খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

সিরমল, সুহারির স্বাদে সুহানা সফর

পৌলমী রক্ষিত

খুব পুরনো কথা। ছোটবেলায় শিখেছি। বহু রচনায় সেই শিক্ষা প্রয়োগ করেছি। এখনও করি। ভারত হল এক বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দেশ। অন্য বৈচিত্রের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। আজ খাদ্য বৈচিত্রের কথাই মনে পড়ছে। থালা ভর্তি খাবার যে! নানা রাজ্যের খাবার। নোনতা, মিষ্টি, রুটি, লুচি কত রকম। স্বাদ সন্ধান হয়েছে কেরল থেকে গুজরাত পর্যন্ত। সবই সহকর্মীদের দৌলতে।

আমার গুজরাতি সহকর্মীর দৌলতে প্রথমবার একটি গুজরাতি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হই। শব্দটা হল ফারসান। ফারসান বলতে তাঁরা ডুবো তেলে ভাজা যে কোনও খাবার বোঝান। শিঙাড়া, আলুড়ি, পিঁয়াজি সবই ফারসান পরিবারের সদস্য। পরিবারের কোনও সদস্যের পাড়ায় সুনাম থাকে। ফারসান পরিবারেও বিখ্যাত সদস্য রয়েছে। যেমন, ‘টমটম’। মোটা কাঠি ভাজার মতো দেখতে হলেও খেতে কিন্তু একদম অন্য স্বাদের। এই নোনতা খাবারটি বেসন, তিল, মৌড়ি, ময়দা, গোলমরিচ দিয়ে তৈরি হয়। সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রকমের মশলা।

জনপ্রিয় ফারসান টমটম।

গুজরাতের বরোদা শহরের আরেকটি বিখ্যাত ফারসান হল ‘লিলো চিওরো’। ‘চিওরো’ কথাটা শুনে মনে হয়েছিল চিড়ে দিয়ে তৈরি কোন খাবার হবে হয়তো। পরে দেখলাম না, বস্তুটা সম্পূর্ণ আলাদা। আদতে ঝুরো আলু ভাজা। তার সঙ্গে ছোলার ডাল, কিসমিস, চিনি মেশানো থাকে। এই ফারসান স্বাদে বেশ মিষ্টি।

গুজরাত এবং মহারাষ্ট্রের আরেকটি বিখ্যাত খাবার হল বাখারওয়ারি। বাখারওয়ারির বাইরের খোল বেসনের তৈরি। কিন্তু ভিতরে পুর হিসাবে থাকে শুকনো নারকেল, তিল, ধনে এবং আরও নানা ধরনের মশলা। টমটমের তুলনায় বাখারওয়ারি বেশি মশলাদার। পেটরোগাদের পক্ষে একটি যথেষ্ট।

বাখরওয়াড়ি।

থাকি দিল্লিতে। রাজধানীর খাবারের কথা না বললে চলে! উর্দুভাষী সহকর্মী মানুষটি আদতে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। পড়াশোনা এবং পরে চাকরির সূত্রে তিনি দিল্লিতেই থেকে যান। জামা মসজিদের পাশে যত খাবারের ভাল দোকান আছে সে সবের খোঁজ পাওয়া যায় তাঁর কাছে। তিনি আমাদের প্রথম সিরমল রুটি খাইয়েছিলেন। দেখতে কিছুটা তন্দুরি রুটির মতো হলেও সিরমলের স্বাদ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। বেশ মিষ্টি রুটি এই সিরমল। দিল্লির প্রবল ঠান্ডায় সিরমল রুটি আর খাসির মাংসের ঝোল একদম মানানসই। জামা মসজিদের কাছে বা শাহিনবাগের কিছু স্থানীয় বেকারিতে এই রুটি পাওয়া যায়। নির্দ্বিধায় বেশ কয়েকদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

স্বাদু সিরমল।

দিল্লির আরেকটি খাবারের কথা বলব, তার নাম হল সুহারি। আদতে চালের লুচি হল এই সুহারি। চালের গুঁড়ো আটার মতো মেখে লুচির মতো ভাজা হয়। আমার সহকর্মী জানান, ‘‘ইদের অন্যতম প্রধান খাবার হল এই সুহারি, সঙ্গে থাকতে হবে সিমাই।’’ আমি সেদিন অফিসে বোঁদে নিয়ে গিয়েছিলাম। সুহারি আর বোঁদে একসঙ্গে ‘সুনেহরি’ হয়ে উঠেছিল। তবে সিরমল স্থানীয় দোকানে পাওয়া গেলেও সুহারি কিন্তু সহজে মিলবে না। বরং এটি অনেক বেশি ঘরোয়া খাবার। তবে সিরমল যেরকম মিষ্টি রুটি, সুহারি কিন্তু তা নয়।

সুহারি। চালের গুঁড়োর লুচি।

কয়েকদিন আগে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশের আমার এক সহকর্মী বিভিন্ন মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। তার মধ্যে ছিল পেস্তা বরফি, ধনিয়া বরফি, ড্রাইফ্রুট বরফি। এই পেস্তা বরফি সাধারণত মেওয়া, পেস্তা, চিনি, ঘি দিয়ে তৈরি হয়। ড্রাইফ্রুট বরফিতে থাকে হরেকরকমের বাদাম, নারকেল, ঘি। কিন্তু আমার সবথেকে আলাদা লেগেছিল ‘ধনিয়া বরফি’। আগে কোনদিন এই জিনিস খাইনি। আমার এই সহকর্মীটি জানিয়েছেন জন্মাষ্টমীর রাতে যে ভোগ নিবেদন করা হয় তাতে অবশ্যই থাকে এই ধনিয়া বরফি। এই বরফিতে ধনের গুঁড়ো প্রথমে ঘিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়। অন্যদিকে তৈরি করা হয় চিনির রস। কাঠবাদাম, চারমগজ এবং শুকনো নারকেলের টুকরোও থাকে। চিনির রস তৈরি হয়ে গেলে তাতে ওই ধনে, বাদাম, নারকেল মেশানো হয়। তার পর বরফির আকার দেওয়া হয়। এই জিনিস একবার খেলে স্বাদ কিন্তু মনে থাকবে, সে কথা হলফ করে বলা যেতে পারে। আমার এই সহকর্মীটি আরেকটি মিষ্টি এনেছিল তার নাম ‘পাতিসা’। শনপাপড়ির ‘প্রো-ঘি’ সংস্করণ হচ্ছে এই পাতিসা। ঘি বেশি থাকার দরুণ আরও নরম হয় এই মিষ্টি।

ওড়িশার রসগোল্লা। বিকলানন্দ করের।

এবারে আমার ওড়িয়া সহকর্মী ওড়িশা থেকে বিকলানন্দ করের বিখ্যাত রসগোল্লা এনেছিলেন। বলার কোনও প্রয়োজন নেই যে স্বাদে অতুলনীয় এই রসগোল্লা। আমাদের বাংলার সাদা রসগোল্লার তুলনায় ওড়িশার রসগোল্লা হালকা খয়েরি রঙের হয়। বিকলানন্দ করের উত্তরসূরি প্রশান্ত কর জানান, ‘‘সাধারণ রসগোল্লা রসে যতক্ষণ পাক দেওয়া হয়, তার থেকে আরও পনেরো মিনিট বেশি সময় রসে রাখা হয় এই রসগোল্লা। দীর্ঘক্ষণ পাক দেওয়ার ফলে হালকা খয়েরি রঙ আসে।’’ কটক থেকে বেশ কিছু দূরে সালেপুরে তাঁদের আদি দোকানটি রয়েছে। এ ছাড়া দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতেও তাঁদের শাখা রয়েছে।

পাতিসা। শনপাপড়ির প্রো-ঘি সংস্করণ।

এবার দেশের দক্ষিণ দিকে এগোই। রাজ্যটির নাম কেরল। এ রাজ্যের একটি মিষ্টির কথা বলি। আমার মালয়ালি সহকর্মীটি আদতে কালিকটের বাসিন্দা। তিনি এবারে দিল্লিতে আসার সময় আমাদের সকলের জন্য ‘হালভা’ এনেছিলেন। হালভা ডাবের শাঁস, ঘি, অল্প গোলমরিচ এবং চিনি অথবা গুড় দিয়ে বানানো হয়। স্বচ্ছ এই মিষ্টি একেবারে জ্যামের মতো দেখতে হয়। চিনি দিয়ে বানালে সাদা, গুড় দিয়ে বানালে ঘন খয়েরি।

হালভা, মালয়ালি মিষ্টি। সাদাটা চিনির, অন্যটা গুড়ের তৈরি।

মালয়ালি সহকর্মী থাকবে আর কলার চিপস থাকবে না সেটা তো হতেই পারে না। এবারে সহকর্মীটি যে চিপস এনেছিলেন তাতে কিন্তু নারকেল তেলের গন্ধ ছিল না। তাঁর থেকে শুনেছি স্থান ভেদে চিপসের স্বাদ এবং গন্ধ আলাদা হয়। বিমানবন্দরের আশেপাশে যে দোকান আছে সেখান থেকে কলার চিপস বা কাঁঠালের চিপস কিনলে নারকেল তেলের গন্ধ থাকা অনিবার্য। সত্যি কথা এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দু’তিন বছর আগে আমার আরেক মালয়ালি বন্ধু কলার চিপস খাইয়েছিলেন। এবং তাতে নারকেল তেলের গন্ধ ভীষণ ভাবে প্রকট ছিল। লোভী আমি আগে থেকে হাঁ হাঁ করে এত চিপস নিয়ে বসেছি। আর যেই প্রথম চিপস মুখে দিয়েছি তখনই মনে হচ্ছে ছেড়ে পালাই।

লোভে পাপ হয়। কিন্তু সে পাপে মাঝে মাঝে স্বাদসুখ! সব সময় অবশ্য নয়।

কভারের ছবি— ধনিয়া বরফি, ড্রাই ফ্রুট বরফি, পেস্তা বরফি

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *