খানাকুল। হুগলি।
জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

সাঁকোর সারি পেরিয়ে ভাসাপুলে

দীপক দাস

সরস্বতী পুজোর দিনে বেরোব! মনটা খচখচ করছিল। পুজোর দিনে কখনও এলাকা ছাড়া হয়নি। সেই ছোটবেলা থেকে। বড় হয়ে তো প্রশ্নই ওঠে না। আরও বড় হয়ে কাজ কারবারে জুতে গিয়ে বেরোতে হত। সে আলাদা কথা। বাড়িতে থাকলে সরস্বতী পুজোয় বেরনোর প্রশ্নই নেই। দূরে কোথাও বেরনোর কথা বলছি। কাছকাছি বেরোতাম। এই দিনে যা কাজ সব কাছাকাছিই থাকত। যার কাছাকাছি কাজ থাকত তার আবার একজন সঙ্গী লাগত। ফলে গোটা দলটাই ব্যস্ত থাকত।

আমরা আবার ঐতিহ্য অনুগত। তাই দুর্গাপুজোর দিনগুলো বনবাদাড়েই কাটে। প্রতি বছর বেরনোর ঐতিহ্য ভাঙিনি যে। ফলে এবার বেশ দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। বেরবো কি বেরবো না। হঠাৎ বেরনোর সপক্ষে যুক্তি খুঁজে পেলাম। এবার তো সরস্বতী পুজো আর প্রজাতন্ত্র দিবস একই দিনে। যদি ধরে নিই প্রজাতন্ত্র দিবসে বেরোচ্ছি, তাহলে ঐতিহ্য নষ্ট হয় না। এড়িয়ে যাওয়ার ফাঁক খুঁজে পেতে মনটা হালকা হল। দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সিদ্ধান্ত ঘোষণা হল। বেরোব আমি আর ইন্দ্র। কিন্তু অন্যরা কেউ উচ্চবাচ্য করল না। বুঝলাম, ওরা প্রজাতন্ত্র দিবসের থেকে সরস্বতী পুজোয় বেশি আগ্রহী। বাঙালির ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ কিনা!

পথের ধারে।

বেরনো ঠিক হওয়ার পর দ্বিতীয় অনিবার্য প্রশ্ন হল, কোথায় বেরনো হবে? আমাদের একটা লক্ষ্য আছে। হাওড়া জেলাকে যত দিক দিয়ে পার করা যায় করব। বেশ কয়েকটি দিকে সফর হয়েছে। একবার দুধরাজ পাখি দেখতে গিয়ে উদয়নারায়ণপুরের মানশ্রী গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামটা খুব ভাল লেগেছিল। এবার ইচ্ছে হল, ওই রাস্তা ধরে যত দূর যাওয়া যায় যাব। এই গ্রাম পার করে গেলে অন্য জেলাও পাওয়া যাবে। অন্য জেলায় পৌঁছনো হবে লক্ষ্য।

বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমি আর ইন্দ্র। মানশ্রী গ্রামের যেখানে পাখি দেখেছিলাম সেই জায়গায় পৌঁছতে ইন্দ্ররও ভাল লাগল। বলছিল আশ্চর্য ধরনের গ্রাম। এত শান্ত, নিঃস্তব্ধ! জানি, এ গ্রাম সকলের ভাল লাগবে। এখন শীতের একটু রুক্ষতা এসেছে। ফলে আমরা যখন দেখেছিলাম তখনকার থেকে সৌন্দর্য একটু কম বলেই মনে হচ্ছে। তবুও কী সুন্দর। আমরা বিভিন্ন বাঁধের রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলাম। পুরো রাস্তাটা গাছগাছালিতে ভরা। কোথাও জমিতে ফসল উঠে গিয়েছে। চাষিরা ইচ্ছে মতো নাড়া পুড়িয়েছেন। ধূসর মাঠে কালো কালো অসচেতনতার দাগ। এত প্রচার, এত বোঝানোর পরেও নাড়া পোড়ানো আটকানো যাচ্ছে না।

সেই খারাপ রাস্তা আর ভাল দৃশ্যের জায়গা।

একটা জায়গায় এসে পড়লাম যেখানে সবুজের গালিচা পাতা ছিল মাঠে। মাঝে হলুদের নকশা। আলু চাষ হয়েছে। মাঝে মাঝে সরষে বুনেছেন চাষিরা। সবুজ আর হলুদের বৈপরীত্যে এক অসাধারণ ছবি তৈরি করেছে। একটা গাছে ঘেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণের ফটোসেশন হয়ে গেল আমাদের। তার পর আবার যাত্রা। একটা রাস্তা খুব খারাপ পেলাম। কোনও একসময় পিচের তৈরি করা হয়েছিল। এখন রাস্তা জুড়ে শুধু পাথর। পিচ উঠে গিয়েছে। রাস্তার ক্ষতটা বাদ দিলে জায়গাটা অসাধারণ। চুপচাপ বসে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে আমাদের মোটামুটি একটা গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছি। সেটা হল চিংড়ের ঘাট। জায়গাটা হুগলি জেলায়। বাঁধ, জমির আলপথ ধরে সেদিকেই এগোচ্ছিলাম। কোথাও সরস্বতী পুজোর বক্স বাজছে। কোথাও আলু জমির পাশে দাঁড়িয়ে নেতা নেত্রীরা স্বাগত জানাচ্ছেন। কোথাও পাকা দোতলা বাড়ির উল্টোদিকে ঢিবির উপরে একটা বাড়ি। বড় করুণ তার দশা। কেঁপে যাওয়া, হেলে পড়া বাড়িতে তখন রান্না হচ্ছিল। বোধহয় বাঁধাকপির তরকারি। এক ঝলক গন্ধ পেলাম। এরকমই টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখতে দেখতে, রাস্তা ভুল করতে করতে পৌঁছলাম চিংড়ের ঘাট। কোথাও একটা বাঁধের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আশপাশের রাস্তা বেশ খারাপ হয়ে আছে। এ পথে অনেক গ্রামেই খারাপ রাস্তা পেলাম।

চিংড়ের ঘাটের কাছে সাঁকো।

চিংড়ে আসলে মুণ্ডেশ্বরী নদীর একটা ঘাট। জায়গাটা হুগলির খানাকুলে। এখানে নদী একেবারে বুজে এসেছে। নদীর মাঝ বরাবর বালির বিশাল বাঁধ। বাঁধের একটা পাশে দমকলে জল সেঁচা চলছে। কী কারণে বুঝতে পারিনি। নদীতে বেশ কয়েকটা নৌকা। তার মানে নদীর সঙ্গে মানুষের একটা যোগ আছে এখনও। এই জায়গা পেরিয়ে যেতে একটা সাঁকো পড়ল। ঘাটে টোল দিলাম। আর শুনতে পেলাম একটা মৃদু ঝগড়া। কেউ একজন নিয়মিত পারাপার করে। কিন্তু সাঁকোর পারানি দিতে চায় না। ঘাটোয়ালের চাপে সন্ধেবেলা সব মিটিয়ে দেবে বলছিল লোকটা। পারানি এড়ানো লোকটা চলে যেতে ঘাটোয়ালের গজগজানি শুনতে পেলাম, ‘‘আত্মীয় হয় তো কী হয়েছে! তা বলে পারানি দেবে না? ওকে ছেড়ে দিলে বাকি লোকেরা কী বলবে!’’

দেখেছিলাম এমনই দৃশ্য। চিংড়ের ঘাট।

বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে গেলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। শান্ত, স্রোতহীন নদী আছে। গাছগাছালি আছে। বাঁধের সুন্দর রাস্তা আছে। এবারের গন্তব্য হরিশচক। আবার নদী বাঁধের রাস্তা ধরে এগোনো। এখানকার বহু রাস্তাই কাঁচা। নদীর পলি দিয়ে তৈরি। বালি বালি রাস্তায় গাড়ি চালাতে অসুবিধাই হচ্ছিল। একটা রাস্তা শুধু বালি হওয়ার জন্য ওদিক দিয়ে যাওয়া বাতিল করতে হল। ইন্দ্র ভরসা পাচ্ছিল না।

একসময় পৌঁছলাম হরিশচক। তার পর আর মনে নেই। আগে নতিবপুর তার পর গড়ের ঘাট পৌঁছেছিলাম নাকি গড়ের ঘাটের পরে নতিবপুর ভুলে গিয়েছি। আমার আর ইন্দ্রর মধ্যে মতভেদ হচ্ছে। তবে একটা কথা বলতে পারি, নতিবপুর আগে এসেছিলাম। সেটা পলাশপাই হয়ে। দীপু, আমি আর ইন্দ্র। কিন্তু নতিবপুরে যে সাঁকোটা পার করলাম সেটাতেই আগেরবার এসেছিলাম কিনা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তখন মুণ্ডেশ্বরী ছিল শুকনো। এখন জলে ভরা। দৃশ্যপট বদলেছে। আমার স্মৃতিও প্রতারণা করছে।

আরেক সাঁকো। চিংড়ের ঘাটের কাছে।

গড়ের ঘাটে অনেকগুলো টুকরো টুকরো দৃশ্য পেলাম। এখানেও একটা সাঁকো। এত বছর ধরে বহু সাঁকো পার করেছি। সব সাঁকোই বাইক চেপে পার করেছি। এখানে স্পষ্ট নির্দেশ, বাইক চেপে সাঁকো পার করা যাবে না। পার করলে অর্থদণ্ড দিতে হবে। বাইক দু’শো টাকা। সাইকেল একশো টাকা। বাইক টেনে ওপারে গিয়ে হাঁফিয়ে গেল ইন্দ্র। এক কিশোর বেরিয়েছিল শাড়ি পরা বান্ধবীকে নিয়ে। তার বিশাল বাইক। সাঁকো পার করে তার দমও হালকা। বান্ধবীর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাঁফাচ্ছিল। এ কী অন্যায় রকম নিয়ম রে বাবা! এর একটু পরেই একটা চার চাকার গাড়ি এল। ইন্দ্রকে বললাম, ‘‘দেখি ব্যাটা গাড়ি চালিয়ে পার করে কিনা? নিয়ম অনুযায়ী, গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাওয়া উচিত।’’ ইন্দ্র হেসে ফেলল।

গড়ের ঘাটে ঢুলন্ত এবং প্রায় ঝুলন্ত সেই লোকটি।

গড়ের ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা ছিল। একটা দারুণ দৃশ্য দেখলাম। নৌকা থেকে পাড়ে নামার জন্য একটা পাটাতন লাগানো আছে। সেই পাটাতনে বিষ্ণুর অনন্ত শয্যায় শায়িত থাকার ভঙ্গিতে একজন শুয়ে। পরনে গামছা। লোকটা ওই অবস্থাতেই ঘুমে ঢুলছে। একবার ভাল মতো টাল খেলেই পাড়ের কাদায় পড়বে। ইন্দ্র ছবি তুলতেই লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে ইন্দ্রকে কাকুতি মিনতি করতে লাগল, ‘‘আমার গামছা পরা ছবি তুলে ফেলোনি তো!’’ কয়েকটা বাচ্চা নদীতে চান করতে এসেছিল। তারা লোকটাকে খেপাতে শুরু করল, ‘‘হ্যাঁ, তুলে ফেলেছে। তোমার ছবি ভাইরাল হয়ে যাবে।’’ নৌকাটা বড়সড়। কিন্তু যাত্রী পারাপারের মতো ঘাট তো নেই। কী হয় নৌকায়? একজন নৌকা থেকে নামছিলেন। তিনি জানালেন, ইট বওয়া হয়। চব্বিশ পরগনা থেকে এসেছিল নৌকাটা। সেদিনই ফিরে যাবে।

গড়ের ঘাটের সাঁকো। গাড়িটা পার হচ্ছে।

আমরা পৌঁছলাম রানিচক। জায়গাটা পশ্চিম মেদিনীপুরে। এখান থেকে ঘাটাল প্রায় ১২ কিলোমিটার। মোড়ের মাথায় একটা ছোটখাট হোটেল ছিল। ইন্দ্র খেয়ে নিতে বলছিল। আমার মনে হল, ঘাটাল বড় শহর। ওখানে নিশ্চয় ভাল কোনও হোটেল, রেস্তরাঁ মিলবে। সেখানেই খাব। খাঞ্জাপুর ইত্যাদি (মনে নেই আর) জায়গা পেরিয়ে ঘাটাল পৌঁছে মনে হল, সিদ্ধান্ত ভুল নিয়েছি। হাসপাতালের উল্টোদিকে কলেজের পাশে যে খোলা হোটেলে খেতে হল তার থেকে রানিচকের হোটেল ভাল ছিল। কী আর করা!

টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে বাইক।

আমরা ঘাটাল ছাড়িয়ে ক্ষীরপাই গিয়েছিলাম। ফেরার সময়ে ফোন করেছিলাম দুই সহকর্মী অভিজিৎ চক্রবর্তীদা আর কৌশিক সাঁতরাকে। সেতুর পাশে একটা দোকানে চা খাইয়ে অভিজিৎদা আর কৌশিক ঘাটাল শহরটা সামান্য ঘুরিয়ে দেখাল। নিয়ে গেল কুঠিঘাটে। ঘাটাল খুব পুরনো জনপদ। বহু ইতিহাস ছড়িয়ে এখানে। শহরটা বরাবরের বাণিজ্য সমৃদ্ধ। কুঠিঘাট ব্রিটিশ আমলে বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। রেশম তৈরির কুঠি ছিল। তাই কুঠিঘাট। কুঠিঘাটের কাছেই ভাসাপুল। ঘাটালের অন্যতম ঐতিহ্য। শিলাবতী নদীতে কতকগুলো নৌকার উপরে তৈরি কাঠের পুল। ব্রিটিশ আমলের পুল। অভিজিৎদা বলছিলেন, এই পুল দিয়ে একমাত্র সাহেবরা যেতে পারত। সাধারণ মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। একমাত্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ভাসাপুল দিয়ে যাতায়াতের। পুলের দু’পারে সিঁড়ি রয়েছে। এগুলোও ইংরেজ আমলে তৈরি। এখনও অবিকৃত রয়ে গিয়েছে।

ঘাটালের ঐতিহাসিক ভাসাপুল।

তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। সান্ধ্য জলযোগের প্রস্তাব দিয়েছিল অভিজিৎদা। কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে গিয়েছিল। কৌশিক আর অভিজিৎদাকে বিদায় জানাতে হল। বাইক ছুটল ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়ক ধরে।

কভারের ছবি— চিংড়ের ঘাট

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *