কর্ণগড়
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

বিদ্রোহী রানি শিরোমণির কর্ণগড়ে

দীপশেখর দাস

পুজোর শুরুতেই বেরিয়ে পড়ি জঙ্গলের দিকে। এবার ব্যতিক্রম। প্রথম তিনদিন প্রায় ঘর বন্দি থেকে দশমীতে পাঁচমাথায় বেরিয়ে পড়া। উদ্দেশ্য শালবনির জঙ্গল আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এয়ারফিল্ডের খোঁজ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমানঘাঁটির খোঁজে জঙ্গলে দ্রষ্টব্য)। ছক আগেই কষা হয়ে গিয়েছিল কোথায় কোথায় যাওয়া হবে। শালবনির পরেই ছিল কর্ণগড় পরিভ্রমণ। কিন্তু শালবনিতে গিয়ে পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন হয়েছিল।

শালবনির জঙ্গল চষে, নতুন পরিকল্পনা মাফিক ঘোরাঘুরি করে ভাদুতলায় যখন ফিরলাম তখন বেলা দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে। যে পথে জঙ্গলে গিয়েছিলুম ফেরা সেই পথে হয়নি। তাই ভাদুতলা মোড়ে একটুখানি দাঁড়িয়ে পথের সুলুক সন্ধান করে নেওয়া হল। ভাদুতলা মোড় থেকে কিছুটা যেতেই পেলুম একটি তোরণ। কর্ণগড়ের প্রবেশদ্বার।

মহামায়া মন্দির চত্বর।

কর্ণগড়ে কেন? কারণ এই স্থানটির মহিমা দু’দিক থেকে। স্বাধীনতার এবং সাহিত্যের ইতিহাসের দিক থেকে ঐতিহ্য ক্ষেত্র বলা যায়। কর্ণগড় ইতিহাসে প্রসিদ্ধ রানি শিরোমণির রাজত্ব হিসেবে। এই রানি ছিলেন চুয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী। কী ভাবে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা জানতে একটু ইতিহাসে ফিরতে হবে। কর্ণগড়ের রাজা ছিলেন অজিত সিংহ। জায়গাটি বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরে পরে। অজিত সিংহের দুই রানি ছিলেন। রানি ভবানী এবং রানি শিরোমণি। কেউ কেউ দাবি করেন এই দুই রানি ছিলেন দুই বোন। তাঁদের বাড়ি ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আনন্দপুর গ্রামে। বাবা বৈদ্যনাথ সরকার। মা শান্তমণি। অজিত সিংহের অকাল মৃত্যু হলে বড় রানি ভবানী রাজকাজের দায়িত্ব পান। তাঁর মৃত্যু হলে রানি শিরোমণি রাজ্যের প্রধান হন। দুই রানিরই কোনও সন্তান ছিল না।

বাঁ দিকে মহাবীর মন্দির। ডানদিকে দণ্ডেশ্বর ও খড়্গেশ্বর মন্দির।

ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজাদের উপরে প্রচুর করের বোঝা চাপিয়েছিল। রানি শিরোমণি তা দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর প্রজারা যাঁরা নিষ্কর জমি বংশ পরম্পরায় ভোগ করতেন তাঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহই চুয়াড় বিদ্রোহ। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে রানিকে ১৭৯৯ সালে গ্রেফতার করা হয়। ঘাটালের নাড়াজোলের রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় রানি ছাড়া পেলেও তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল আবাসগড়ে। তাঁর সম্পত্তিও ব্রিটিশরা কব্জা করে রেখেছিল। বন্দি অবস্থাতেই ১৮১২ সালে রানির মৃত্যু হয়। আমরা এই ঐতিহাসিক স্থানই দেখতে এসেছি।

মহামায়া মন্দির।

প্রবেশদ্বার পেরিয়ে কিছুটা যেতে পথ দু’দিকে ভাগ হল। ডানদিকের রাস্তা ধরে মহামায়া মন্দিরে গেলুম। বলা হয় এটি রানির স্থাপিত করা মন্দির। তবে হাল আমলে তার গঠনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। মন্দিরের পরিসরটা বেশ বড়। মন্দিরের সামনে মহামায়া সেবা সমিতির অফিস ঘর। অফিস ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন রকম পুজো উপাচারের দরপত্র লেখা। দু’চাকার পুজো করালে ১০০ টাকা। তিন চাকার ২০০। আর চার চাকা হলে ৪০০। মন্দিরের বিবাহ কার্যও সম্পন্ন হয় দেখলুম। এখানে বিবাহ করতে হলে কী কী কাগজপত্র লাগবে তার বিশদ বিবরণও দেওয়া আছে। চত্বরের একদিকে সার দিয়ে মিষ্টির দোকান। দর্শনার্থীরা এখান থেকেই মিষ্টি কিনে পুজো দিয়ে থাকেন। মন্দিরের আরেক পাশে অতিথি নিবাস।

কর্ণগড়ের আগে।

মূল মন্দিরের প্রবেশ করতে হলে জুতো বাইরে জমা রেখে যেতে হয়। আমার, বাবলার আর ইন্দ্রদার পায়ে হাল ফ্যাশনের বাঁধা জুতো। খোলা পরার অনেক সমস্যা। ইন্দ্রদা আবার ঘোরতর নাস্তিক। একমাত্র কাউকে বয়ে নিয়ে যেতে হলে বা কারও ব্যাগ ধরার হলে তবেই মন্দিরে যায়। তাই আমরা তিনজন মূল মন্দিরে গেলাম না। দীপকদা আর রাজা মন্দির দেখে এল। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার গর্বিত নাগরিক হয়ে আমরা তিনজন ওদের মোবাইলে তোলা ছবিতে মন্দির দেখলুম। পাশাপাশি তিনটি মন্দির রয়েছে। ঢুকেই একদম বাঁ পাশে মহাবীর মন্দির। মাঝে দণ্ডেশ্বর ও খড়্গেশ্বর মন্দির। একেবারে ডান দিকে মহামায়ার মন্দির। এই মন্দিরই রানির প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়। তবে সে ছাঁদ আর নেই। মন্দিরের প্রবেশপথের উপরে লেখা রয়েছে, মহামায়া (বগলামুখী) অভয়া (দক্ষিণা কালী)। মন্দিরের সামনে পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে বলেও লেখা। দীপকদা মন্দির ঘুরে এসে বলল, দশমীর দিনে একটি ছেলে হাসিমুখে নিজের বিজয়া পালন করছে দণ্ডেশ্বর মন্দিরের সামনে। বিয়ে করছে বেচারা।

প্রাচীরের অংশ বা সেনানিবাস। বোর্ডে কোনও পরিচয় লেখা নেই।

এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার। মহামায়া মন্দিরের পাশে দণ্ডেশ্বর মন্দির সাহিত্যের ইতিহাসেও বিখ্যাত। শিবায়ন কাব্যের রচয়িতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য এই কর্ণগড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি আসলে ঘাটালের যদুপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু রাজা শোভা সিংহের ভাই হিম্মৎ সিংহের অত্যাচারে কবি কর্ণগড়ে পালিয়ে আসেন। তাঁকে আশ্রয় দেন কর্ণগড়ের রাজা রাম সিংহ। তিনি রানি শিরোমণির স্বামী অজিত সিংহের ঠাকুরদা। রাম সিংয়ের পুত্র যশোমন্ত সিংহের সময়েই তৈরি হয় দণ্ডেশ্বর মন্দির। তন্ত্রসাধক রামেশ্বর এই মন্দিরে বসে লিখেছিলেন শিবায়ন কাব্য। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মেদিনীপুর শাখা তাঁর স্মৃতি মন্দির তৈরি করে দিয়েছে এখানে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মন্দির।

মন্দির দেখে রওনা দিলুম রানির গড়ের দিকে। মন্দিরের এক দোকানির থেকে রাস্তার সন্ধান করলুম। তিনি বললেন মন্দির থেকে বেরিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকে গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে নিয়ে ঢালাই রাস্তার বরাবর গেলেই রানির ‘পার্ক’ পৌঁছে যাব। সেই মতো রাস্তা ধরে চললুম। একটা খাল পেরোতেই গড়ে পৌঁছলুম। এখানেও একটা প্রবেশদ্বার। তবে আগেরটার থেকে অনেকটাই ছোট। প্রবেশদ্বারে গ্রিলের পাশাপাশি দু’টো গেট। একটা চওড়া। একটা সরু। একটা গাড়ির জন্য। একটা মানুষের জন্য। শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমন হয়। গড়ের প্রবেশমূল্য ১০ টাকা।

রাজপ্রাসাদের অংশ কি এটা?

প্রবেশদ্বার যতটা ঝকমকে, ভিতরের রাস্তা ততটাই খারাপ। জায়গায় জায়গায় পুরোটাই প্রায় কর্দমাক্ত। শুধু একপাশে কয়েকটা পাথরের চাঁই ফেলা। তার উপর পা ফেলেই কাদা পার করার ব্যবস্থা। ইন্দ্রদার ব্ল্যাক বেল্ট আছে। গেরিলা কায়দায় পাথরের চাঁইয়ে পা ফেলে কী ভাবে কাদা পেরোতে হয় তা আমাদের হাতে কলমে দেখিয়ে দিল। আমরাও সেই ভাবেই কাদা পেরোলুম।

প্রবেশদ্বার পেরিয়েই একটা ভগ্নপ্রায় প্রাচীর। তবে তার দেওয়াল বেশ পুরু। প্রাচীরের উপর আগাছার স্তুপ। আমরা এটাকে গড় সীমানা নির্দেশিত প্রাচীর বলেই ভেবেছিলুম। কিন্তু, প্রাচীরে থাকা একটা দরজার মত প্রকোষ্ঠ দেখে বিভ্রান্ত হলুম। এটা একটা মন্দিরের ভাঙা অংশ বা বাসস্থানের অংশ বলে মনে হল। এটিকে কর্ণগড়ের রাজাদের সেনানিবাস বলেন কেউ কেউ। প্রাচীর পেরিয়ে আরও একটু এগোতেই একটা জরাজীর্ণ মন্দিরের সামনে এলুম। এই মন্দিরেও আগাছার স্তুপ। আদল দেখে এটাকে শিব মন্দির বলেই মনে হল। সামনে বন জঙ্গল ভর্তি থাকায় মন্দিরের কাছে যাওয়ার সুযোগ হল না। মন্দিরের উল্টোদিকেই সজ্জিত ক্যাফেটেরিয়া। আকাশে মেঘ ছিলই। বৃষ্টি নামল। আমরা ক্যাফেটেরিয়ায় আশ্রয় নিলুম। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার খোঁজ করতে জানা গেল এখানে ভাত পাওয়া যাবে না। জনাগম কম। তাই ওঁরা অর্ডার নিয়ে খাবার পরিবেশন করেন। তবে ফাস্ট ফুড পাওয়া যাবে।

এই সেই জলহরি। দূরে কটেজের সারি।

আমরা ভেতো বাঙালি। দুপুরে ভাত চাই। কিন্তু রাজার খিদে পেয়েছে। ওকে ওষুধ খেতে হবে। ওর জন্য একটা এগরোল অর্ডার করা হল। বৃষ্টির তেজ বাড়ল। জানা গেল সরকারি উদ্যোগেই ক্যাফেটেরিয়া তৈরি। এঁরা লিজে নিয়ে ব্যবসা করছেন। ভিতরের দিকে বেশ কিছু কটেজও নাকি তৈরি করা হয়েছে। এসি এবং নন-এসি দু’রকমেরই ঘর আছে। উদ্যোগটা ভালই। ঐতিহাসিক জায়গায়, নিরিবিলিতে শহুরেদের রাত কাটানোর সুবন্দোবস্ত।

রাজাকে ক্যাফেটেরিয়ায় বসিয়ে রেখে আমরা কটেজের দিকে পা বাড়ালুম। কর্দমাক্ত বন-জঙ্গল ঘেরা পথ ধরে একটা পুকুরের কাছে পৌঁছলুম। বেশ বড় পুকুর। পুকুরের ঠিক মাঝখানে একটা পাকা কাঠামো। মন্দিরের নীচের অংশটা যেমন হয় ঠিক সেরকম ধাপ ধাপ। কিন্তু আগাছায় ঢাকা। এটাকে নাকি জলহরি বলে। ঘাটালের নাড়াজোলে এরকম একটা জলহরি রয়েছে।

গড়ের ভিতর গেরিলা কায়দায় ফেরা।

পুকুরের ওপাড়ে কটেজগুলো দেখা গেল। অনেকটা কুঁড়ে ঘরের আদলে তৈরি। মাথায় খড়ের ছাউনি। একটা মোড় ঘুরতেই আরও কয়েকটা কটেজ চোখে পড়ল। তবে এগুলোর ছাদ সবই সিমেন্টের। টালির ছাঁদের। একেকটা কটেজের নাম গড়ের এক এক রাজার নামে। যেমন, রাজা কর্ণকেশরী কটেজ, রাজা রণবীর সিংহ কটেজ ইত্যাদি।

গড় দেখা শেষ করে ফেরার পথ ধরলুম। শুনেছিলাম কর্ণগড় পারাং নদীর তীরে অবস্থিত। সেই নদীর কোনও চিহ্ন পেলাম না। মরে হেজে গিয়েছে। ইতিহাসের অংশে শুধু জুড়ে রয়েছে।

তথ্যসূত্র: ১। আনন্দবাজার পত্রিকা, ২। কর্ণগড় পরিভ্রমণ— তপনকুমার সিংহ

কভারের ছবি— কর্ণগড়ে ঢোকার আগে তোরণ

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *