দীপক দাস
একটা দিগনির্দেশ হল জয়নগরের দিকে। আরেকটা ময়দার দিকে। দিগনির্দেশ আরেকটা হয়েছিল। কিন্তু অচেনা আর খটমট নাম বলে মনে রাখা যায়নি। তিন দিকের মাঝে দিকভ্রান্ত হয়ে দয়ে মজলাম আমরা। অথচ পরিকল্পনা ছিল দইয়ে মজার।
কত কথাই পড়েছি। শুনেছি। সেই ছোটবেলা থেকে। দই নিয়ে নানা কাহিনি। সব মিলিয়ে অনায়াসে একটা দধি-মঙ্গল হয়ে যাবে। দু’একটা টুকরো শোনা যাক। হাটের মাঝে হাত থেকে পড়ে হাঁড়ি ভাঙলেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু ছিল না। এমন জমাট দই যে রাস্তায় থেবড়ে যেত না। ভোগের চুড়োয় নৈবেদ্যর মতো মাথা উঁচু করে থাকত। অন্য পাত্রে তুলে নিলেই দই-সই। কেউ বলতেন এখানকার দই গামছায় বেঁধে নিয়ে যাওয়া যেত। প্রবাদের মতো একটা বাক্যও ছিল, ‘বাঁদিপোতার গামছা আর মোল্লার চকের দই’। নিজের নিজের ক্ষেত্রে দু’জনেই সেরা। খাবার নিয়ে রূপকথার মতো কাহিনি তৈরি হতে পারে। হয়ও। বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী দইবড়া খাবার জন্য বন্ধক রেখেছিলেন হাতের গয়না। অত দূর যেতে হবে না। আমাদের রাজ্যের হুগলির শ্রীরামপুরের গুটকে সন্দেশের জন্যও নাকি রাধাবল্লভ বালা বন্ধক রেখেছিলেন।
মোল্লার চকের দইয়ের সঙ্গে কোনও দৈবী মহিমার যোগ নেই। সব কাহিনিই মনুষ্য সম্পর্কিত। আর সেই জন্যই আগ্রহ যেন বেশি ছিল। যেতে হবে, খেতে হবে। এমন কারিগরদের ধন্যবাদ দিতে হবে। কিংবদন্তীর সেই কারিগরদের হয়তো পাওয়া যাবে না। তাদের উত্তরপুরুষদের কাছেই না হয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। কিন্তু মোল্লার চকটা কোথায়? খোঁজ মেলে না কিছুতেই। বিস্তর খোঁজের পর বছর দুয়েক আগে একটা সূত্র মিলল। জায়গাটা দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। মোয়ার জন্য বিখ্যাত বহড়ু থেকে যাওয়া যায়। কিন্তু খোঁজ মেলার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল করোনা অতিমারি। দধিমঙ্গল রচনা স্থগিত হয়ে গেল।
সুযোগ মিলল ২০২২ সালে ডিসেম্বর। চেন্নাই থেকে ফিরেছে আমাদের গ্রুপের সদস্য কচি ওরফে শুভ। সে ডেকে নিল ওদের এলাকায় অভিযানের জন্য। বেরিয়ে পড়া হল দল বেঁধে। পরিকল্পনা ছিল, প্রথমে বহড়ুতে মোয়ার খোঁজ করা হবে। মোয়ার মোহ কাটিয়ে দইয়ে মজব। পরিকল্পনা মাফিক অভিযান হলে মজা কীসের? আমাদের পরিকল্পনা সবসময়ই ভণ্ডুল করে অসম্ভব সব অভিজ্ঞতা ছকে রাখেন অভিযান-দেবতা। কিংবা দেবী। মহাদেব দাসের মোয়ার দোকানে মোল্লার চকের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সেটা টের পেলাম। দোকানের অনেকেই আমাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু মোল্লার চকের ভূগোলটাই শুধু ধরা যাচ্ছিল না। কেউ বললেন, জয়নগর থেকে যেতে হয়। আরেকজনের দিক নির্দেশ পুরো উল্টো দিকে। ময়দার দিকে। যে পরোটার দোকানে টিফিন করেছিলাম তিনিও একটা নাম বলেছিলেন। মনে রাখতে পারিনি। এবার কী হবে! মোল্লার চকের দই নাকি মাটিতে পড়লেও কিছু হয় না। মোয়ার দোকানে আমাদের দইয়ের অভিযান মাটি হল বুঝি!
বলিউডের ‘কিং খান’এর একটা জনপ্রিয় সংলাপ আছে। ‘সিদ্দত সে চাহতে হো তো পুরি কায়নাত…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দলের সদস্যদের, ব্যতিক্রম আছে, ব্যক্তি জীবনে এই সংলাপের তেমন প্রভাব নেই। তবে অভিযানে বেরিয়ে কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। অনেকবার প্রমাণ পেয়েছি। এখানেও পেলাম। ‘পুরি কায়নাত’ না হলেও এক হবু ইউটিউবার আমাদের মুশকিল আসান হলেন। চ্যানেল খুলবেন। তাই সে জন্য ‘কনটেন্ট’ ভান্ডার তৈরি করছেন। কম বয়সি ছেলে। নামটা জানা হয়নি। বাড়ি মোল্লার চকেই। আমাদের নোটবুকে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন মোল্লার চকের অবস্থান। বহড়ু থেকে দক্ষিণ বারাসত। সেখান থেকে অটো করে মগরাহাট। সেখান থেকে আরেকটু ভিতরে গেলেই খনকারতলা। সেখানে খোঁজ করতে হবে।
আমাদের সুবিধে হল দক্ষিণ বারাসত থেকে মগরাহাটের অটো খনকারতলা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হলেন। পৌঁছে শুরু হল খোঁজ। ইউটিউবার ভাই আরেকটা উপকার করেছিলেন। তিনি একটা দোকানের নামও বলেছিলেন। মালিকের নাম সাদা। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা দোকান দেখিয়ে দিলেন। তাঁরা আরেকটা দোকানও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপন ঘোষের দোকানটি ছিল বন্ধ। আমরা গেলাম সাদার দোকানে। মিষ্টির দোকান। সাদার ভাল নাম তুহিন ঘোষ। তাঁদের বংশ বরাবরের দইয়ের কারবারি। দাদু দই করতেন। বাবা কমল ঘোষও দইয়ের কারবারি ছিলেন। তুহিনবাবুরা চার ভাই দইয়ের কারিগর। আমরা যে দোকানটি বন্ধ পেয়েছিলাম সেই দোকানের মালিক স্বপন ঘোষ তুহিনবাবুর কাকা।
মোল্লার চকের দইয়ের বনেদি কারবারিকে পেয়েছি। গল্প শুরু করতে দেরি হল না। গল্প মানে আমাদের লক্ষ্য সেই অপূর্ব কারিগরকে খুঁজে বার করা। যাঁর জন্য মোল্লার চকের দই কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু হতাশ হতে হল। ইতিহাস নিয়ে তেমন কিছু জানা নেই তুহিনবাবুর। শুধু জানালেন, বহু বছর থেকে এই এলাকার দইয়ের সুনাম। কোনও এক ঘর নয়, অনেকেই দই করতেন। ফলে কে প্রথম তৈরি করেছেন তা জানা যায় না। কী করে নাম ছড়িয়েছে সেটাও বলতে পারলেন না। তবে মোল্লার চকের দই বহু বছর থেকেই বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হত। সরবরাহ করা হত সেই ফ্রিজ-পূর্ব যুগ থেকে। তখন শিয়ালদহ এলাকা থেকে বিভিন্ন জায়গায় দই যেত। শিয়ালদহে গ্লোব নার্সারির কাছে ঠান্ডা ঘর ছিল। সেখানে দই রাখা হত। এখান থেকে কিছু কারিগর বিভিন্ন জায়গায় বসবাস শুরু করেন। তাঁরাও দই করতেন। এবং তা মোল্লার চকের নামেই বিক্রি হত।
মোষের দুধে হয় দই। মোল্লার চকের দইয়ের কি কোনও বিশেষ নাম আছে? নবদ্বীপের যেমন বিখ্যাত লাল দই বা ক্ষীর দই, তেমন? তুহিনবাবু জানালেন, এ দইও লাল হয়। তাঁরা পোয়াদি দই বলেন। এমন শব্দ বাংলা ভান্ডারে আছে? কোনও শব্দের অপভ্রংশ নয় তো? পয়োধি থেকে এসেছে পোয়াদি? ব্যাকরণবিদরাই বলতে পারবেন। কিন্তু পয়োধি মানে তো সমুদ্র। তার সঙ্গে দইয়ের যোগ কী? খুঁজে পেলাম না। তুহিনবাবুকে মোল্লার চকের দইয়ের কিংবদন্তিগুলো বলা হল। উনি সায় দিলেন। বললেন, ‘‘এখনও ভাঁড় ওল্টালে দই পড়বে না।’’ তাই নাকি! হাতেনাতে পরীক্ষার সাধ হল। খালি একটা গিনিপিগ দরকার। এ বিষয়ে ইন্দ্রর নাম আছে। ওকে চেপেচুপে বসিয়ে দেওয়া হল। কচি আর দীপু ক্যামেরা তাক করে তৈরি। পরীক্ষার মুহূর্ত বন্দি করতে হবে তো। ইন্দ্র তো ভয়ে ভয়ে চোখ উল্টে দইয়ের ভাঁড়ের দিকেই শিবনেত্র হয়ে রইল। ওর আশঙ্কা, পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে ভাঁড় থেকে দই হড়াস করে নেমে এলেই মাথায় ঘোল ঢালার মতো ব্যাপার হবে। অনেকবার পরীক্ষা করলাম। মোল্লার চকের দই পূর্বপুরুষদের মান ডোবায়নি। আমাদের দই খাইয়েছিলেন তুহিনবাবু। কিছুতেই দাম নিতে চাননি। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। ফুড ব্লগারদের এখন লোকে সন্দেহের চোখে দেখে। বিনা পয়সায় খেতেই নাকি বহু ফুড ব্লগার বা ভ্লগার। কপিল শর্মার শোয়েও এ নিয়ে মজা করা হয়েছে। তুহিনবাবু কিন্তু আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এখন মোল্লার চকের দইয়ের কী অবস্থা? তুহিনবাবু বললেন, ‘‘পোয়াদি দই আর কেউ করতে চায় না। এতে প্রচুর খরচ পড়ে। ২০০ টাকা কেজি পড়ে যাবে দইয়ের। অনুষ্ঠান বাড়িতে এখন আইসক্রিম হয় খরচ কম পড়ে এতে।’’ তবে আগের ‘পোয়াদি দই’ও এখন হয় না, এটাও স্বীকার করলেন তিনি। অত দাম দিয়ে কেনার মতো লোক কম। ফলে দোকানদারেরাও কমিয়ে দিয়েছেন এমন দই করা। মোল্লার চকের দই দামে বরাবরই ভারী ছিল। ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমার একটি দৃশ্যে তার প্রমাণ মেলে। সন্তোষ দত্তের মেয়ের বিয়েতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় দই খেয়ে বলে দিয়েছিলেন সেটা মোল্লার চকের। আর সন্তোষ দত্তের স্বগতোক্তি ছিল, ‘ওই মোল্লার চকেই আমার স্ত্রীর ছ’ ছ’গাছা চুরি চলে যাবে’। মোল্লার চকের দইয়ের জন্য মেয়ের বাপ নয় মাকেও মাসুল দিতে হত। এখন অবশ্য এলাকায় কারিগরও কমেছে। এ পাড়া থেকে কিছু লোক বারুইপুর, সোনারপুরের দিকে চলে গিয়েছেন। মোল্লার চকে ৮-১০ ঘর মিষ্টির কারবারি রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সকলে দই তৈরি করেন না। ফলে, মোল্লার চকে এলেও শুনতে হয়, আগের সে দিন আর নেই।
দিন যে নেই সেটা শোনা গেল অজিত ঘোষের কাছ থেকেও। খনকারতলা মোড়ে তাঁর তেলেভাজার দোকান। অসাধারণ বাঙালি শিঙাড়া করেন। খেতে খেতে কথা বলছিলাম। কথায় কথায় জানা গেল, তিনিও একসময় মিষ্টির কারিগর ছিলেন। সন্দেশের হাঁস, আপেল ইত্যাদি দারুণ করতে পারতেন। তৈরি করতেন দইও। অজিতবাবুও মোল্লার চকের দইয়ের দু’টি গুণের কথা জানালেন। আগে এখানকার দই টেবিলে রেখে ছুরি দিয়ে কাটলেও এতটুকু জল বেরোত না। দই খেলে হাত ধুতে হত। এত মাটা থাকত। কেন এমন হত? কারণ দই তৈরিতে কোনও জল ব্যবহার করা হত না। ৪০ সের দুধ ফুটিয়ে ১০ সের করা হত। কোনও মাটা তোলা হত না। তার পর দই বসানো হত। জমাট তো হবেই। সময় লাগত প্রচুর। অজিতবাবুর আক্ষেপ, এখন সেই কারিগরও নেই। সময়ও নেই। ফলে, পোয়াদি দইয়ের দিন গিয়াছে।
পোয়াদি শব্দটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কোনও উৎস পেলাম না। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ে একটা অমৃত দধির সন্ধান মিলছে। প্রস্তুত প্রণালীতে বলা হচ্ছে, এই দইও হয় নির্জলা দুধ থেকে। দই, ক্ষীর, রাবড়ি তৈরিতে নির্জলা দুধ না হলে স্বাদ ভাল হয় না। অমৃত দধিও তৈরিতেও দুধ জ্বাল দিতে দিতে অর্ধেকের কম করে ফেলতে হয়। জ্বাল দেওয়ার সময় দুধ থেকে কোনও সর তোলা হয় না। কিন্তু বিপ্রদাস বলছেন, ‘অমৃত-দধির পক্ষে গাভী-দুগ্ধ-ই উত্তম’। মোল্লার চক আবার মোষের দুধে আস্থাবান। ‘পোয়াদি’ নিয়ে আরও খোঁজ করতে হবে।
একটা বিষয় মনে হল। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মোল্লার চকের দই আর ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমার দইয়ে একটা পার্থক্য চোখে পড়ল। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় দই খেয়েছিলেন চুমকে। কিন্তু জনশ্রুতির যে জমাট দই তা কি ওরকম ভাবে সুড়ুৎ করে চুমকে খাওয়া সম্ভব! পরিচালকের হোমওয়ার্কে ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত নই। সুনামের সময়ের দইয়ে যে আমরা মজিনি!
কভারের ছবি— ইন্দ্রর মাথায় দইয়ের ভাঁড় উপুড় করে দেখা হচ্ছে
ছবি- শুভ, দীপু আর ইন্দ্র
(সমাপ্ত)