কৃষ্ণনগর, খানাকুল।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ভোজনং গোপীনাথ জিউর মন্দিরে

দীপক দাস

কথাটা আসলে কী! ‘শয়নং যত্রতত্র ভোজনং হট্টমন্দিরে’? আমাদের সফরনামায় এ কথার উল্টোটাই হয়। খুঁজেপেতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করে ফেলি। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে খাবার কোনও ঠিক থাকে না। হাটের চালায় হয়তো খাওয়া হয়নি কিন্তু খড়ের চালায় খিদে নিবৃত্তি করতে হয়েছে। এই প্রথমবার মন্দিরে খেতে হল। সফরসঙ্গী বদল হয়েছিল। তাই প্রবচনও পাল্টে গিয়েছে।

অনেকদিন কোথাও বেরনো হয়নি। মনটা দমে ছিল। এক মঙ্গলবার হঠাৎই ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে গিয়েছিল। জটচলদি সিদ্ধান্ত, আজ কোথাও না কোথাও বেরোবই। ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র নিয়মিত সঙ্গীদের দেখিয়ে দেব, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…’। না, শেষ পর্যন্ত একলা বেরোতে হয়নি। দীপ্তেন্দু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির সঙ্গে তখনও দেখা হয়নি। সমাজ মাধ্যমেই পরিচয়। আমাদের মতো ঘুরনচাকি হওয়ায় না-দেখা বন্ধু হয়ে গিয়েছি। পুরো নাম দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা। ও অনেকদিনই চাঁপাডাঙায় ঘুরতে যেতে বলছিল। ওদের ওখানেই বাড়ি। দল পাকিয়ে যাওয়া হবে বলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হয়নি।

ফোন করলাম দীপ্তেন্দুকে। কথা হল, জাঙ্গিপাড়ায় দেখা হবে। তার পর ঠিক হবে জায়গা। দেখা হওয়ার পরে জানতে পারলাম, দীপ্তেন্দু শুধু ঘুরনচাকি নয় ও একজন প্রসাদ প্রিয় ছেলে। আজ চাঁপাডাঙা যাওয়া হবে না। ও আমাদের নিয়ে যাবে হুগলির খানাকুলের কৃষ্ণনগরে। ওখানে আছে গোপীনাথ জিউর মন্দির। মন্দিরে দুপুরে প্রতিদিন খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। রান্নাবান্না নাকি অপূর্ব হয়। দীপ্তেন্দু মোহন্তর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ব্যবস্থা করে রেখেছে। ওখানে ভোজন সেরে বাকি জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হবে।

গোপীনাথ মন্দিরের প্রবেশপথ।

জাঙ্গিপাড়া থেকে যাত্রা শুরু হল। জাঁদা, দিগরুই ঘাট হয়ে খানাকুলের দিকে। এই রাস্তা আমাদের কাছে অনেক স্মৃতির। সেই প্রথম বাইক নিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হওয়া। যেতে চায় না কেউ। ইন্দ্রকে বুঝিয়ে অগ্রপথিক করা হয়েছিল। সাঁকো পার হওয়ার সময়ে ছোটা ডন মানে বাবলার চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। সাঁকো পেরিয়ে ছিল গোপীমোহনপুর বড়দিগরুইঘাটে মা মনসা ফেরি ঘাট। যে ঘাটে টোল আদায় করা একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখে জন্ম নিয়েছিল একটা ছোটগল্প। ছোটদের জন্য লেখা। এবার দেখলাম, ঘাটের লোকজন পাল্টে গিয়েছে। এখন টোল আদায় করা একজন জানালেন, প্রতি বছর ডাক হয় তো। লোকজন পাল্টে যায়। বেশিক্ষণ দেরি করার উপায় ছিল না। মন্দিরে দুপুর ১টার মধ্যে ঢুকতে হবে।

খানাকুলে মানে রাধানগরে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি পেরোতেই মনে পড়ে গেল মন্দিরটা বোধহয় চেনা। অনুমান মিলে গেল। এ জায়গায় আমরা দল বেঁধে এসেছিলাম। সৌগত, দীপু, ইন্দ্র আর বাবলা। জায়গাটার নাম কৃষ্ণনগর। তবে আমরা যে মন্দির চত্বরে আড্ডা মেরেছিলাম সেটা আজকের সফরের গন্তব্য নয়। আজকে তার আগের মন্দিরটি। গোপীনাথ জিউর মন্দির নামে পরিচিত। তবে এর অন্য একটা নামও রয়েছে, ‘অভিরাম গোপালের শ্রীপাট’। দীপ্তেন্দুর বাইক একেবারে মন্দিরের সামনে গিয়ে থামল।

গোপীনাথের রাসমঞ্চ।

মন্দির চত্বরে লোকজন ভালই। গোপীনাথ জিউর মন্দিরটি বিশাল। নবরত্ন মন্দির। এবং বেশ বড়। মন্দিরের পাশে আরেকটি মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরের সামনে আটচালা। মূল মন্দিরের পিছনের দিকে একটা হলঘরে খাওয়াদাওয়া চলছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়া যায়। দীপ্তেন্দু এক ফাঁকে মোহন্তের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। আমরাও খেতে বসলাম। সারি দিয়ে পাত পড়েছে। পরিবেশন করছেন বেশ কয়েকজন। পাতে পরপর পড়তে লাগল ভাত, ডাল, একটা চচ্চড়ির মতো তরকারি। তার পর এল পনিরের তরকারি। তার পর আলুভাজা, পটলভাজা, ঘি ভাত, পায়েস, চাটনি, পাঁপড় আর শেষ পাতে রসগোল্লা। দুপুরের ভোজন তো নয়, মন্দিরে ভোজ। রসগোল্লাটাও বেশ ভাল ছিল। হুগলির রসগোল্লা ভালই হয়।

গোপীনাথের মন্দিরে দুপুরে খেতে গেলে আগে থেকে বলতে হয়। টিকিট কাটতে হয় ৭০ টাকা দিয়ে। ৭০ টাকায় এমন ভোজ! খেয়ে উঠে একটু মন্দির ঘুরে দেখলাম। ছবি তুলে নিলাম কয়েকটা। তার পর বেরিয়ে শ্রীপাটের পাশের মন্দিরে। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিগ্রহ দেখতে পাইনি।

গোপীনাথের নবরত্ন মন্দির।

এবার গোপীনাথ মন্দিরের ইতিহাসটি একটু জেনে নেওয়া যাক। মন্দির চত্বর থেকেই একটা বই কিনেছিলাম। ‘‘শ্রীশ্রী অভিরামলীলা রহস্য’। এই বই অনুসারে, অভিরাম গোস্বামীর জন্ম ১৪০০ শকাব্দ নাগাদ। অর্থাৎ ১৪৭৮ বঙ্গাব্দ। এই বৈষ্ণব মহাজন নিত্যানন্দের পারিষদ ছিলেন। বৃন্দাবন থেকে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয়েছিলেন হুগলির এই খানাকুলে। তখন অবশ্য খানাকুলের নাম ছিল কাজিপুর। পরে নাম হয়, কৃষ্ণনগর। এর পাশের গ্রাম রাধানগর। যে গ্রামে রামমোহন রায়ের জন্ম। তিনি স্বপ্নাদেশে গোপীনাথ জিউর সন্ধান পেয়েছিলেন। মাটির নীচে থেকে বিগ্রহ খুঁড়ে বার করেছিলেন তিনি। যে জায়গা থেকে তিনি বিগ্রহ পেয়েছিলেন সেই জায়গাটি রামকুণ্ড নামে পরিচিত। মন্দির চত্বরে আছে গোপীনাথের রাসমঞ্চও। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের দু’পাশে আছে নহবতখানা। মন্দির চত্বরে একটা বকুল গাছ রয়েছে। কথিত, এই গাছটি সেই কাঠের বাঁশি পোঁতায় জন্ম নিয়েছিল।

পাশের রাধাবল্লভের মন্দির।

গোপীনাথের বিগ্রহ এক পর্ণকুটিরে স্থাপন করেছিলেন অভিরাম গোস্বামী। পরে এই মন্দিরটি তৈরি হয়। এক দৈবী ঘটনায় গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ সিংহ নবরত্ন মন্দিরটি তৈরি করে দেন। কথিত, মন্দিরের বয়স প্রায় ৪৫০ বছর। নবরত্ন মন্দির স্থাপনের দেড়শো বছর পরে আরামবাগ থানার মাধবপুর গ্রামের রায় পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ পাশের মন্দিরটি তৈরি করে দেন। অভিরাম সম্পর্কে অনেক অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায়, তিনি বিশাল একটা কাঠের খণ্ডকে বাঁশী মনে করে বাজিয়েছিলেন। ওই বিশাল কাঠের খণ্ড বইতে ৩২ জন লাগত। আরেকটি কাহিনি হল, কৃষ্ণনগর গ্রামের পাশ দিয়ে বইত রত্নাকর নদী। একবার স্নান করার সময়ে রত্নাকরের প্রবল স্রোতে অভিরামের কৌপীন ভেসে যায়। অভিরাম নদীকে অভিশাপ দেন, তিনশো বছরের মধ্যে নদী স্রোত হারিয়ে বদ্ধ হয়ে পড়বে। সেই রত্নাকরই এখন নাকি শুকিয়ে গিয়ে কানা দ্বারকেশ্বরে পরিণত।

রামমোহন রায়ের বাড়ি।

গোপীনাথ মন্দিরের পাশের মন্দিরটিও সুদৃশ্য। পোড়ামাটির কাজ আছে। মন্দিরে রাধাবল্লভ ও রাধাকান্তের বিগ্রহ রয়েছে। এটি তৈরি করেছিলেন যাদবেন্দ্র চৌধুরী। এই মন্দির চত্বরেই রামমোহনের বাড়ি ঘুরে আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম। প্রায় সাত বছর আগে।

খানাকুলের এই জায়গাটি ঘিরে কিন্তু পর্যটন ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। একদিকে অভিরাম গোস্বামীর ভক্তিযোগ আরেকদিকে রামমোহনের সংস্কারমুক্তির যোগ।

কভারের ছবি— গোপীনাথ জিউর মন্দির

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ (২০১৫ সালের গুলো) এবং লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *