ফারুক আব্দুল্লাহ
অনেক দিন থেকেই শুনেছিলাম জিয়াগঞ্জের বিখ্যাত মালপোয়া ও মালাই বরফির কথা। সময় হয়ে উঠছিল না। মাঝে অবশ্য একদিন মুর্শিদাবাদ শহরের রাস্তায় এক ভ্রাম্যমান মিষ্টি বিক্রেতার কাছে খেয়েছিলাম মালাই বরফি। কিন্তু জিয়াগঞ্জের মালপোয়া খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। অথচ অজস্রবার জিয়াগঞ্জে গিয়েছি। সময়ের অভাবে স্বাদ বঞ্চিত।
১২ নভেম্বর, ২০২২ সালের এক বিকেল। হঠাৎ করেই জিয়াগঞ্জের মালপোয়া ও মালাই বরফি খেতে ইচ্ছে হল। আসলে সেদিন বিকেলে আমাদের নশিপুরের রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল। মনোদীপদারও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। আগের দিন আমাদের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু দাদা বিকেল বেলায় আমাকে রিসিভ করতে এলে মন বদলে যায়। দাদাকে বলি, নশিপুর নয় বরং চলো জিয়াগঞ্জে যাওয়া যাক। সেখানকার কিছু ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির খোঁজে। দাদাও রাজি হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদ শহর থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে জিয়াগঞ্জ মাত্র মিনিট দশ পনেরোর পথ।
জিয়াগঞ্জের প্রাচীন নাম ছিল ‘গম্ভীলা’। এখানে একটি পাড়ার নাম ছিল বালুচর। এই নাম থেকেই এ অঞ্চলে তৈরি অতিসূক্ষ্ম কাজের রেশমি শাড়ির নাম বালুচরি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বালুচরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুর্শিদ কুলি খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার জন্য রাজস্থানের বিকানিরের ধনী জৈনরা এই শহরে বসতি স্থাপন করেন। জিয়াগঞ্জ নবাবি আমলে একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে। জিয়াগঞ্জে বৈষ্ণব সম্প্রদায়েরও তীর্থস্থান। মণিপুরের বৈষ্ণবরাও এখানে তীর্থ দর্শনে আসেন।
এবার মনোদীপদার সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। দাদা পেশায় সাংবাদিক। ইতিহাস প্রেমিক, খাদ্য রসিক হিসেবেও দাদার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। আমিও তাই জিয়াগঞ্জ যাওয়ার কথা বলার সময় বলেছিলাম ‘জিয়াগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি’র কথাটি উল্লেখ করেছিলাম। একে ঐতিহ্যবাহী তার পর তা খাবার, তাই দাদাও আর না করতে পারেনি। জিয়াগঞ্জ পুরনো শহর। তাই মিষ্টির আগে শহরের ইতিহাসটাও বলে নেওয়া দরকার।
আমাদের কাছে খবর ছিল, জিয়াগঞ্জের সদরঘাটের কাছে একটি দোকানে খুব ভাল মালপোয়া ও মালাই বরফি পাওয়া যায়। জিয়াগঞ্জের প্রবীণদের কাছে শুনেছিলাম, এক সময় শহরের প্রায় সব দোকানেই এই দু’টি মিষ্টি পাওয়া যেত। মানুষের রুচি অনেকটাই বদলেছে। তাই আজকাল পুরনো আমলের এই সব মিষ্টির তেমন চাহিদা নেই শহরে। ফলে হাতে গোনা কয়েকটি দোকানেই এখন মালপোয়া ও মালাই বরফি পাওয়া যায়। আমরা ইতিমধ্যে জিয়াগঞ্জ শহরে ঢুকে পড়েছি। সদর ঘাটের দিকে এগোচ্ছি। শ্রীপৎ সিংহ কলেজ পেরিয়ে নিমতলা ঘাট পার করে আরও কিছুটা গেলে আমাদের গন্তব্য।
ঘাটের কিছুটা আগেই একটি পুরনো মিষ্টির দোকান নজরে পড়তে আমরা সেখানেই ঢুকে পড়ি। সেই দোকানের গায়ে কোনও নাম লেখা নেই। ভেতরে ঢুকে জানতে পারি, দোকানটি নারায়ণ ঘোষের মিষ্টির দোকান নামেই এলাকায় বিখ্যাত। শহরের পুরনো দোকানগুলির মধ্যে এটি অন্যতমও। দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এই দোকানটি প্রায় অর্ধ শতকের পুরনো। জিয়াগঞ্জ শহরে আরও অনেক পুরনো মিষ্টির দোকান ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে নারায়ণ ঘোষের দোকানটি আজও পুরনো দিনের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। ফলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই দু’টি মিষ্টিও এই দোকানে খোঁজ করতে সহজেই পাওয়া গেল। এর আগে জিয়াগঞ্জের অন্য দোকানে এই দু’টি মিষ্টি বেশ কয়েকবার খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
জিয়াগঞ্জের মালপোয়া দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে, সেটিই আসলে মালপোয়া। আমরা সাধারণত মালপোয়ার একটি নির্দিষ্ট আকার দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে এসে দেখি রাজভোগের আকারের একটি চ্যাপ্টা লালচে মিষ্টিই নাকি মালপোয়া। দোকানদারকে এটাই নাকি জিয়াগঞ্জের বিখ্যাত মালপোয়া। আমার বিস্ময় ভাব কাটতে না কাটতেই এক ক্রেতা এসে ওই মালপোয়ার দিকে আঙুল দিয়ে বলছে ‘‘দাদা আমাকে চারটি দিন।’’ এটাই হয়তো মালপোয়া। তবুও আমার মন খুঁতখুঁত করছিল। তাই মালপোয়ার ছবি আমার এক স্থানীয় বন্ধুকে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, এটাই জিয়াগঞ্জের মালপোয়া কিনা? সে সিলমোহর দিল। মালপোয়া তো পেলাম কিন্তু মালাই বরফি? দোকানের ছোট্ট কর্মচারীটি বলেছিল আছে। কিন্তু কোথায় আছে? দোকানে সাজানো বিভিন্ন মিষ্টির মধ্যে খোঁজ করতেই নজরে পড়ল মালাই বরফি। আগে একদিন খাওয়ার ফলেই মালাই বরফি চিনতে সমস্যা হয়নি।
এবার চেখে দেখা। রসে ডোবানো মালপোয়াটি দেখেই মনে হচ্ছিল, এটি কড়া পাকের মিষ্টি। খুব বেশি হয়তো খাওয়া যাবে না। তাই আমাদের কথা মতো দোকানের অল্প বয়সি কর্মচারীটি আমাদের প্রথমে একটি করে দিয়ে গেল। মালপোয়া হাতে পেয়ে প্রথমে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। এবার মালপোয়া মুখে ভেঙে মুখে দেওয়ার পালা। মুখে দেওয়ার আগে চলুন মালপোয়ার ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।
মালপোয়া ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক পুরনো একটি মিষ্টি খাবার। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে ও স্বাদে এই খাবার প্রচলিত রয়েছে। কথিত, শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবনে গিয়ে প্রথম মালপোয়া খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলায় ফিরে তাঁর শিষ্যদের দোলের দিন মালপোয়া দিয়েই মিষ্টিমুখ করার অনুরোধ জানান। দোলপূর্ণিমার দিন বাংলার অনেক বাড়িতেই মালপোয়া তৈরি করা বহুকালের রীতি। জিয়াগঞ্জের মালপোয়াও বহু পুরনো। এক সময় জিয়াগঞ্জের নাম ছিল বালুচর। তাই এখানকার মালপোয়ার পোশাকি নাম ছিল ‘বালুচরি মালপোয়া’। এখন পুরনো নামের আর প্রচলন নেই।
মালপোয়া খুব কড়া পাকের মিষ্টি। রসে ফুটে ফুটে মালপোয়া বাদামি রং ধারণ করে। তীব্র মিষ্টি হয় একবারে খুব বেশি খাওয়া যায় না। স্থানীয় জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ জিয়াগঞ্জের মালপোয়ার খুব কদর করতেন। অজিমগঞ্জ, জিয়াগঞ্জের জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে মালপোয়া আজও খুবই জনপ্রিয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একবার জিয়াগঞ্জে সভা করতে এসেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা একটি বড় আকারের মালপোয়া নেতাজিকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। নেতাজি সেই মালপোয়া কেটে উপস্থিত সকলকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। নিজে খেয়েও স্বাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বলে শোনা যায়।
জিয়াগঞ্জের মালপোয়া স্থানীয় রাজা জমিদাররাও খুব পছন্দ করতেন। কথিত, নশিপুর রাজ বাড়িতেও নাকি নিয়মিত মালপোয়া আসত। নশিপুরের কিছু প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, এক সময় নশিপুরের বিখ্যাত রথ ও ঝুলনের মেলায় মালপোয়ার অজস্র দোকান বসতো। সেই মালপোয়া অনেক বড় বড় আকারের হতো।
আর দেরি করা যাচ্ছে না। চামচ দিয়ে মালপোয়া ভাঙতেই দেখি ভিতরে মশলার পুর দেওয়া রয়েছে। মুখে দেওয়ার আগে ভাবছিলাম যেহেতু কড়া পাকের তাই হয়তো মিষ্টি স্বাদে মুখ ভরে যাবে। কিন্তু তেমনটি হল না। মালপোয়ার মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে গোলমরিচ ও মৌরির স্বাদও মিলেমিশে একাকার হয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর স্বাদের সৃষ্টি করেছে। আমি গোলমরিচের স্বাদ পেলেও মৌরীর স্বাদটাই বেশি অনুভব করতে পেরেছি। সব মিলিয়ে খুব সুখানুভূতি হল। এমন কড়া পাকের মিষ্টিও যে শিল্পীর নিখুঁত হাতে পড়ে এমন মুখরোচক হয়ে উঠতে পারে তা জিয়াগঞ্জের এমন অভিনব মালপোয়া না খেলে জানতেই পারতাম না।
এবার সেই বহু প্রতীক্ষিত মালাই বরফি খাওয়ার পালা। এখানকার মালাই বরফির কৃতিত্ব মূলত পার্শ্ববর্তী বড়বাড়িয়ার ঘোষেদের। পরবর্তী সময় তাঁদের কাছ থেকে এই মিষ্টির প্রস্তুত প্রণালী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমানে মালাই বরফি জিয়াগঞ্জের দু’একটি দোকানেই পাওয়া যায়। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা নারায়ণ ঘোষের মিষ্টির দোকানেই মালপোয়া ও মালাই বরফি পেয়ে গিয়েছিলাম। মালাই বরফি ভেঙে মুখে দিতেই দেখলাম তাতে গোলাপের সুগন্ধ। মুখে দিয়ে নাড়তেই গলে গেল। সরের বেশ কয়েকটি টুকরো মুখের ভিতর জানান দিতে থাকল তাদের অস্তিত্ব। মুর্শিদাবাদ শহরের ভ্রাম্যমান মিষ্টি বিক্রেতার মালাই বরফি খেয়ে কিন্তু গোলাপের সুগন্ধ পাইনি। মালাই বরফিটিও কিছুটা জমাট ছিল। মুখে দিয়ে ভাল মতো নাড়াতে হতো। তবে স্বাদ ছিল অতুলনীয়।
মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের যে কোনও মিষ্টি খাবারেই এমন গোলাপের সুগন্ধ পাওয়া যায়। শুধু নবাব পরিবার নয় জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের শেহেরওয়ালি সম্প্রদায়ের বহু মিষ্টি জাতীয় খাবারেও গোলাপ জল মেশানোর রীতি রয়েছে। গোলাপের সুগন্ধ যুক্ত মিষ্টি খাবার খেতে গিয়ে কেমন যেন রাজকীয় অনুভূতি পাওয়া যায়। মালাই বরফি খেতে গিয়েও আমার সেই অনুভূতি হচ্ছিল। এতই সুস্বাদু যে, দু’একটি মালাই বরফি খেয়ে মনের সাধ মেটানো মুশকিল।
দোকানে বসেই পরের সপ্তাহে এই শহরের আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবারের খোঁজে আসার পরিকল্পনা করলাম। তার পর আমরা সেদিনের মতো শহর ত্যাগ করেছিলাম।
কভারের ছবি— বালুচরি মালপোয়া
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)
বেশ ভালো লাগল স্যার….পরে যে দিন সদরঘাট যাব, সেদিন momo,bhelpuri বাদে মালপোয়া আর মালাইবর্ফি টা ট্রাই করবো 😋
অনেক ধন্যবাদ