দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা
গন্তব্য যদিও চড়িদা কিন্তু ভ্রমণ শুরু হল আমতা থেকে। সান্ধ্যজলযোগে চরিতের পান্তুয়া গলাধঃকরণ, মেলাই চণ্ডী মন্দিরে দৃষ্টিনিঃক্ষেপণ, পরিশেষে উদ্বেল উদ্বেগে টোটোযানকে স্টেশন অভিমুখে চালনা করার মধ্যে দিয়ে। নাঃ, ফেলুদার মত বিপর্যস্ত হইনি। ট্রেনই তার সময় ফেল করেছে তাই খানিক বিশ্রাম পাওয়া গেল এদিকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। সৌরভ পায়চারি ছেড়ে হাজির হল প্ল্যাটফর্মের ছাউনিতে।
হাওড়া পৌঁছতে দেরি হলেও চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার আমাদের জন্য ইতিউতির সময়-সুযোগ রেখেছিল। তাই স্টেশন ছেড়ে গঙ্গার ঘাটে উপস্থিত হয়েই কাকিমার হাতের লুচি আলুরদমে মনোনিবেশ করা গেল।আলোঝলমলে ব্রিজের নীচে গঙ্গার আলোকতরঙ্গ কতশত দার্শনিক ভাব জাগিয়ে যাত্রা ভণ্ডুল করার উদ্যোগ নেওয়া মাত্রই উঠে পড়লাম। মনে মনে ঝালিয়ে নিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্য। ভাদু পুজো, ছাতা পরব আরও আরও কত কী!
পুরুলিয়া মানে কি শুধু প্রকৃতি! তবু ভ্রমণার্থীদের মুখ চেয়ে চেমটাবুরু, মাছকান্দার ব্যবস্থাও রাখতে হয়েছে। হাজার হোক ট্যুর ম্যানেজারের পদ পাওয়া তো কম সৌভাগ্য নয়। যদিও পদে পদে তা বুঝেছি, বুঝিয়েওছি হ্যাডকের ভাষায়। তবে মিথ্যে বলব না, সাহস করে অতিরিক্ত অফিস-ছুটি নেওয়া, কেটে ফেলা টিকিট বাদ দিয়ে আবার নতুন টিকিট করা, কান-মুখ (প্রায়) বুঁজে আমার বাক্যি শোনা কিংবা মাছকান্দায় ম্যানেজারের অধঃপতন থেকে উত্থানে অর্পণ, সৌরভের বন্ধুকৃত্য অতুলনীয়। উপরিপাওনা ফিরতি পথে শেষ ঘটনার স্মৃতিকণ্ডূয়নে সহায়তা।
যাই হোক, গোড়ার কথায় মানে ট্রেনের গড়ানোর কথায় আসি। চক্রধরপুরের চক্র গড়াতে অতিরিক্ত আধঘন্টা সময় লেগেছিল। অর্পণ উলুবেড়িয়া থেকে উঠবে তাই একটা দুশ্চিন্তা ছিল। ট্রেন নড়াচড়া শুরু করতেই অর্পণকে সচল রাখার জন্য দূরাভাষে নানাবিধ উদ্বেগ-ফোড়ন যোগে পূর্বাভাস দেওয়া শুরু হল। এ-যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা টের পেলাম তার আবির্ভাব এর কিছু পরেই। দুই অবৈধ যাত্রীর (যাদের একজন অর্পণের সাধের আপার বার্থ দখল করতে চেয়েছিল) সঙ্গে চেকারের বাদানুবাদ থেকে বৈধ যাত্রী পিছু চেকারের হাঁকডাক, সহযাত্রী ছোকরার উৎকট সংগীত সেবা কিছুই তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না। জানলা দিয়ে আসা হিমেল হাওয়ার স্পর্শে তার যত্ন করে বিছানো চাদর শুধু লেপ হয়ে গেল। ঈর্ষায় আমি পাশ ফিরলাম গন্তব্য পর্যন্ত। তন্দ্রা ভাঙল অর্পণবাবুর সাড়া পেয়ে। ট্রেন তখন আদ্রায় জিরোচ্ছে।
দাঁতন হাতে নেমে পড়লাম আর্দ্রক চায়ের খোঁজে। ব্যর্থ সন্ধান শেষে ফিরতেই দেখি অর্পণবাবু তিনখানা ইডলি আর দাঁতভরা হাসি নিয়ে উপস্থিত। আমরা বিজাতীয় প্রাতঃরাশে আপত্তি জানাতেই ওর দাঁত, ইয়ে, মুখ চলতে থাকল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ট্রেন পুরুলিয়া পৌঁছল। যদিও তখন দেরির বহর একঘণ্টা পেরিয়েছে। টিকিট কাটার সময় পর্যন্ত বন্ধু জিতেনের বাড়ি আমাদের সম্ভাব্য আশ্রয় ছিল তাই টিকিট ছিল কান্টাডি পর্যন্ত। কিন্তু সেই আশা বিফলে গিয়েছিল। তাছাড়া বিশ্বকর্মা পুজোর দিন চাকলতোড়ের ছাতা পরবে আসার জন্য বাস চলাচলের হাল-হকিকত জানতে পুরুলিয়ায় নামাই স্থির হল। কিন্তু সুবিধা হল না। বাসের কাঁপুনি দেখে তার একমাত্র দরজা দিয়ে দ্রুত ভিতরে সেঁধোলাম। অর্পণ, সৌরভ আগেই উঠে জায়গা রেখেছিল। অন্যান্য যাত্রীরাও একে একে উঠতে লাগলেন।
সবে গা-ছাড়া দেব এক উঠন্ত যাত্রী এসে বললেন আমার অধিকৃত আসনটি তিনি নাকি টিকিটের বিনিময়ে গস্ত করেছেন। শুনে আমাদের একগাল মাছি। টিকিট কোথায় কাটে? এই গাড়িতে তাহলে যাওয়া হবে কিনা? গেলেও দাঁড়াতে হবে কিনা? সদুত্তর, নিরুত্তর থেকে আঁচ করলাম আপাতত ফাঁকা আসনগুলি ভর্তি করাই কর্তব্য। তেমনি একখানা আসনে বসা মাত্রই পাশের সহযাত্রী আশ্বস্ত করলেন। টুকটাক আলাপচারিতা চলতে থাকল। কাছে হলেও আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত ঠাঁই পেয়েছি। অর্পণ দেখি তার বাকি থাকা ঘুমটুকু পোষানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা কি তা হতে দিই!
কাঁসাই-সংলগ্ন এলাকা জুড়ে কাশবন দেখা দিতেই অর্পণের ঘুম ভাঙালাম। কান্টাডি, উরমা, বলরামপুর — পাহাড়শ্রেণী ক্রমশ স্পষ্টতর হতে লাগল, বাড়তে লাগল চড়াই। বলরামপুরে একটা ছোট্ট বিশ্রামের পর বাস তার নিজের খেয়ালে আবার গন্তব্যমুখে চলতে থাকল। আমাদের কোনো তাড়া নেই। তবে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার বাস যাত্রায় কমবেশি সবাই বিরক্ত হচ্ছিলাম।
চড়িদায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে পিনাকীবাবুর ছোট্ট ইস্কুল লাগোয়া অতিথিনিবাসে। ছবি দেখেই মন ভরে গিয়েছিল। ঘরের পাশেই পাহাড়শ্রেণী। ঘর থেকে পাহাড়ের দূরত্বটুকু সবুজ ধান ক্ষেতে ঢাকা। আমাদের সম্পর্কের দূরত্বগুলো যদি এমন সবুজ হতো? বলরামপুর থেকে বাস ছাড়ার পরেই পিনাকীবাবু ফোনে আমাদের খোঁজ নিয়েছিলেন। সহৃদয়, নিরহংকারী, সমাজসেবী মানুষটিকে ফোনে এবং প্রত্যক্ষভাবে যতটুকু পেয়েছি শ্রদ্ধায় নত হয়েছি। প্রথম ফোনালাপেই তিনি জানিয়েছিলেন এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিষয়ে তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উদ্যোগের কথা। এ-যে তাঁর জীবনের ব্রত স্কুল প্রাঙ্গণে ঢোকার মুহূর্তেই তা বুঝলাম। তাঁকে ঘিরে থাকা ছাত্রদলের ঘেরাটোপ পেরিয়ে তিনি আসতেই পারছিলেন না আমাদের কাছে। মুগ্ধ হওয়ার মতো সে দৃশ্য।
ঢোকার পথে আমরা টাটা হোটেলে খাওয়া সেরে এসেছিলাম।পরিকল্পনামাফিক আজ আমাদের চেয়ে চেমটাবুরু যাওয়ার কথা। তাই চান সেরে আমরা এগিয়ে গেলাম পিনাকীবাবুর কাছে। এমন পরিবেশে ঘরে তালা দেওয়ার কথা মনে আসে না। উনিই প্রসঙ্গটি তুললেন। আমাদের সমবেত আপত্তি সত্ত্বেও উনি একটি তালা এনে দিলেন অতিথিদের সুরক্ষায়। অল্প হেঁটে চড়িদা মোড়ে পৌঁছনো মাত্র ঝালদাগামী বাস হাজির। মিনিট পনেরোর মধ্যে কারেংমোড়ে উতরলাম। এবার টোটোযোগে খয়রাবেড়া গমন। দাঁড়িয়ে থাকা একটি টোটোচালকের কাছে সে-বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হল। আমাদের গোটা যাত্রাটাই গণপরিবহন নির্ভর তাই সময়ের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ক্যাপ্টেনকে সচেতন থাকতে হচ্ছিল। যাই হোক, টোটোতে প্রায় চার কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই ভেঙে খয়রাবেড়া জলাধারের কাছে হাজির হলাম।
পথে চারদিক ঘেরা পাহাড় যতটা চোখ টেনেছে ততটাই চোখ-মনের কাছে দাবি জানিয়েছে নিমরাটাঁড়ের কুলবাগান। এ যেন আবোল-তাবোলের দেশ। নিম জমিতে কুল গাছ। অমন পরিণত কুলগাছের বাগানও আগে দেখিনি। মুগ্ধতার আবেশে কেউই বোধহয় ছবি তোলেনি।পরে জেনেছি, গাছগুলোতে লাক্ষা চাষও হয়। এ-অঞ্চলে লাক্ষা চাষ একটি অর্থকরী জীবিকা। চলতি পথে পরিচয় হল চালক সুধাংশু গরাঁইয়ের সঙ্গে। কাছের গ্রাম বুড়দার ছেলে। পুরুলিয়ার পুথিদাদু নামে খ্যাত গুরুচরণ গোরাই সুধাংশুরই দাদু। ভারাক্রান্ত মনে ও জানিয়েছিল, দাদুর মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহ করা বইয়েরা এখন অপঠিত অবস্থায় আছে, থমকে আছে তাঁর শুভ উদ্যোগগুলি। সুধাংশুর সারল্য, আন্তরিকতা এ-যাত্রার আরেক পাওনা। আমাদের টুকটাক আগ্রহী প্রশ্নে সে উৎসাহভরে জানিয়েছিল পাহাড়ের গল্প। বিশেষ করে বরড়া পাহাড় আর তার মাঘ মাসের পরবের কথা। এছাড়া আছে সতীদাহের স্মৃতি জড়ানো ঝাবরী ঘাটের সতীমেলা। যার টানে পুণ্যার্থী নারীদের ঢল নামে মাঘের দ্বিতীয়ায়। টুসু তো আছেই।
এখানে এসে একটা বিষয়ে বেশ আশ্চর্য হলাম। এখানে যাকেই ভাদু পুজো নিয়ে জিজ্ঞাসা করি সেইই অবাক হয়ে জানায় এ-বিষয়ে আগে শোনেনি। চড়িদাতেও ভাদুর চল খুব কম। কিন্তু চড়িদাবাসী সে-বিষয়ে অবগত। অথচ সাত কিলোমিটার দূরের অঞ্চলের মানুষ তার নামটুকু শোনেনি! এ কি আশ্চর্য নয়? তবে ছাতা পরবের নাম কম-বেশি অনেকেই জানে। কিন্তু এই উৎসবের মরসুমে জিতাষ্টমী বা জিতা পরবের চল সর্বত্র, সর্বজনে।
খয়রাকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে পাহাড়শ্রেণী। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের বুক ভেঙে বয়ে আসা জলধারা মাছকান্দাকে বেঁধেই খয়রাবেড়া জলাধার। শুনেছি খয়ড়ার একদিক ঘিরে থাকা চেমটা অযোধ্যার উচ্চতম শৃঙ্গ। আসার পথেই সুধাংশু দেখিয়েছিল চেমটার শুরু এবং তার একটি চড়াই-পথ। সে-পথ বোধহয় একটু দুর্গম এবং অপ্রচলিত। খয়রায় নেমে দেখতে পেলাম অভিযানের আরেক পথ। সেপ্টেম্বরে এখন পর্যটকদের আনাগোনা কম। বিলাসবহুল আবাসকেন্দ্রটিও তুলনামূলক ফাঁকাই। অভিযাত্রীর সংখ্যা তো নেইই। বাইরের দোকানপাটে অনাবাসী পর্যটকদের দেখা মিলল। প্রসঙ্গত, পাখিসন্ধানী এবং বিশেষজ্ঞদের কাছে শুভ্রদা (শুভ্র পাখিরা) পরিচিত হলেও পুরুলিয়ার অভিযাত্রীদের কাছেও ক্রমশ সুপরিচিত হয়ে উঠছে। সেই শুভ্রদার কাছেই চেমটা এবং পরদিনের মাছকান্দা বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছিলাম আসা থেকে পৌঁছানো পর্যন্ত। অনভিজ্ঞদের জন্য দুই গন্তব্যেই পথপ্রদর্শক যে প্রয়োজন তার খানিক সমর্থন পেলাম সুধাংশুর বক্তব্যেও। এক পরিচিতের দোকান দেখিয়ে ও এ-বিষয়ে কথা বলতে বলল।
দোকানদারের এক আত্মীয় প্রদর্শকের কাজ করে থাকেন। আমাদের সামর্থ্য এবং আগামী যাত্রার কথা ভেবে একটু পিছু হটলাম। একটু সময় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সারলাম। সুধাংশুও ছিল তার পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে।বারবার বন্ধুদের কাছে ফোন করে ও জানতে চাইল আমাদের সাহায্য করার মতো কোনো বন্ধু ফাঁকা আছে কিনা। কিন্তু সাড়া মিলল না। কাজের সূত্রে বেশিরভাগই এখন প্রবাসী এবং উপস্থিত জনেরা ব্যস্ত উৎসবের মরসুমে। কাজের জন্য ও নিজেও সময় দিতে পারবে না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করল। তবে কাল সকাল-সকাল গাড়ি পুজো সেরে চেষ্টা করবে আমাদের মাছকান্দা যাত্রার সহযোগী হতে। এছাড়া সঙ্গী হতে পারে ওর অভিজ্ঞ কোনো বন্ধুও। এই অল্প সময়ে সে বড় কাছের বন্ধু হয়ে উঠল। আমরা ফেরার পথে ওর সঙ্গেই ফিরব জানিয়ে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে। তখন মাঝ-দুপুর। ওঠা-নামার জন্য ঘণ্টা তিনেক সময় কম করে লাগবে একথা বহুজনবিদিত। তাই অচেনা জায়গায় অপটু পদক্ষেপ থেকে দূরে থাকলাম।
ইতিমধ্যে দোকানে উপস্থিত হয়েছেন প্রদর্শক রমেশ মাহাতো। তিনি দোকানদারের জ্যেঠু-স্থানীয়। দোকানদার জানতে চাইলেন ওঁনাকে আমাদের প্রয়োজন কিনা। আমরা চায়ের কাপ হাতে নানাপ্রকার ভণিতা শেষে জানালাম,প্রয়োজন। দর কষাকষি করে অফ-সিজেনের রেট আরেকটু কম করার নানা পন্থা খাটিয়ে অবশেষে শান্তিকল্যাণ কায়েম করা গেল। পরে জেনেছিলাম এবং যাত্রা শেষে উপলব্ধিও করেছিলাম এ-পারিশ্রমিক নেহাতই নগণ্য কিন্তু তাও কত প্রয়োজনীয় এবং আন্তরিকভাবে গ্রহণযোগ্য তাঁদের কাছে। আমাদেরও বাড়ন্ত অবস্থা তাই সান্ত্বনা খুঁজতে হল।
রমেশবাবু জাতিতে কুড়মি। বয়স আন্দাজ পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। কাজের মানুষ, কাজ ছাড়া থাকতেও পারেন না। এই বয়সেও তাই শরীর-মন কাজের জন্য সদা প্রস্তুত। টাঙি হাতে অবলীলায় চল্লিশটি কাড়ার (মোষ) তদারকি করে বেড়ান প্রায় আড়াই হাজার ফুটের চেমটার আনাচে-কানাচে। আঙুল উঁচিয়ে আমাদের ওঠার পথটা দেখিয়ে বললেন “কাকু তোমরা উঠো। আমি আসছি।” “কাকু” আমাদের বয়সোচিত সম্বোধন না হলেও তা যে কতখানি স্নেহ মাখা তার রেশ এখনো টের পাই। এ-সম্বোধন অবশ্য স্থানিক।
মিটার কয়েক উঠতেই হাঁফ ধরল। চারপাশ ঢেকে আছে বড় বড় পুটুস গাছে। পুটুসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর এক অপরিচিত গাছ ভিড় বাড়িয়েছে। অন্যান্য গুল্ম তো আছেই। মনে পড়ে, চার বছর আগে বর্ষা ভরা পুরুলিয়াতেই পুটুসের গন্ধ মন কেড়েছিল। সে মুরগুমার এক সন্ধ্যে-নামা। জিরানোর জন্য থিতু হলাম নাকি ছবি তোলার জন্য তা বাকিদের দেখে মনে হল না। এদিকে রমেশবাবুর দেখা নেই। আবার ওঠা শুরু করতেই কানে ভেসে এল সেই ডাক “কাকু এখনো উঠতে পারো নাই।” সত্যিই তো! বয়সে সাজ-পোশাকে, মায় নতুন কেনা জুতোতেও নবীন আমাদের ধরে ফেললেন এক প্রৌঢ়(?)। যার পায়ে কিনা চপ্পল! এবার আমরা তাকে প্রদর্শক হিসেবে সামনে রাখলাম।
অল্প এগোতেই কানে এসেছিল অজানা ধারার মিষ্টি আওয়াজ। কিন্তু ঝোপঝাড়ের আবরণ ভেঙে তার দেখা মেলা ভার। অর্পণ আগে ঝরনা দেখেনি তাই শুরুটা এখান থেকেই হতে পারে ভেবে রমেশবাবুকে ধরলাম। আমরাও তাঁকে কাকুই ডাকছিলাম। ঝরনা দেখাতে তিনি চলতি পথ ছেড়ে বাঁ-পাশের একটা উৎরাই ধরে নীচে নামতে থাকলেন, আমরাও সঙ্গ নিলাম। সেপ্টেম্বরের পুরুলিয়া বর্ষা সবুজ । বর্ষা উপভোগও আমাদের আরেক লক্ষ্য এবং পূর্বাভাসও আমাদের অনুকূলে। কিন্তু টানা দু’দিনের সফরে বর্ষার ছিটেফোঁটা জুটল না। তবে বর্ষা ছাড়াও যে মঙ্গল হয় তা পরে মালুম হয়েছিল। সে কথা পরে বোঝা যাবে। ঝোপঝাড়, পড়ে থাকা একটা প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়ি টপকে আমরা নেমে যাচ্ছিলাম শব্দ লক্ষ্য করে। চারপাশ সবুজ স্নিগ্ধতায় ভার হয়ে আছে। তার মাঝে জলের ধারা চোখে পড়ল। তার পরের দৃশ্য যেন আজকের পর্দা সরিয়ে আদিম আরণ্য-পৃথিবীর সামনে হাজির করল আমাদের।
দেখলাম নীচে ধারার জল আটকে বসে আছে বৃহদাকার একটি মোষ, তার চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে আরও কয়েকটি। তাদের নির্ভীক দৃষ্টিতে, দেহের ভঙ্গিমায়, বিশেষ করে তাদের গায়ের নিকষ কালো রঙ যেন সেই আদিমতার আবেশকে ঘনিয়ে তোলে। নাকি আদিমতা দিয়েই তারা গড়া? কাকু জানালেন, এই জল সুপেয়। ভূগোলের ভাষায় আর্টেজীয় কূপজাত। জলের উৎস খুব দূরে নয় বলেই মনে হল। এও এক আঞ্চলিক পানীয়। অতএব চাখা কর্তব্য। এ-অঞ্চলের পশু এবং পশুচারণকারীদের কাছে তৃষ্ণা মেটানোর অন্যতম অবলম্বন এই ধারা। তাই পানের কৃৎকৌশল তাদের আয়ত্তে। সাধারণত মাটির গা-বেয়ে বয়ে আসা এই ধারা যেখানে একটু ধাপ পেয়ে লাফ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে সেখান থেকেই পাতার চোঙা লাগিয়ে কাকু ভরে দিলেন বোতলগুলো। সে-জল অল্প পরিমাণে এটাসেটামিক্স হলেও আমাদের কাছে অভিযানের জাদু পানীয়। অতএব দেবাসুরের যুদ্ধ না বাঁধিয়ে ভাগ করে পান করলাম। চলা এবং বলায় এই ধান ভানতে শিবের গীত দীর্ঘসূত্রিতার কারণ। কাকুর মতো আপনারাও তাড়া লাগাবেন তার আর মন্দ কী!
আলো তখন বিকেলমুখী। অথচ গন্তব্যের সিকিভাগও অতিক্রান্ত হয়নি। এ-যাত্রায় আমাদের হল্টিং স্টেশনগুলিও আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। কোথাও পাহাড় গড়িয়ে আসা পাথরগুলো ক্লান্ত পথিকদের মাথায় ছাতা ধরেছে, কোথাও বা লতাপাতার চাঁদোয়ার মোহময় হাতছানি। বৃক্ষচ্ছায়া তো আছেই। মাঝামাঝি উঠতেই কেউ একজন ফেরত যেতে চাইছিল, কিছু পরে তার উৎসাহদাতা এবং পরামর্শদানকারীও একই সুর ভাঁজছিল। যদিও এগুলো আমরা আকাঙ্ক্ষার নিগূঢ় প্রতিক্রিয়া বলেই ধরব। তবে এই পর্যন্ত এসে বুঝলাম প্রদর্শক ছাড়া এ-পথ আমাদের কাছে ভুলভুলাইয়া। অনভিজ্ঞদের হারিয়ে যাওয়ার বিবরণ কাকুর মুখে শুনে তার অন্যতর মানে খুঁজতেও আমরা নারাজ।
ওঠার পথে যতই এগোচ্ছিলাম ততই অজানা গাছ, গুল্মের সারি, তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা বিচিত্র সব ছত্রাকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে থাকল। মরা গাছের ডালে ডালে দেখতে পেলাম কান ছাতুর মেলা। তবে এই জঙ্গলে পাখির অল্প সাড়া পেলেও, দেখা পেলাম না। কিছু কিছু গাছের স্থানীয় নাম ও প্রয়োগ জানা গেল কাকুর মুখে। তবে তার সবটুকু যে নির্ভরযোগ্য এমনটা নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলল আঙুরজাতীয় এক ধরনের বুনো ফল মুখে ফেলতেই। কাকুর আশ্বাসেই অকুতোভয় আমরা তা চালান করেছিলাম মুখগহ্বরে। স্বল্পাহারী, সংযমী হওয়ায় আমি একটাতেই নিজেকে আটকে রাখতে পেরেছিলাম। অর্পণ, সৌরভ চারটে থেকে দুটোতে ক্ষান্ত দিয়েছিল। তার পরের অসহ্য চুলকানি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে বেশ কিছু সময়ের জন্য চাঙ্গা রেখেছিল। মস্তিষ্ক অহরহ সেই বার্তা গ্রহণে অর্পণ এবং আমাদের বিব্রত করে তুলছিল। অবশ্য তার মধ্যেই তোলা নিজস্বীতে ভেতরকার সেই শ্রী ধরা পড়েনি ভাগ্যিস! (চলবে)
কভারের ছবি— চেমটা পাহাড়ের চুড়োয়
ছবি লেখক ও বন্ধুরা