তুহিন নায়েক
জায়গাটার সন্ধান পেয়েছিলাম এক আত্মীয়ের থেকে। সে গিয়েছিল একদিন। ঘুরেটুরে এসে জানিয়েছিল, অসাধারণ জায়গা। একদিনের জন্য মন সতেজ করতে হলে এরকম জায়গায় ঘুরে আসা যায়। শুনেই যাওয়ার জন্য মন ছটফট করছিল। আমি এরকম টুকটাক এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তে ভালবাসি। চেষ্টা করি, কোনও বন্ধুকে সঙ্গে নেওয়ার।
এবারেও একজনকে খুঁজছিলাম যে যেতে রাজি হবে। সেই জন্যই বললাম সৌমিককে। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। সৌমিকও ঘুরতে ভালবাসে। তাই ও এক কথায় রাজি হয়ে গেল। অক্টোবরের ১০ তারিখে সৌমিককে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সৌমিকই বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল। আমি ওর বাইকে সওয়ার হয়ে গেলাম।
আর রহস্য করব না। এবার জায়গাটার কথা বলি। বেনেপুর জায়গাটা বাগনানের মধ্যে পড়ে। বাগনান থেকে আরও ১১ কিলোমিটার যেতে হয়। আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম পাতিহাল থেকে। প্রথমে গেলাম আমতায়। সেখান থেকে বাগনান রোড ধরে বাগনান। ফ্লাইওভার ধরে শ্যামপুর রোড হয়ে পৌঁছলাম বেনেপুরে। উত্তর বেনাপুর মনসা মন্দির থেকে কিলোমিটার তিনেক গেলেই বেনাপুর। রাস্তার কাছেই। গাছগাছালিতে ঘেরা জায়গা। না হলে রাস্তা থেকেই দেখা যেত নদীর পাড়টা। নদী নয় অবশ্য। এটা রূপনারায়ণ নদ। একেবারেই বাংলার সুন্দর গ্রামের পরিবেশ।
বাইক রাখার কোনও জায়গা নেই। আমরা গাছে ঘেরা জায়গার কাছে বাইক রাখলাম। তার পর হেঁটে গেলাম রূপনারায়ণের চরে। সবুজ ঘাসে ঢাকা চর। যেন বিশাল একটা গলফ খেলার মাঠ। তবে এখানে অবশ্য স্থানীয় ছেলেরা ফুটবল খেলছিল। চরের অনেকটাই ছিল ভিজে। কিছু জায়গায় কাদা। বৃষ্টি হয়নি দু’একদিনের মধ্যে। তাহলে কাদা কেন? এলাকার একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম বিষয়টা। তিনি জানালেন, সপ্তাহে দু’দিন জোয়ারের জলে ভরে যায় চর। জল চলে আসে ফুটবল মাঠ পর্যন্ত। তাই এমন ভিজে। তবে জোয়ার আসার নির্দিষ্ট দিন বললেন তিনি।
যেখানে বাইক রেখেছিলাম সেখান থেকে রূপনারায়ণ শ’দেড়েক মিটারের মতো। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। চরের হাঁটার জায়গায়টায় বিদ্যুতের পোস্ট আছে দেখলাম। সব সৌরবাতির আলো। মখমলের মতো ঘাস মাড়িয়ে হাঁটতে বেশ ভাল লাগছিল। চরে ছোট ছোট কিছু গাছ আছে। গাছগুলো ছাতার মতো ছায়া দিচ্ছে। অনেকক্ষণ রোদে ঘুরলে গাছের ছায়ায় একটু দাঁড়িয়ে নেওয়া যাবে। আমরা পৌঁছেছিলাম সাড়ে চারটের পরে। রোদ ঝলমলে নদের চর। দু’চারজন ঘুরছে চরে। এক দু’জন কোনও গাছের ছায়া বেছে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা হল দু’টো কুকুরের সঙ্গে। বেশ স্বাস্থ্যবান। আমাদের বেশ সুন্দর পোজ দিল।
শরৎকালের আকাশ। এই এলাকায় আকাশ যেন আরও বেশি নীল। অল্প অল্প শরতের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। খুব ভাল লাগছিল হাঁটতে। পৌঁছলাম একেবার রূপনারায়ণের কাছে। চরের একদিকে জলের ধাক্কায় ভেঙে গিয়েছে। নদ ঢুকে এসেছে কিছুটা। আমি আর সৌমিক ছবি তুলতে তুলতে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের হাওড়া জেলাতেই এত সুন্দর এলাকা রয়েছে! দেখে যেন মনে হচ্ছে, কোনও সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছি। সবুজ ঘাসের কার্পেটটাই শুধু সমুদ্র ভাবতে দিচ্ছে না।
দু’জনে ঘুরছি। হঠাৎ আমাদের কাছে হাজির স্থানীয় তিন বাচ্চা। আবদার করছিল, ভিডিয়ো করে দিতে হবে তাদের। করে দিয়েছিলাম। তিন বন্ধু মিলে নানা পোজ দিয়ে ভিডিয়ো করল। ভিডিয়োটা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা নিতে চাইল না। তবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখল। তিনজনকে ছেড়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। জল ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। রূপনারায়ণের বুকে কাদায় ভরা চর জাগছিল। তিনটে ছেলে হেঁটে গেল চরের দিকে। আমরা দূরে তাকালাম। নদের ওপারে একটা চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ওটা কি কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র? ঠিক জানি না। আমরা একটা নৌকা ঘাটে বাঁধা দেখলাম। নৌকার উপরে জাল ছিল। মনে হয়, জেলেদের নৌকা। মাছ ধরতে যাবে। চরেও তোলা ছিল দু’টো নৌকা। একটা বিষয় বলার, চরে শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ নেই। তবে মুখরোচক কিছু মেলে। ভুট্টা পোড়া, ফুচকা, ঝালমুড়ি এরমকই কিছু।
সূর্য ধীরে ধীরে পাটে যাচ্ছে। যেন রূপনারায়ণের বুকে ডুব দিতে চলেছে। লাল হচ্ছে পশ্চিমদিক। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এর বর্ণনা করা আমার সাধ্য নয়। দু’জনে শুধু তাকিয়ে ছিলাম লাল হয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে। সৌমিক অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে হেঁটে, দাঁড়িয়ে ছবি-ভিডিয়ো করল। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল। জ্বলে উঠল নদের চরের আলো।
তখন বহু লোকেক ভিড় চরে। বাইরের লোকজনই বেশি। স্থানীয় লোকজনও রয়েছেন। ভিড় তো হবেই। এমন সুন্দর জায়গায় সন্ধেবেলাটা কাটানো ভাগ্যের ব্যাপার। ফেরার সময়ে চাঁদ উঠে গিয়েছিল। রূপনারায়ণের চর আর চাঁদ অন্যরকম ছবি তৈরি করছিল।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)