বেলিয়াতোড়
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মেচা নামের মিষ্টিটি

দীপক দাস

মেঝের উপরে যেন ফুল ফুটে আছে। মিষ্টি-ফুল। ঘিয়ে রঙের। বাল্বের মতো। ফুলগুলো আসলে মেচা। এক ধরনের মিষ্টান্ন। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের স্বনামধন্য। মিষ্টিমহলের স্থানিক অথচ খ্যাতিমান মিষ্টিদের অন্যতম।

শায়েররা শায়েরি পড়ার আগে মহল তৈরি করেন। স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরাও। বেলিয়াতোড় নামার পরে সেই মহল তৈরি হয়ে গিয়েছিল মনে মনে। মেচা মহল, আসল মেচা, চায়ের দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা চাঁছির মেচা দেখতে দেখতে মেচার জন্মভূমিতে আগমনের আনন্দ হচ্ছিল। সামান্য দুঃখবোধও ছিল। মেচা মহলে যে আমি একক যাত্রী। দিনটা ১৫ অগস্ট। সঙ্গীসাথীরা নানা কাজে ব্যস্ত। ফলে একাকী গমন।

সুনাম করেছে এমন এবং আদি দোকানের নাম জানাই ছিল। বেলিয়াতোড় বাসস্ট্যান্ডের প্রতীক্ষালয়ে বসা লোকজনের থেকে শুধু দোকান দু’টোর অবস্থান জেনে নেওয়া গেল। একটা দোকান কাছেই। রাস্তার উপরে, লালু চা। অন্যটি হরিদাস দে মোদক। বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতর দিকে যেতে হবে। প্রথমে ‘লালু চা’য়ে গেলাম। দোকানে দু’টো সাইনবোর্ড। একটা ‘লালু চা’। আরেকটা বোর্ড তার উপরে। তাতে লেখা, ‘লালু মেচা চাঁছির মেচা পাওয়া যায়’। এই দোকানেই ঢুকে মেঝের উপরে মেচার ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। মেচা তৈরি হচ্ছে জোরকদমে। দোকানে ভিড় ছিল। লালুবাবু খদ্দের ছাড়তে ব্যস্ত ছিলেন। আমার প্রবল খিদে পেয়েছিল। সেই কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছি। বাসের পর বাস পাল্টানোয় রাস্তায় একটা কেক আর জল ছাড়া কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। লালুবাবুর থেকে ভাতের হোটেলের খোঁজ নিয়ে জঠরাগ্নি ঠান্ডা করতে গেলাম।…

তৈরি হচ্ছে মেচা।

লালুবাবুর ভাল নাম লালমোহন রায়। মোদক নন, জাতে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়ের মিষ্টির দোকান এই প্রথম দেখলাম। বললামও তাঁকে। হাসলেন। তার পর বললেন, ‘‘কী করব, পরিস্থিতি।’’ লালুবাবু প্রথমে চায়ের স্টল দিয়েছিলেন। বেলিয়াতোড়-দুর্গাপুর রোড বাসস্ট্যান্ডের কাছে। চায়ের নাম হয়। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ে। ২০০০ সালে দোকান করেন। চায়ের দোকান হওয়ার বছর পাঁচেক পরে মেচা তৈরি করা শুরু করেন। লালুবাবুর কথায়, ‘‘মেচার মান পড়ে যেতে শুরু করেছিল। মনে হল ভাল জিনিস তৈরি করা দরকার। যাতে বেলিয়াতোড়ের সুনাম বজায় থাকে।’’ এঁর দোকানে মালাই চা এবং লস্যিও পাওয়া যায়।

মেচা তৈরির পাকপ্রণালী বললেন লালুবাবু। প্রধান উপকরণ ছোলার বেসন। এই বেসন দিয়ে গাঠিয়া তৈরি করে তা ময়দার মতো পেস্ট করে নিতে হয়। এর সঙ্গে মেশে চাঁছি। দুধ জ্বাল দিয়ে সর তুলে তৈরি হয় চাঁছি। আর লাগে ছানা। সুগন্ধী হিসেবে মেশে এলাচ। কিছুটা কাজু ডাস্ট মেশানো হয়। সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে একটা মণ্ড পাক করে নেওয়া হয়। মণ্ডকে লাড্ডুর মতো পাকিয়ে নেওয়া। তার পর এই গোল লাড্ডু ঘন কাইয়ের মতো চিনির রসে ডুবিয়ে রেখে দেওয়া মেঝেয় বিছানো কাপড়ে। শুকিয়ে গেলে গোল্লার উপরে চিনির একটা ঠুলির মতো আস্তরণ পড়ে। তৈরি হয়ে গেল মেচা। লালুবাবু জানালেন, আগে নাকি মেচা এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত রাখা যেত। এখন দিন দশেক রাখা যায়।

লালুবাবুর দোকান।

লালুবাবু মেচার ইতিহাস তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, মল্লরাজাদের প্রিয় ছিল এই মেচা। তাঁর নতুন দোকান। ইতিহাস বিষয়ে বেশি ধারণা না-ও থাকতে পারে। সে জন্য পুরনো দোকানে যাওয়া দরকার। সেই দোকানটা ভিতরের দিকে। বেলিয়াতোড় ধর্মতলায়। দোকানের নাম নারায়ণী মিষ্টান্ন ভান্ডার। পাঁচ পুরুষের মিষ্টির ব্যবসা। দোকানের গায়ে লেখা, ‘শ্রীদাম মোদকের আদি মেচা মহল’। তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। দোকানের ঝাঁপ ফেলা। যাহ, আদিতে খোঁজ না নিলে যে মেচার আদ্যোপান্তে ফাঁক থেকে যাবে! দোকানের পাশে এক ভদ্রমহিলা জল নিচ্ছিলেন। তাঁকে বলতে ডেকে দিলেন হরিদাস দে মোদককে। তিনি তখন চান করছিলেন।

চান সেরে ফিরতে ভিতরের গেট দিয়ে দোকানে ঢোকা গেল। ভিতরে বড় বড় ঝুড়িতে মেচা রাখা। কিনলাম। তার পর শুরু হল মেচার উৎস ও উৎপত্তি সম্পর্কে খোঁজখবর। কে প্রথম মেচা তৈরি করেছিলেন? হরিদাসবাবু জানালেন, ‘‘আমার বাবা শ্রীদাম মোদককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনিও তাঁর বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কে প্রথম মেচা তৈরি করেছিলেন সেটা জানা নেই কারও।’’ মেচার উৎপত্তি নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত রয়েছে। সেটা মল্লরাজাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। গল্পটি এরকম, সপ্তদশ শতকে কোনও কারণে দুধের জোগানে টান পড়ে। এদিকে মল্লরাজাদের পাতে মিষ্টি তো দরকার। সম্ভবত ১৬২৫-৩৫ সালের মধ্যে কোনও মোদক বেসন দিয়ে সন্দেশ তৈরি করেন। (বাঁকুড়া-বর্ধমানের মিষ্টিকথা- আশিসকুমার দত্ত, এবং জলঘড়ি)।

চিনির রসে ডোবানো হচ্ছে মেচা।

এই রকম কোনও গল্পের কথা জানা নেই বললেন হরিদাসবাবু। যুক্তির দিক থেকেও মল্লরাজাদের সঙ্গে মেচার যোগসূত্র কি সম্ভব? মল্লরাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে এখন বাসে বেলিয়াতোড় আসতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগে। তখন আরও বেশি লাগত স্বাভাবিক ভাবে। এত দূর থেকে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া একটু অস্বাভাবিক। বিশেষ করে রাজারা তাঁদের প্রয়োজন মতো নবশায়ক সম্প্রদায়কে (তাঁতি, মোদক, কুমোর ইত্যাদি ন’টি জীবিকা নির্ভর সম্প্রদায়) বসতের কাছাকাছি জমি দিতেন। রাজা কেন, বড় জমিদারেরাও একই কাজ করতেন। ফলে বিষ্ণুপুর ছেড়ে বেলিয়াতোড়ের মোদকদের উপর রাজার নির্ভরতা কি সম্ভব? বিষ্ণুপুরের মিষ্টিও ভাল। মতিচুরের লাড্ডুর নাম তো এখনও শোনা যায়। হতে পারে বেলিয়াতোড়ের মোদকেরা উদ্ভাবনী প্রতিভার জন্য মল্লরাজাদের প্রিয় ছিলেন। তাই হয়তো মেচার উৎপত্তির সঙ্গে মল্লরাজাদের নাম জুড়ে গিয়েছে।

হরিদাস দে মোদকের দোকানের মেচা।

তা হলে মেচার উৎপত্তি হল কী ভাবে? হরিদাসবাবু একটা ঘটনার কথা বললেন। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সিঁড়ির নাড়ু তৈরি করতেন। সিঁড়ির নাড়ুর মূল উপাদান হল গুড় আর ছোলার বেসন। বেসন দিয়ে ঝুরি ভাজা হয়। এই ঝুরি ভাজা বেশ মোটা মোটা এবং বেশি লম্বা। ঝুরিগুলো গুড়ে পাক করে গোল করে নিলেই সিঁড়ির নাড়ু তৈরি। সিঁড়ির নাড়ু বাঁকুড়ায় টানা নাড়ু নামেও পরিচিত। এক সময় সিঁড়ির নাড়ু লোকে খেতে চাইত না। বেলিয়াতোড়ের মোদকেরা চিন্তাভাবনা করলেন। তখনই হয়তো কোনও মোদক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দেন। মূল উপকরণ এক রেখে অতিরিক্ত কিছু যোগ করেন। মূল উপাদান বলতে ছোলার বেসন। তা দিয়ে ঝুরির বদলে গাঠিয়া তৈরি করা। আর যোগ করা সরচাঁছি, ছানা। সুগন্ধী হিসেবে এলাচ। গুড়ের বদলে যোগ হল চিনির কোটিং। লোকে পছন্দ করতে শুরু করলেন। হয়তো ভাল লেগে গিয়েছিল মল্লরাজাদের। তাঁদের জন্য এই শুকনো মিষ্টি পাঠানো হত।

ডানদিকে লালুর মেচা। বাঁ দিকে হরিদাস দে মোদকের মেচা।

হরিদাসবাবুর বলা এই কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতার সমর্থন মিলবে মিষ্টিমহলের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণে। মিষ্টি বরাবর তার রূপ বদলেছে। আদি মিষ্টির মূল উপকরণ ছিল গুড়, দুধ, পরে চিনি। এর সঙ্গে কিছু ভাজা মিষ্টি। আর শস্য ব্যবহারে তৈরি মিষ্টির প্রচলন ছিল। শস্যের মিষ্টির উদাহরণ, মুগের জিলিপি, সিঁড়ির নাড়ু। ভাজা মিষ্টি রসবড়া, আনন্দনাড়ু। দুধ, ক্ষীরের মিষ্টির উদাহরণ প্রচুর।

সময় এগিয়েছে। মিষ্টির সঙ্গে মিলেছে নানা উপকরণ। ছানা আবিষ্কারের পরে তো বাঙালির মিষ্টির জগৎটাই পাল্টে গেল। আগে দোকানে দোকানে মিলত চিনির সন্দেশ। ছানার সন্দেশ আসার পরে ধীরে ধীরে এ সব পুজোর মিষ্টি হয়ে গেল। লোকে খেত না। বেলিয়াতোড়ের মোদকেরাও কি ছানা আবিষ্কারের পরে মিষ্টির ফিউশন ঘটালেন? সিঁড়ির নাড়ুর উপকরণের সঙ্গে মেশালেন ছানা, চাঁছি? নাকি আগে চাঁছি মিশিয়েছিলেন? পরে ছানা? ছানা, চাঁছি মেশানোর কারণে কি মনোহরার মতো চিনির কোটিং যোগ করলেন মেচায়? দুধ জাত উপকরণ বেশিদিন টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল যে! এগুলো অনুমান মাত্র। সঠিক উত্তর খোঁজা মুশকিল। সিঁড়ির নাড়ু এখনও মেলে। হরিদাসবাবু বললেন, তাঁদের দোকানে পুজোর সময়ে তৈরি হবে সিঁড়ির নাড়ু। মোটা ঝুরিগুলো গুড়ের পাকে সিঁড়ির মতো ধাপ ধাপ হয়ে থাকে বলে এমন নাম। মেচার জন্মবৃত্তান্তের আন্দাজ পেলেও নামকরণের উৎস খুঁজে পাইনি। মেচা শব্দের মানে কী?

হরিদাস দে মোদক। আমার মেচার প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে।

এখন বেলিয়াতোড় বাসস্ট্যান্ডের পাশে আসল মেচা, মেচা মহল নামধারী নানা দোকান। তবে মেচার উৎপত্তি সম্ভবত একটু ভিতরের দিকে। যেখানে হরিদাসবাবুর দোকান। ঠিকানা বেলিয়াতোড় ধর্মতলা, চৌমাথা। এটাই বেলিয়াতোড়ের আদি বাজার। সময়ের সঙ্গে বসতি বাড়ায় এখন গলি মতো হয়ে গিয়েছে জায়গাটি। এদিকে সড়কের উন্নতি হয়েছে। চৌমাথার দোকানগুলো ধীরে ধীরে বড় রাস্তার ধারে উঠে যাচ্ছে। হরিদাসবাবুও বড় রাস্তার পাশে দোকান দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের পা ভেঙে যাওয়ার পরে দু’টো দোকান চালাতে পারেননি। চৌমাথার আদি দোকানটা রেখেছেন। তাঁর দোকানের নাম আছে। বিভিন্ন খাদ্য উৎসবে যোগ দেন হরিদাসবাবু। দোকানে খাদ্য উৎসবে যোগদানের শংসাপত্র ঝুলতেও দেখলাম।

মেচার স্বাদ নিতে নিতে ছবি।

ও হ্যাঁ, একটা কথা বলার। বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা চাঁছির মেচা সম্ভবত ব্যবসায়িক কৌশল। কারণ মেচার মূল উপকরণ হল গাঠিয়ার গুঁড়ো। আর চাঁছি মেচায় প্রথম থেকেই মেশানো হয়। বলছিলেন হরিদাসবাবু।

কভারের ছবি— লালু চা দোকানের মেচা

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “মেচা নামের মিষ্টিটি

  1. আহা!.. চমৎকার অনুসন্ধান আর বিশ্লেষণ!

    1. ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম। ভরসাও। মনে হল এই দিক দিয়ে দেখা যেতে পারে উৎপত্তির বিষয়টা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *