দীপশেখর দাস
আমরা দল বেঁধে মন্দিরময় মলুটি ঘুরে এসেছি। বছর কয়েক আগে দুর্গাপুজোর দিনে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রাম এক বিস্ময়। খুব ঘন ঘন কোনও কিছুর অবস্থান বোঝাতে চলতি কথায় বলে, এক হাত ছাড়া। মলুটি গ্রামেও যেন এক হাত ছাড়া মন্দির। চুমড়ে আর চন্দননালা নামে দু’টি নদীর পাড়ে গ্রামটির শোভাও সুন্দর।
এবারের পুজোয় আবার এক মন্দির গ্রামে গিয়েছিলাম দল বেঁধে। এই গ্রামও মন্দিরময় পাথরা নামে পরিচিত। পাথরাও নদীর তীরের গ্রাম। মেদিনীপুর শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে গ্রামটি। বীরেন্দ্র সেতু থেকে নেমে কিছুটা গিয়েই ডান হাতি রাস্তা। তার পর পরে হাতিহলকা গ্রাম। সেখান থেকে কিছু দূরে কংসাবতী নদীর তীরে পাথরা গ্রাম। আমরা অবশ্য মেদিনীপুর থেকে যায়নি। আমরা কর্ণগড় থেকে ফেরার পথে পাথরা ঢুকেছিলাম।
মলুটি সফর আর পাথরার পথে ঘোরার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমরা রাত কাটিয়ে ছিলাম মলুটিতে। কিন্তু পাথরায় ছিলাম অল্প সময়। কারণ শালবনির দিকে অনেক জায়গায় ঘুরে তার পর পাথরায় ঢুকেছিলাম আমরা। তখন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে। হাতিহলকা থেকে পাথরা যাওয়ার রাস্তার কিছুটা অংশ একটু দুর্বল। গ্রামের ভিতর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরে একটা বাঁধের রাস্তা পড়ল। পিচের রাস্তা। ডানদিকে কংসাবতী। কিছুটা যাওয়ার পরে ডান হাতে বাঁধের নীচে, প্রায় কংসাবতীর কোলে একটা এক রেখ মন্দির দেখা গেল। মনে হলে, মন্দিরের গ্রাম পাথরায় ঢুকছি। ওই মন্দির দিয়েই সফর শুরু হবে কিনা জিজ্ঞাসা করছিলাম। কিন্তু দীপকদা বলল, মন্দিরটা নতুন বোধহয়। যদিও পরে জানতে পারব, নতুন নয়, ওটা সংস্কার করার পরের চেহারা।
গাড়ি কিছুটা এগিয়ে যেতে দেখলাম, বাঁ হাতে একেবারে বাঁধের গোড়া থেকে একগুচ্ছ মন্দির। একটু ভিড়ও আছে। আমরা নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। নেমে আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম ছবি তুলতে। ইন্দ্রদা, বাবলা আর দীপকদা ঘুরে বেড়াচ্ছিল নিজেদের মতো করে। যেখানে অনেকগুলো মন্দির কাছাকাছি রয়েছে সেই জায়গাটা বেশ সুন্দর। ঘাসের পুরো আস্তরণ পুরো চত্বর জুড়ে। এই চত্বরের চার দিকেই কিছু না কিছু মন্দিরের মতো নির্মাণ রয়েছে।
একেবারেই দক্ষিণ দিকে দেখলাম পাশাপাশি তিনটি মন্দির। মন্দিরের সামনে কোনও ভিডিয়ো শ্যুটিং হচ্ছিল। পূজারিণী বেশে একটি মেয়ের শাঁখ বাজানোর ছবি ভিডিয়ো বন্দি করা হল। তিনটি মন্দিরের আগেই একটা পঞ্চরত্নের মন্দির পড়বে। একটু বড়সড় মন্দির। ত্রয়ী মন্দিরে বাঁদিকে একটি দালানের মতো মণ্ডপ। আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এলাম, এটা নিশ্চয় দুর্গাদালান। মন্দিরগুলো চিনতে আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ কোনও মন্দিরের পরিচয় দেওয়া বোর্ড লাগানো নেই। অথচ জায়গাটা পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। অধিগ্রহণ বিষয়ে বোর্ড লাগানো আছে। এই তিন মন্দিরের ডান দিকে মাঠের এক পাশে ভাঙাচোরা একটা নির্মাণ আছে। কীসের জানি না। পূর্ব দিকে একটি মন্দির একেবারেই ক্ষয়ে গিয়েছে। এই চত্বর ঘেঁষা বাঁধের ঠিক পাশেই একটা সুন্দর দেখতে মন্দির অনেকটা মাটির নীচে দেবে গিয়েছে।
একটা সুন্দর নবরত্ন মন্দির রয়েছে এই চত্বরের ঠিক উল্টো দিকে। বাঁধের একটু নীচে। আমরা চার জনে গেলাম। রাজাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। ও একা একা মোবাইলে ছবি তুলে বেড়াচ্ছিল। নবরত্ন মন্দিরটায় দেখলাম দারুণ কারুকাজ। টেরাকোটার কাজে রামায়ণের ছবি মনে হল। তবে অনেকগুলো জায়গায় খোবলানো। তার মানে ফলকগুলো হয় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বা খুলে নিয়েছে কেউ। মন্দিরের পাশ দিয়ে ঝোপজঙ্গল ভেদ করে দেখা যাচ্ছিল কংসাবতী নদী। আমরা নেমে গেলাম নদীর দিকে। চাষের জমির আল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একদম নদীর কাছ বরাবর। তখন সূর্য প্রায় অস্ত গিয়েছে। অল্প আলোয় দেখছিলাম খেয়া পারাপার।
কিন্তু মন্দির কি এই কটাই? স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি জানালেন, বাঁধ ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকে গেলে আরও কিছু মন্দির পড়বে। আমরা চার জনে হাঁটতে শুরু করলাম। রাজা তখনও অনেকটা পিছনে পড়ে আছে। বেশ কিছুটা হাঁটার পরে ডান দিকে বাঁক নিতে হল। একটা পুকুর পাড় দিয়ে কিছুটা গিয়ে দেখলাম, পরপর তিনটি মন্দির। একটা পুরনো বাড়িও ছিল। আমরা ওই জায়গায় ঢুকতেই তিনটে বাচ্চা ছেলে মেয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়েছিল। ওরা মন্দিরের কথা বলছিল। যেন গাইডের ভূমিকায়। ওরা বলল, এটা কাছারি বাড়ি।
অনেক সকালে বেরিয়েছি। এবার ফিরতে হবে। পাথরার কী ইতিহাস, কোনটা কোন মন্দির, কীসের নির্মাণ কিছুই বুঝতে না পেরে ফিরতে লাগলাম। এখানে লোকজন ভালই আসেন। কর্তৃপক্ষ যদি মন্দির ও নির্মাণগুলোর পরিচয় দেওয়া বোর্ড লাগান তাহলে ভাল হয়। পরে অবশ্য তারাপদ সাঁতরার ‘পুরাকীর্তি সমীক্ষা: মেদিনীপুর’ বই দেখে কিছুটা ইতিহাস জেনেছিলাম। জেনেছিলাম, পাথরা গ্রামটি বহু পুরনো। কংসাবতীর সুদিনে পাথরা গ্রামে একসময়ে নীল ও রেশম শিল্পে নাম করেছিল। এই দুই ব্যবসায় ধনী হয়েছিলেন এলাকার বেশ কয়েকজন। তাঁরা পাথরায় বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। নবরত্ন মন্দিরটি মজুমদার পরিবারের তৈরি। এছাড়াও উত্তরপাড়ায় বন্দ্যোপাধ্যায়দের মন্দির রয়েছে। সেগুলো দেখলাম কি? জানি না।
এলাকাটি বহু প্রাচীন তার প্রমাণ পাওয়া যায় এক মূর্তি থেকে। বেশ কয়েক বছর আগে পাথরায় একটি লোকেশ্বর-বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। মূর্তিটি কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের মত, খ্রিস্টীয় নবম শতকের শেষ দিকে তৈরি।
আমরা পাথরা থেকে বেরিয়ে হাতিহলকা গ্রামে ইয়াসিন পাঠানের সঙ্গে দেখা করলাম। এই ব্যক্তিটিই পাথরার রক্ষক। পাথরার মন্দিরগুলো ধ্বংস হতে বসেছিল। তিনি এবং কয়েকজন ‘পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি’ তৈরি করে ৩০ বছর ধরে মন্দিরগুলো রক্ষার জন্য লড়াই করেছেন। ‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ’ ২০০৩ সালে পাথরার ৩৪টি মন্দির এবং মন্দির সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করেছে। এই প্রচেষ্টার জন্য ১৯৯৪ সালে ‘কবীর পুরস্কার’ পান ইয়াসিন পাঠান। রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার হাত থেকে পুরস্কার নেন তিনি। এমন মানুষের সঙ্গে দেখা করা উচিত।
নিজের অফিস ঘরে বসেছিলেন ইয়াসিন পাঠান। আমরা কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনলাম। কিছুদিন আগে বেরিয়েছে তাঁর জীবনীগ্রন্থ, ‘পাথরার পাঠান’। আমরা কিনে নিলাম। সঙ্গে একটি ইংরেজি বইও। ইয়াসিন পাঠানের লেখা, ‘পাথরা এ ভিলেজ অব টেম্পল’।
আমাদের ঘোরাঘুরির দিন ছিল দশমী। এ বছরের মতো পুজোর সফর শেষ করে বাড়ির পথ ধরল আমাদের গাড়ি।
কভারের ছবি— ঘাসের চত্বরের মন্দিরগুলো
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)