতিগত ভেদও ঘটেছে। প্রায়ই আক্ষেপ শোনা যায়, বাঙালি শিঙাড়া তেমন আর পাওয়া যায় না। এখন সবই হিন্দুস্তানি শিঙাড়া। খাবার নিয়ে কোনও ভেদাভেদ কখনই পছন্দ নয়। রুচি কোনও দেশে কোনও কালে কোনও জাতির কুক্ষিগত থাকেনি।
তবুও বাঙালি শিঙাড়া কেমন তা চেখে দেখার জন্য শিঙাড়া সন্ধানে বেরনো হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। বেশি দূর শিঙাড়া সন্ধান করতে পারা যায়নি। হাওড়া জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
মাকড়দহ মোড়ে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডার। এই দোকানের মিষ্টি ভাল। দই ভাল। সেই সঙ্গে শিঙাড়ারও নাম রয়েছে। লক্ষ্মী ঘিয়ে ভাজা শিঙাড়া। আকারে তুলনামূলক ছোট। সুস্বাদু পুর দেওয়া হয়। ঘিয়ে ভাজার জন্য স্বাদ অন্য রকম হয়। খেতে বেশ ভাল। দ্রুত ফুরিয়ে যায়। দাম ১০ টাকা। একদিন সকালে আমি আর দীপু গিয়েছিলাম। দোকানে তখন ছিলেন বর্তমান মালিকদের অন্যতম স্বপন ঘোষ এবং তাঁর ছেলে রাহুল। স্বপনবাবু জানালেন, তাঁদের দোকানের শিঙাড়া পছন্দ করতেন গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং পান্নালাল ভট্টাচার্য। তবে তা ঘিয়ে ভাজা শিঙাড়া নয়। তাঁদের জন্য সরষের তেলে ভেজে দিতে হত শিঙাড়া। গায়কেরা হাওড়ার বসন্তপুরে ভারতমেলায় যেতেন। যাওয়ার পথে দোকানে ফরমাশ করে যেতেন সরষের তেলে ভাজা শিঙাড়ার জন্য। দোকানের মালিক সে ব্যবস্থা করে রাখতেন। দুই গায়ক ভ্রাতার সঙ্গে ঘোষেদের পারিবারিক সখ্যও ছিল। বাড়িতে আসতেন। মিষ্টির দোকানের মালিকদের পুকুরে ছিপ ফেলতেন। শিঙাড়ার সুনাম ধরে রেখেছে অন্নপূর্ণা।
অন্নপূর্ণায় শিঙাড়া সন্ধান করে বেরিয়ে আসছি রাহুলবাবু বললেন, মাকড়দহ বাজারের কাছে অজিতবাবুর তেলেভাজার দোকান আছে। এলাকায় বেশ নাম। আরেকটা কথা জানালেন রাহুলবাবু। অজিতবাবু একসময়ে অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্মী ছিলেন। রাহুলবাবুর দাদু অনন্তকুমার ঘোষের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি দোকান ছাড়েন। ছোট একটা তেলেভাজার দোকান খোলেন। এখন নাম আছে দোকানের। ভাল লাগল রাহুলবাবুর কথা। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, দোকানদারেরা কখনও অন্য দোকানের নাম সুপারিশ করেন না।
অজিতবাবুর দোকানে ঢুঁ মারা কর্তব্য। দু’জনে গেলাম। দোকানে বেশ ভিড়। খদ্দেরের আনাগোনা লেগেই আছে। ফাঁকা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলাম। দোকানে অজিতবাবু ছিলেন। মানে অজিত দাস। তাঁর কাছ থেকে দোকান খোলার কাহিনি শুনলাম। সে কাহিনিতে এলাকার আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের একটা সূত্রও রয়েছে। দোকানের সূত্রপাতটা রাহুলবাবুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। কিন্তু দোকানটা খুলেছিলেন কোন ক্রেতাদের ভরসায়? অজিতবাবু জানালেন, সেই সময় মাকড়দহের শ্রীমানী পাড়া, চৌধুরী পাড়ায় অ্যালুমিনিয়মের কাজ হত প্রচুর। ওই কারখানার কর্মীরা জলখাবারে তাঁর দোকান থেকেই মুড়ি-তেলেভাজা কিনতেন। আর কিনতেন মাকড়দহের হাটুরে আর বাজাড়ুরা। এখনও মাকড়দহে সোম-শুক্রবার হাট বসে। বাজারে বসে প্রতিদিন। অ্যালুমিনিয়মের কাজ এখন প্রায় বন্ধ। তাতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু হাট-বাজার আছে। তাছাড়া এলাকাও এখন জমজমাট। বাসিন্দারাও তাঁর খদ্দের। ফলে দোকান চলছে ভাল। সকাল ৬টায় দোকান খোলেন। বন্ধ হয় রাত ১০টায়। তেলেভাজার দোকান সারাদিন খোলা এমনটা খুব বেশি দেখা যায় না।
আমরা খুঁজতে এসেছি শিঙাড়া। অজিতবাবু জানালেন, শিঙাড়া তাঁদের দোকানে পরের দিকে যোগ হয়েছে। আদিপর্বে চপ, ফুলুড়ি, বেগুনি মুড়িই ছিল প্রধান। এখন যোগ হয়েছে জিলিপও। বিকেলের দিকে ক্যাপসিকামের চপ, ভেজিটেবল চপও পাওয়া যায়। অজিতবাবুর দোকানের শিঙাড়া কেমন? পাতলা ছাল। আকারে তুলনামূলক ছোট। অন্নপূর্ণার শিঙাড়ার মতোই। দীপু আর ওর বোন নন্দিতা স্বাদ বিষয়ে মতামত দিল, পুর মাখাও নয়, ঝুরোও নয়। একটা মশলার আধিক্য আছে। খেতে ভাল। দাম ৬টাকা।
বড়গাছিয়ার যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডারের শিঙাড়ার নাম বহুদিনের। ছোটবেলা থেকে খেয়ে আসছি। ইয়াব্বড় শিঙাড়া। দাম বরাবরই এই তল্লাটের শিঙাড়ার থেকে বেশি। একটা খেলে আর কিছু খাওয়ার উপায় থাকত না। মাঝে অনেকদিন খাওয়া হয়নি। এদিন গেলাম দু’জনে। রূপের কিছু বদল হয়েছে যশোদার শিঙাড়ার। আগে খাস্তা ছিল শিঙাড়ার বাইরের আবরণ। এখন সাধারণ শিঙাড়ার মতো হয়েছে। দোকানের মালিক পক্ষের অন্যতম ছোটু বললেন, শিঙাড়ার যিনি কারিগর তিনি মারা গিয়েছেন। তবে স্বাদের কোনও বদল হয়নি। মশলারও নয়। যশোদার শিঙাড়ার পুরের স্বাদ বরাবরই অন্যরকম। এখনও সে রকমই আছে। দাম ১২ টাকা। এই দোকানের আরেকটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শিঙাড়া দোকানে খেলে সঙ্গে একটা চাটনি দেওয়া হয়। চাটনিটা নিজেরাই তৈরি করে নেন। উপকরণ বলছিলেন ছোটু। মেথি পাতা, আম আদা, টম্যাটো আর মশলা চিনির রসে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। দারুণ লাগে শিঙাড়ার সঙ্গে।
বড়গাছিয়ারই আরেক মিষ্টির দোকান শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভান্ডার। এঁদের শিঙাড়াও বেশ ভাল। মোটা ছালের শিঙাড়া। মাখা পুর। আগে সকাল-বিকেল দু’বেলাই ভাজা হত। মালিক রবিন লাঙল বললেন, এখন শুধু বিকেলে ভাজা হয়। শিঙাড়া ১০ টাকা দাম।
জগৎবল্লভপুর ব্লকের নিজবালিয়া বাজারে একটা তেলেভাজার দোকান আছে। নামহীন দোকান। দোকানের মালিক লক্ষ্মীকান্ত কর্মকার জানালেন, ৪৫ বছরের দোকান। আগে ছিল বিশ্বনাথ মল্লিকের। তাঁদের থেকে বছর ১৫ আগে কিনে নেন লক্ষ্মীকান্তবাবু। দোকানে সকালে পরোটা, ডিমের কারি ইত্যাদি তৈরি হয়। বিকেলে তেলেভাজার আইটেম। এই দোকানের শিঙাড়ার ছাল মোটা এবং শক্ত। পুরটা বেশ ভাল। অন্যরকম খেতে লাগল। এই শিঙাড়া সফরে যোগ দিয়েছিল ছোটা ডন বাবলা আর নন্দিতা। দু’জনেই পুরের অভিনবত্ব স্বীকার করল। দাম ৬ টাকা।শিঙাড়ার সঙ্গে স্যালাডও দিলেন লক্ষ্মীকান্তবাবু।
একদিন বিকেলে কোনও এক সফর থেকে ফেরার পথে পাতিহাল স্টেশনের এক মিষ্টির দোকানে শিঙাড়া খেয়েছিলাম। মা তারা মিষ্টান্ন ভান্ডারে। ছোট আকার। কিন্তু পুরটা একেবারেই আলাদা। আলুর টুকরো, মশলা, মটর কড়াই দেওয়া। সকলেই সকলের সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু নিজস্বতা বজায় রেখেছে। আলাদা করে প্রত্যেককে দেখা যায় এবং বোঝা যায়। ৬ টাকা দামের এই শিঙাড়ার সঙ্গে এতদিন ধরে শুনে আসা বাঙালি শিঙাড়ার অসাধারণ মিল লক্ষ্য করে আপ্লুত হয়েছিলাম। একদিন আমাদের সঙ্গে গিয়ে নন্দিতাও খেয়ে এল। বেশ চাহিদা দেখলাম শিঙাড়ার। অনেকেই কিনতে আসছিলেন। কিন্তু শিঙাড়া শেষ। এ দোকানে শিঙাড়া বিকেলে দু’বার ভাজা হয়।
বাঙালি শিঙাড়া আর হিন্দুস্তানি শিঙাড়ার বিষয়টি কী? শোনা অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু মনে হয়েছে, ছোট আকার, খাস্তা এবং চটকানো নয় প্রতিটি উপকরণ বোঝা যায় এমন পুরের শিঙাড়াই বাঙালি শিঙাড়া। অন্নপূর্ণার স্বপনবাবু, অজিতবাবু বা বেলের লক্ষ্মীকান্তবাবু এবং পাতিহালের মা তারা সকলেই দাবি করলেন তাঁদের শিঙাড়া বাঙালি। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তবাবুদের দোকানের মোটা শক্ত ছালের শিঙাড়াকে কী ভাবে বাঙালি বলব? বা মাখা পুরের শিঙাড়াকে?
সন্দেহ নিরসনে গুরুজনদের শরণ নেওয়া যাক। প্রণব রায় বলছেন, পাক প্রণালীতে শিঙাড়া তিন রকমের। বিশেষ ভাবে তৈরি শিঙাড়া। যাতে আলু ও মশলার সঙ্গে বাদাম, কিসমিস, নারকেল ইত্যাদির পুর দেওয়া হয়। আরেক রকম শিঙাড়া তৈরি হয় শীতকালে। ‘মটরশুঁটির কচুরির মতো’। ফুলকপির মরসুমে পুর হয় আলু-ফুলকপি। আর শাস্ত্রে মাংসের পুরের শিঙাড়ার উল্লেখ আছে। সাধারণ দোকানে প্রথম প্রকারের শিঙাড়া পাওয়া মুশকিল। দামে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। নারকেল দেওয়া শিঙাড়া খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। শীতকালে ফুলকপির শিঙাড়া প্রায় সব দোকানেই হয়। অন্নপূর্ণা, যশোদা সব জায়গাতেই। প্রণব রায় বাংলার শিঙাড়ার বিবরণই নিশ্চয় দিয়েছেন? মোটা ছালের বিষয়ে লক্ষ্মীকান্তবাবু বলছিলেন, ময়দা মাখার সময়ে ডালডার ময়ান দিলে আর শিঙাড়া ভেজে নামানোর আগে আঁচ গনগনে রাখলে ছাল মোটা হয়।
বিপ্রদাসে শিঙাড়া তৈরির পুর আবার দু’রকম। আলু সিদ্ধ করে খোলা ছাড়িয়ে অল্প চটকে নিতে হয়। তাতে কালো জিরে, মরিচ ও জয়িত্রীর গুঁড়ো বা ছোট কুঁচো মেশাতে হয়। তার পরেই তিনি বলছেন, ‘সচরাচর বাজারে যে শিঙাড়া প্রস্তুত হয়, তাহাতে পুরের আলু কুটিয়া, ঘৃতে ভাজিয়া লওয়া হইয়া থাকে, তাহাতে কোন প্রকার মসলা দেওয়া হয় না’। অর্থাৎ শিঙাড়ায় হিন্দি বাঙালিতে তফাৎ খুব বেশি নেই। বিপ্রদাস লিখেছিলেন ১০০ বছর আগে। তখন বোধহয়, শিঙাড়ার জাতিভেদ নিয়ে এত চিন্তা ছিল না।
ও হ্যাঁ, মাংসের পুর দেওয়া শিঙাড়ারও খেয়েছি। মাংসের সঙ্গে ক্যাপসিকামও ছিল। রানিহাটি মোড় থেকে কিছুটা ঢুকে আমতার রাস্তার দিকে পেট্রোল পাম্পের কাছে দোকানটা। একটা চায়ের দোকানের পাশে। সে দোকানের চায়েরও নাকি বেশ সুনাম।
চা-পান উতোর পর্ব পরে একদিন হবে।
ছবি— দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)
বাঙালি- অবাঙালি সিঙাড়ার পার্থক্য কিছুটা টের পেয়েছি। এখন আর বিশ্লেষণ করতে পারব না যদিও।
তবে ক্ষীরের সঙ্গে কাজু, কিসমিস, আখরোট, পেস্তা মাখা আর মোটা সরের মোড়কে পোরা সিঙাড়া খেয়েছি নকুড় নন্দী-গিরীশ দে’র দোকানে। আর একবার, বেড়াতে গিয়ে রান্নার ঠাকুর বুড়ো আঙুল প্রমাণ সিঙাড়া বানিয়ে দিয়েছিলেন। ভেতরে ফুলকপি, অল্প আলু আর মশলার অপূর্ব হৃদ্যতা, ওপরে পোস্তপাত। মোড়কটিও পুরের মতন নরম এবং খাস্তা ভাবটিও দিব্যি ছিল। যেন মুখে পড়তেই গলে গেল!..অমনটা আর কখনো খাইনি। তখন রেসিপি জানার একটু আধটু চেষ্টা করেছি, কিন্তু স্বাদ ছাড়া সব অধরা।
সিঙাড়ার বাঙালিয়ানা বা বিহারিয়ানা ইত্যাদি এই নিজের করে নেওয়ার দিক থেকেই মনে হয়। সঙ্গে থাকা আচার বা চাটনিতে এটা আবার প্রবল। বেলুড়ে থাকতে বিহারী ঠাকুরের দোকানের সিঙাড়া খেয়েই বলতাম, নাঃ এ আমাদের মতন নয়। মারোয়াড়ীদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে!..তখন অত কারিকুরি বুঝতাম না ফলে বিচার বিশ্লেষণে আটকাব। আমাদের মতন নয়, অর্থে বাঙালির হাতের সিঙাড়াই এখনও পর্যন্ত ভালো লেগেছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও, ফুচকাও বাঙালি হাতেই ভালো লেগেছে। মারোয়াড়ীদের এই ফুচকা, চাট বড্ড চড়া আয়োজনের। চোখে দেখলেই চাখার স্বাদ উধাও। অথচ স্হানীয় বাঙালি ক্রেতার কাছে যথেষ্ট চাহিদা। এখানে আবার রুচিভেদে খাদ্যভেদ।
এটাই বুঝতে চাইছিলাম। প্রাচীন তথ্য যা বলছে তাতে জাতিগত নয়, পুরগত পার্থক্য রয়েছে। এই তথ্যগুলো লেখাকে সমৃদ্ধ করল।
আরেকটা বিষয়, বুড়ো আঙুলের মতো শিঙাড়া আমাদের গ্রাম পাতিহালেই হত। একজন করতেন। ধামায় করে পাশের গ্রামের বাজারে নিয়ে যেতেন। ১০ পয়সা আর ২৫ পয়সা দাম ছিল। বিক্রেতা নাম দিয়েছিলেন হইহই শিঙাড়া। ছোটবেলায় খেয়েছি। ভাল খেতে ছিল।