দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
ইতিহাস ছুঁয়ে জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমানঘাঁটির খোঁজে জঙ্গলে

দীপক দাস

গ্রামের নামটি কমলা। সুন্দরী হবেই। যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে তার দু’পাশের প্রকৃতি অসাধারণ। এমন পরিবেশে সব গ্রামই সুন্দর বা সুন্দরী। যে গ্রামের নাম কমলা সেই গ্রামের নাম যাঁরা দিয়েছেন তাঁরা রসজ্ঞ এবং গ্রামটি সুন্দরী হতে বাধ্য। কমলাসুন্দরীকে আমরা চোখে দেখেনি। দেখলেও হয়তো বুঝতে পারিনি। শুধু পূর্ত বিভাগের দিকচিহ্ন জ্ঞাপক বোর্ডে নামটি দেখেছিলাম।

চলেছি শালবনি। অনেকদিন পরে দল বেঁধে বাইরে বেরনো। সে আনন্দ রয়েছেই। তবে দুঃখও কম নেই। বহু বছর পরে দুর্গাপুজোর পুরো তিনদিন ঘরে বসে কাটিয়েছি আমরা। দশমীর দিন আর থাকতে না পেরে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়া। এ ব্যবস্থায় বাবলা বা ইন্দ্র কেউ খুশি নয়। দু’জনেই বারবার বলেছে জঙ্গলে রাত কাটানো হবে না এবার? খারাপ আমাদেরও লাগছিল। কিন্তু আমার আর দীপুর কিছু করার ছিল না। বাড়ির কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। ঘুরতে বেরিয়ে সব চাপ এবং বেরনোর দুঃখ ভুলেছিলাম। এবারে আমাদের নতুন সঙ্গী সঙ্গ দিচ্ছে। আমার কনিষ্ঠ সহোদর।

সেই রেল ক্রসিং।

এবার বেরিয়েছিলাম গাড়িতে। যা আমাদের প্রায় নীতিবিরুদ্ধ কাজ। কিন্তু ফেরার তাড়া। তাই বাড়ি থেকেই গাড়ি। যাচ্ছি শালবনি এয়ারফিল্ড দেখতে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। জঙ্গল দেখব। আবার ইতিহাসের রোমাঞ্চও নেওয়া হবে। বিশেষ করে যে ইতিহাসের সঙ্গে যুদ্ধ জড়িয়ে আছে। শালবনিতে ব্রিটিশ আমলের একটা এয়ারফিল্ড রয়েছে। শুনেছিলাম আগেই। বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার আগে এক প্রস্থ খাওয়াদাওয়া হয়েছে। সকালের টিফিন বা জলখাবার। রাস্তার পাশেই নতুন দোকান। আমাদের ইচ্ছে ছিল কাঁচা শালপাতায় করে মুড়ি খাব। কাঁচা পাওয়া গেল না। তবে সুন্দর করে তৈরি করা শালপাতার বাটিতেই খেলাম। মুড়ি, ঘুগনি, পকৌড়ি। সঙ্গে শসা, পিঁয়াজ কুচোনো। পরে একটু চপের স্বাদ নেওয়া। গেঁটে গেঁটে মুড়ি। একটু শক্ত। কিন্তু সে মুড়ির অপূর্ব স্বাদ। আমাদের এলাকায় যাকে বলে ঘরোয়া মুড়ি।

আমাদের টিফিন বা জলখাবার।

দোকানেই একজন খাচ্ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই পথের হদিশ নিয়েছিলাম আমরা। এবং যথারীতি ভুলেছিলাম। ভদ্রলোক বলেছিলেন, শালবনি টাঁকশালের এক নম্বর গেটের দিকে ঢুকে রেললাইন পেরিয়ে পড়বে এয়ারফিল্ড। কিন্তু আমরা চলে গিয়েছিলাম ২ নম্বর গেটের কাছে। এক দোকানে জিজ্ঞাসা করে আবার ফেরা। তার পর রেলগেট পার হওয়া। দু’ধারের জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে টাঁকশালের গেটের কাছে পৌঁছনো গেল। কিন্তু সেখানে তো দেখি রাস্তা শেষ। গেটের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা আছে বটে। সে রাস্তা ধরে একটা বাইক এল। দু’জন লোকও। কিন্তু রাস্তা যে বড় সরু। এদিকে টাঁকশালের গেটের কাছে বেশিক্ষণ গাড়ি দাঁড় করানো বিপজ্জনক। এটা প্রবল সুরক্ষিত এলাকা। সন্দেহ হলে কোবরা বাহিনী ধরে ফেলবে। ইন্দ্রকে বলা হল, একবার নেমে টাঁকশালের নিরাপত্তারক্ষীকে জিজ্ঞাসা করে আসতে।

রেল ক্রসিং ছাড়িয়ে এয়ারফিল্ডের দিকে যাওয়ার রাস্তা। এমনই সুন্দর।

দোনোমনা করে ইন্দ্র নামল। ওকে এগোতে দেখেই নিরাপত্তারক্ষী গেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। ইন্দ্র কী বলল কে জানে? ফিরে এল মুখে ব্যর্থতার পর্দা ঝুলিয়ে। আবার ফেরা। তখন এক ভদ্রলোক বাইকে যাচ্ছিলেন। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন, একটু আগে গিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে যেতে হবে। একটু আগে গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরলাম। সেটা পাথর, পিচের রাস্তা। খুবই খারাপ। একটা সময়ে রাস্তা শেষ হয়ে গেল। এর পর জঙ্গল। গাড়ি আর এগোবে না। কী করা যায়!

ভুল করে ঢুকে পড়া রাস্তায় চলছে ছবি তোলা।

নামলাম গাড়ি থেকে। সকলে মিলে বোঝার চেষ্টা করলাম। বেশ বুঝতে পারলাম রাস্তা গুলিয়েছি। নেমে যখন পড়েছিল তখন ফটোসেশন ছাড়া গতি কী! জায়গাটা অবশ্য ভালই লাগছিল। শাল জঙ্গল বেশ ঘন। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে মিষ্টি। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বহু আবাসন। টাঁকশালেরই হবে সম্ভবত। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার আগে রাস্তার একটা অংশ বিচ্ছির রকমের ভাঙা। যেন মনে হচ্ছে কেউ খুঁড়েছে। বাবলার দাবি, এখানে মাইন বিস্ফোরণ হয়েছিল। হতেও পারে। জঙ্গলমহলের এই অংশে মাওবাদীদের প্রভাব ছিল। সেই সময়ে বিস্ফোরণ হয়েছিল কিনা কে জানে!

এই রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলাম ভুল করে।

কিন্তু এয়ারফিল্ডের কী হবে? আমাদের চালকদাদার নামও ইন্দ্র। তিনি তখন জঙ্গল ছেড়ে মূল রাস্তায় চলে গিয়েছেন। আমরা অনুরোধ করেছি, রাস্তায় কোনও লোককে ধরে সঠিক অবস্থানটা জেনে নিতে। ছবিটবি তুলে হেঁটে জঙ্গল থেকে বেরোচ্ছি দেখি দু’টো বাইক আসছে। একটু ভয় লাগছিল। বনরক্ষী নয় তো? এখন বনে ঢুকতে হলে অনুমতি লাগে শুনেছি। কাছে আসতে থামিয়ে কথা বললাম। বনরক্ষী নন। আমাদের এয়ারফিল্ডের হদিশ দিয়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে বাইক চালিয়ে চলে গেলেন।

এয়ারফিল্ডের পথের জঙ্গল।

কিন্তু এ জঙ্গলে কোথায় সেই রাস্তা? একজন গোয়ালা যাচ্ছিলেন বাইকে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি দেখিয়ে দিতে চাইছিলেন। আমরা রাজি হলাম না। কী হবে লোকের কাজের ক্ষতি করে! দ্বিতীয় মতামতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আরেকটি বাইক এল। বাচ্চাদের নিয়ে ফিরছেন। তিনি দেখিয়ে দিলেন রাস্তা। গাড়ি একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে ঢুকল আবার। কিছুটা গিয়েই বিপত্তি। বিরাট বিরাট খন্দ। তাতে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে। কতটা গভীর বোঝা যাচ্ছে না। সাইকেল আরোহী একজন ভাগ্যক্রমে এসে পড়েছিলেন বলে রক্ষে। তিনি একটু পিছিয়ে আরেকটা রাস্তা ধরতে বললেন।

প্রথম যে এয়ারফিল্ডের ভগ্নাংশের সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা।

গাড়ি কিছুটা গিয়ে আবার একটা পাথর পিচের ক্ষয়াটে রাস্তা পেল। কিন্তু রানওয়ে বা এয়ারফিল্ডের দেখা নেই। এই জঙ্গলে আর কোনও লোক মিলবে বলে মনে হয় না। বিমানঘাঁটি না দেখেই কি ফিরতে হবে? ইন্দ্র ওই ক্ষয়াটে রাস্তাকেই পরিত্যক্ত রানওয়ে বলে সাব্যস্ত করল। কিন্তু আমরা মানতে রাজি নই। কারণ এরকম এয়ারস্ট্রিপ আমরা আগে দেখেছি। একটা জয়পুরের জঙ্গলের বাসুদেবপুরে। আরেকটা রামপুরহাট থেকে মলুটি যাওয়ার পথে। তার চেহারা তো এরকম নয়। কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে ঠিক হল, রাস্তাটা যতটা এগিয়েছে আমরা ততটা যাব।

তখন পাখির খোঁজ চলছে।

ভাগ্যিস এগিয়েছিলাম। কিছুটা এগোতেই রাস্তার পাশের জঙ্গলে দেখি একটা পাখি। অচেনা। গাড়ি থামাতে বলা হল। একটা নয়, বেশ কয়েকটা। কী পাখি? দীপু বলল, কালিচ। ইন্দ্র খাওয়ার তালে থাকে। ওর ধারণা, বনমুরগি। আমার মনে হল, এগুলো তিতির পাখি। আমরা কেউই পাখি বিশেষজ্ঞ নই। ফলে কেউ কাউকে হ্যাটা করার সুযোগ পেলাম না। লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে পাখিগুলোও গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। শুধু কতকগুলো সাত ভেয়ে পাখি কলরব করতে করতে গাছে গাছে লাফাতে শুরু করল। এদের আমরা ছাতারে বলে জানি।

পাখির এলাকা ছাড়িয়ে কিছুটা ঢুকতেই পেলাম আমাদের অভীষ্ট। চাতাল বা রানওয়ে। একেবারে ছোট্ট একটু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। পুরো জঙ্গলের মাঝে। তবে লোকজনের যাতায়াত আছে। মদের বোতল পড়ে রয়েছে। এমন সুন্দর জায়গায় কেউ মদ খেতে আসে ভাবলেই রাগ হয়। আমরা ছবি তুলছি। চালকদাদা এগিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ফিরতে তিনি দেখালেন, একটু ভিতরের জঙ্গলে আরেকটা রানওয়ে। সেখানেও গিয়ে দেখি, মদের বোতল। মানুষ গড়ে। আবার মানুষই নষ্ট করে।

দ্বিতীয় এয়ারফিল্ডের অংশ।

ছবি তোলা হল। এবার ফেরার পালা। তার আগে একটু ইতিহাস চর্চা হয়ে যাক। শালবনি এয়ারফিল্ড তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। এরকম বিমানঘাঁটি জঙ্গলমহলে বেশ কয়েকটি ছিল। ঝাড়গ্রামের দুধকুণ্ডি, খড়্গপুরের কলাইকুন্ডায়। এসবই ছিল সিবিআই থিয়েটার, মানে চায়না, বার্মা, ইন্ডিয়া থিয়েটারের অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিত্রশক্তির সিবিআই থিয়েটার এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। শালবনি এয়ারফিল্ড চালু হয়েছিল ১৯৪২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ঘাঁটি ছিল শালবনি। বিমানঘাঁটিটি বন্ধ হয় ১৯৪৩ সালের ২৪ অক্টোবর। তার আগের মাসের ২৫ তারিখে শালবনিতে একটি যুদ্ধ বিমানকে ক্রাশ ল্যান্ডিং করতে হয়েছিল। এই ঘটনায় দুই পাইলট আহত হয়েছিলেন।

ইতিহাসের রোমাঞ্চ আর প্রকৃতির সৌন্দর্য মনে নিয়ে জঙ্গলপথ ধরে বড় রাস্তার দিকে এগোতে থাকলাম আমরা।

কভারের ছবি— পরিত্যক্ত শালবনি এয়ারফিল্ড

ছবি- দীপশেখর দাস

তথ্য: উইকিপিডিয়া এবং আনন্দবাজার

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *