দীপক দাস
বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বাবর। তিনি মোগল সম্রাট? নাকি কাশীগঞ্জের কোনও রেশম কুঠির রেসিডেন্ট? প্রথমজন হলে বাবরশার শাহিত্ব নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। কিন্তু দ্বিতীয় জনের জন্য মিষ্টান্নের নামকরণ হলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া মুশকিল। বাংলার মিষ্টিমহলে বাবরশা অনন্য। এর অনন্যতা স্বাদে নয়। বৈশিষ্ট্যে, উপকরণে, নির্মাণে। মিষ্টান্নটির উৎস মোদকের মস্তিষ্কে নাকি ভিন প্রদেশে? উত্তর পেতে পাড়ি দেওয়া যাক ক্ষীরপাইয়ে। শাহি-সফর শুরুর আগে একটু সৃষ্টি-তথ্য।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার ক্ষীরপাইয়ের ঐতিহাসিক মিষ্টি বাবরশা। কেউ কেউ মনে করেন মোগল সম্রাট বাবরের প্রিয় মিষ্টি এটি। তাই এর নাম বাবরশা। দ্বিতীয় প্রচলিত গল্পটি হল, এডওয়ার্ড বাবর নামে এক ইংরেজ রেসিডেন্টের ‘জলযোগ পরিতৃপ্ত’ করতে পরাণ আটা নামে এক নিপুণ কারিগর বাবরশা তৈরি করেন। ১৮ শতকে ঘাটালে ইংরেজ, ফরাসিরা বাণিজ্য কুঠি তৈরি করেছিলেন। ক্ষীরপাইয়ের কাছে কাশীগঞ্জেও কয়েকটি কুঠি তৈরি হয়েছিল। এরকমই কোনও এক রেশম কুঠির রেসিডেন্ট ছিলেন এডওয়ার্ড বাবর।
বাবরশার নাম অনেকদিন আগেই শোনা ছিল। শুধু অভিযানটাই যা হয়নি। মাঝে ইন্দ্র একবার ইন্টারনেটে কোনও ভিডিয়ো দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। নানা ভাবে প্ররোচিতও করেছিল। সেবারও যাওয়া হয়নি। ২০২৩ সালে সরস্বতী পুজো আর প্রজাতন্ত্র দিবস একসঙ্গে। মহাছুটি। তাই বেরিয়ে পড়া। সঙ্গী শুধু ইন্দ্রই। বাকিরা পুজোয় ব্যস্ত। আমাদের পাতিহাল থেকে ক্ষীরপাই বেশ দূর। সকাল সাড়ে ১০টায় বেরিয়ে বাইকে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। ঘাটাল শহর থেকেও ক্ষীরপাই ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে। অবশ্য আমরা ঘাটাল-পাঁশকুড়া রাজ্য সড়ক ধরে যাইনি। গিয়েছিলাম গাঁয়ের ভিতর দিয়ে নদী-নালার সাঁকো পেরিয়ে।
নদী-নালার পথে মধ্যাহ্নভোজন হয়নি। দোকান কোথায়? ঘাটালে পড়ন্ত বেলায় রাস্তার পাশে প্যান্ডেল করা হোটেলে বিরিয়ানি খেয়ে বিরতি-যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাইকের গতি কমল দোকানপাটে ক্ষীরপাই লেখা দেখার পর। এবার মিষ্টির দোকানের অবস্থানের খোঁজ। রাস্তার পাশের এক দোকানদার হালদার দিঘি চলে যেতে বললেন। ওখানে কয়েকটি পুরনো দোকান রয়েছে। সঙ্গে এবার প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’ বইটি নিয়েই বেরিয়েছিলাম। বইয়ে বাবরশার বেশ কয়েকজন পুরনো কারিগরের নাম রয়েছে। প্রণববাবু ঘাটালেরই বাসিন্দা। বাড়ি বাসুদেবপুরে। এক পণ্ডিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। পরে অবশ্য থাকতেন হুগলির ডানকুনি এলাকায়। একবার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর। এখন প্রয়াত। বই খুলে কয়েকটি নাম পড়তে রাস্তার পাশে এক শিবমন্দিরের সামনের দোকানদার জানালেন, দু’একটা দোকান হাটপাড়ায় রয়েছে। আগে হাটপাড়া পড়বে। তার পর হালদার দিঘি।
হাটপাড়ার দুই কারিগরের নাম পেয়েছিলাম। বঙ্কিমবিহারী দত্ত ও সুবলচন্দ্র দত্ত। বঙ্কিমবাবুর দোকান আর নেই। আমাদের বাইক গিয়ে থেমেছিল সুবলচন্দ্রের দোকানে। সুবলবাবু মারা গিয়েছেন। দোকান তাঁর ছেলে বিনোদ দত্ত চালান। তিনি দোকানে ছিলেন না। ছিলেন তাঁর ছেলে। ছেলে, নামটা লিখে নেওয়া হয়নি, জানালেন, তাঁরা রোজ বাবরশা করেন না। অর্ডার দিলে স্পেশাল বাবরশা করে দেন। কারণ, টাটকা না খেলে বাবরশার স্বাদ পাওয়া যায় না। তাতে দোকানদার এবং বাবরশা, উভয়েরই বদনাম।
হাটপাড়ার বাবরশা না খেয়ে ফিরতে হবে! লক্ষ্মীকান্ত শাসমলের দোকানও হাটপাড়ায়। এঁর নামও প্রণব রায়ের বইয়ে আছে। বিনোদবাবুর ছেলের কাছে জেনেছি, তাঁর দোকান বড় রাস্তার কাছে। গিয়ে দেখি লক্ষ্মীকান্তবাবুর নামে দু’টো দোকান বিজ্ঞাপিত। তিনি বেঁচে নেই। আমরা গেলাম তাঁর ভাইপোর দোকানে। বাবরশা আছে। একটা চাখলাম। এক বিশেষ ছাঁচ আছে বাবরশা ভাজার। সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তবাবুর ভাইপো জানালেন, ছাঁচ কারিগরের কাছে আছে। কী আর করা! বাইক হালদার দিঘির পথ নিল।
কালীপদ বিশ্বাসের খোঁজ করেছিলাম হালদার দিঘির মোড়ে। পুরনো দোকান। এক ভদ্রলোক দোকানটা দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে পরামর্শও দিলেন, সুধা সুইটসে যেতে। এটাও পুরনো দোকান। এবং বাবরশা ভাল করে। সুধা সুইটস চালান শঙ্কর বৈরাগী। পদবিটা চেনা লাগছিল। প্রণব রায়ের বইয়ে দিলীপ বৈরাগীর উল্লেখ আছে। শঙ্কর বৈরাগী কি তাঁকে চেনেন? শঙ্করবাবু জানালেন, দিলীপবাবু তাঁর বড়দা। একসময়ে বাবরশা তৈরি করতেন। পরে ডাক বিভাগে চাকরি পেয়েছিলেন। আসলে শঙ্করবাবুদের বংশানুক্রমিক দোকান এটা। শঙ্করবাবুর বাবা ধর্মদাস বৈরাগীও বাবরশার কারিগর ছিলেন। তাঁর ১০ ছেলে, এক মেয়ে। তিন ছেলে মিষ্টি ব্যবসায় যুক্ত হন। দিলীপবাবু প্রয়াত হয়েছেন।
এবার বাবরশার কাহিনি। প্রণব রায় আমাদের কাজের অনেক সুবিধা করে দিয়েছিলেন। তাঁর বইয়ের নাম শঙ্করবাবু শুনেছেন। তাতে দাদার নাম থাকায় খুশি তিনি। বইটা কোথায় পাওয়া যায় জানতে চাইলেন। বাবরশার খুঁটিনাটি জানালেন উদার চিত্তে। শঙ্করবাবুও বাবরের সঙ্গে এই মিষ্টান্নের যোগের গল্প শুনেছেন। তবে তাঁর পরাণ আটার গল্পেই বেশি বিশ্বাস বলে মনে হল। যদিও পরাণ আটাকে তিনি পরাণ মোদক বলে উল্লেখ করেছিলেন। মানে সেই রেশম কুঠির রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বাবরের সঙ্গে যুক্ত গল্প।
কী ভাবে তৈরি হয় বাবরশা? শঙ্করবাবু জানালেন, এক কিলোগ্রাম ভাল ময়দা লাগে। আর লাগে ২৫০ গ্রাম ডালডা। রুটির বেকারিতে যে দানা দানা ডালডা ব্যবহার করা হয় সেই ডালডা। ময়দায় ডালডার ময়ান দিয়ে অন্তত ৪০ মিনিট ধরে মাখতে হবে। ভাল মতো মাখা হলে একটু একটু করে জল দিয়ে জিলিপ ভাজার খামির মতো তরল করে নিতে হবে ময়দা। সাদা তেল বা গাওয়া ঘি দিয়ে। বাবরশা ভাজার জন্য একটা ছাঁচ লাগে। বাটির মতো ছাঁচ। পাশে ফুটো থাকে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে মাঝে বসিয়ে দিতে হয় ডাইসটা। তেল গরম হলে ছাঁচে এক ফোঁটা করে ময়দা গোলা ফেলতে হয়। টগবগে তেলে সেই গোলা ছড়িয়ে যায় ছাঁচে। তেলটা বেরিয়ে যায় ছাঁচের ফুটো দিয়ে। এই ভাবে দেড় থেকে দু’মিনিট ধরে ফোঁটা ফেলতে ফেলতে ছাঁচ ভর্তি হয়। ময়দার বিন্দুগুলো একসঙ্গে জমে ছাঁচের আকার নেয়। কিন্তু জাল জাল হয়ে। বাবরশা তৈরিতে সময় লাগে। এক কিলো বাবরশা ভাজতে ঘণ্টা ছয়েক সময় নেয়। ভাজার জন্য কারিগর রয়েছেন। এই ধৈর্যের কাজের জন্য কারিগর ৫০০ টাকা মজুরি নেন। এক কিলো ময়দা থেকে ১৫০টার মতো বাবরশা তৈরি হয়। বিক্রি হয় ১০ টাকা করে। খদ্দেরকে দেওয়ার সময়ে বাবরশার উপরে চিনির রস ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
পুরনো দিনে বাবরশা তৈরির সঙ্গে এখন কিছুটা তফাৎ হয়েছে। এখন বাবরশা ভাজতে লোহার ছাঁচ ব্যবহার করা হয়। প্রণব রায় জানিয়েছেন, আগে মাটির খুরি বা ছাঁচ ঘিয়ের কড়াইয়ে বসিয়ে নারকেল মালার নীচের দিকে ফুটো করে ময়দার খামি ফোঁটা ফোঁটা ফেলা হত। শীতকালই বাবরশা তৈরির উপযুক্ত সময়। শীতে বাবরশা তৈরিতে এক কিলোগ্রাম ভাল ময়দায় ময়ান দিতে ৫০০-৬০০ গ্রাম ঘি লাগত। ‘গ্রীষ্মকালে সেখানে এক কেজি বা বারোশ’ গ্রাম ঘি দিতে হয়’ (একটু বিস্ময়কর পরিমাণ)। শীতে এক কেজিতে ৭০-৮০টা বাবরশা তৈরি হত। গ্রীষ্মে হত ৫০-৬০টা। লোকে বলেন, দোকানদারেরাও বলেন, বাবরশার সেই দিন আর নেই। না থাকার একটা কারণ বোধহয় উপকরণের এবং পরিমাণের তফাৎ। দুই সময়ে পাক প্রণালীতে তফাৎটা লক্ষ্য করা যায়। ঘিয়ের বাবরশার দাম বেশ বেশি পড়ে। তাই অর্ডার ছাড়া তৈরি করতে চান না দোকানদারেরা। ঘিয়ের বাবরশা স্পেশাল। আকারেও নিশ্চয় ছোট হয়েছে বাবরশা। সেটা এক কিলোগ্রামে বাবরশা হওয়ার তুলনামূলক আলোচনাতেই বোঝা যায়।
বাবরশার দামের একটা সময়কালীন তুলনামূলক তথ্য দেওয়া যেতে পারে। প্রণব রায় জানাচ্ছেন, ‘সস্তার বাজারে একটা বাবরশার দাম ছিল চার পয়সা’। গত শতকের আশির দশকে হয় ৫০ পয়সা। শঙ্করবাবু দু’টাকায় ৯টি বাবরশা বিক্রি করেছেন। এখন একটা ১০ টাকা। খদ্দেরকে বাবরশা দেওয়ার পদ্ধতিও বদলেছে। শঙ্করবাবু জানালেন, আগে চুপড়ি বা মালসায় দেওয়া হত। দু’টো বাবরশা রেখে তার উপর রস ছড়িয়ে দেওয়া হত। তার উপরে একটা শালপাতা। তার উপর আবার দু’টো বাবরশা। আবার রস। এভাবে সাজানো হত। এখন মিষ্টির প্যাকেটে বাবরশা দেওয়া হয়। আরেকটা প্যাকেটে ক্যারিব্যাগে মিষ্টির রস। বাড়িতে গিয়ে রস ছড়িয়ে খাও।
বাবরশা কি বাংলার মিষ্টি? সম্ভবত নয়। সঠিক কারণ বলতে পারব না। তবে কয়েকটি যুক্তি সাজানো যেতে পারে। বাংলায় যত রকম ভাজা মিষ্টান্ন রয়েছে সেগুলোর কোনওটার সঙ্গে মেলে না বাবরশার পাক প্রণালী। বরং বাবরশার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ঘেবর বা ঘেওর নামে মিষ্টির। এই ঘেবরের উৎপত্তি নিয়েও সংশয় রয়েছে। শক্তিশালী মত হল, এটি রাজস্থানের মিষ্টি। কম শক্তিশালী দলের মত, এর উৎপত্তি উত্তরপ্রদেশে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মোগলদের সঙ্গে এই মিষ্টি ভারতে ঢুকেছে। অন্য দলের মত, পশ্চিম এশিয়ার রন্ধনশিল্পীদের হাত ধরে এই খাবারের ভারতে অনুপ্রবেশ। মোগলদের হাত ধরে হলে বাবরশার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, ঘেবরের নামে কেন বাবর বা মোগল নেই! ঘেবরের সঙ্গে মিলের কথা প্রণব রায়ও উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কলকাতার কোন কোন দোকানের ঘিওর নামক মিষ্টান্নটি কতকটা বাবরশার মতো’। কলকাতার কোন দোকান তার উল্লেখ করেননি। হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যেত দোকানগুলো অবাঙালি মালিকানার বা অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকার।
ঘেবরের ক্ষীরপাই সংস্করণের নাম বাবরশা হওয়া সম্ভব। কারণ ঘেবর পুরনো মিষ্টি। এই মিষ্টির সঙ্গে রীতি রেওয়াজ জড়িয়ে রয়েছে। রাজস্থানে তেজ এবং রাখিবন্ধনে ঘরে ঘেবর তৈরি হয়। অনেক মেয়ে ঘেবর খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন (তথ্য ইন্টারনেটের দৌলতে)। আবার নববিবাহিতা কন্যার বাড়িতে ঘেবর পাঠানোর রীতি রয়েছে। সেই তুলনায় বাবরশার ব্যাপ্তি এত বিশাল নয়। একেবারেই স্থানিক মিষ্টি হিসেবে রয়ে গিয়েছে বাবরশা। এ জন্য প্রণব রায় আক্ষেপও করেছেন। কিন্তু বাবর শব্দটি কেন মিষ্টির সঙ্গে জুড়ল? প্রণব রায় জানাচ্ছেন, ‘বাবরের ন্যায় এটি অত প্রাচীন নয়’। তাহলে কি এডওয়ার্ড বাবরের সৌজন্যে? একজন রেসিডেন্টের নামে মিষ্টি হতেই পারে। ইংরেজ প্রভুপত্নীর নামে বিখ্যাত মিষ্টি তো রয়েছেই, লেডিকেনি। কিন্তু রেসিডেন্টের নামের মিষ্টিকে হঠাৎ শাহিত্ব দেওয়ার কারণ কী? শা তো শাহেরই সংক্ষিপ্ত রূপ বলে মনে হয়। পরাণ আটা কি বাইরে থেকে শিখে এসেছিলেন? নাকি প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র ঘাটালে বাইরে থেকে কোনও কারিগর এসে পরাণ আটাকে শিখিয়েছিলেন?
উত্তরে থাকি মৌন।
কভারের ছবি— শঙ্করবাবুর হাতে বাবরশার ট্রে।
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)