শুভ বৈদ্য
কিংবদন্তী শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রবাদপ্রতিম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার। একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কোনও স্কুল থেকে একজন মাত্র বিখ্যাত ছাত্র বেরোলে কত আনন্দ হয়। আর একটা স্কুল থেকে তিন তিনজন প্রবাদপ্রতিম ছাত্র! বহড়ু উচ্চ বিদ্যালয়কে রত্নখনি ছাড়া আর কী বলা যাবে?
বহড়ুতে আমরা কিন্তু গিয়েছিলাম পুরোপুরি অন্য কারণে। জয়নগরের বিখ্যাত মোয়ার জন্মস্থান খুঁজতে। আমরা মানে আমাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র দল। আমাকে দলের লোকেরা গ্রুপের শহর শাখার সদস্য বলে। শহর শাখার বাকি দুই সদস্য মোটামুটি বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে। আমিও তাই। এখন চেন্নাইবাসী আমি। কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসেছিলাম গত ডিসেম্বরে। আমার বাড়ি সোনারপুরে। দল ঘোষণা করল বহড়ু অভিযানের। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। কতদিন যে একসঙ্গে বেরোইনি। খুব হল্লা হবে রাস্তায়। একে অপরের পা টানাটানি হবে দুর্দান্ত। দলে এবার রয়েছে বন্ধু দীপু, খাইয়ে ইন্দ্রদা আর বড়দা, মানে দীপকদা।
বহড়ুতে মোয়ার খোঁজ নেওয়া হল। এবার খোঁজ আর কী দেখার আছে? মোয়ার দোকানেই বলছিলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি এই গ্রামে। আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি জড়িয়ে এই গ্রামের সঙ্গে। স্কুলের পাশ দিয়ে কিছুটা যেতে হবে। একটা অটো ভাড়া করে নেওয়া হয়েছিল। স্কুলের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম দক্ষিণ পাড়ায়। কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র সেন নামে একজন প্রবীণের সঙ্গে। তিনি একটি জায়গায় নিয়ে গেলেন। একটা ঢিবি মতো জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানেই ছিল কবির বাড়ি। আমরা বিশ্বাস করলাম।
কিন্তু শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি? সেটা নিয়ে খুব ঘুরপাক খেতে হল। কেউই দেখাতে পারেন না। ফিরেই আসছিলাম। পথে এক জায়গায় একটা মাঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি দেখতে পেলাম। ছবি তুলতে গিয়েছি। ইন্দ্রদা ওর ক্যামেরাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অটোর সামনের আসনে গ্যাঁট হয়ে বসেছিল। মূর্তির কাছে জনাতিনেক ছেলে বসেছিল। দীপকদা তাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল। একজন বলল, ‘‘এই তো এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মীয়।’’ ছেলেটির নাম সুমন মুখোপাধ্যায়। তাকে অটোয় চাপিয়ে আবার ফিরলাম দক্ষিণ পাড়ার দিকে। সুমনের নির্দেশে মূল রাস্তার পাশের একটা রাস্তার দিকে বাঁক নিল অটো। এই রাস্তা থেকে কিছুক্ষণ আগে আমরা ফিরে গিয়েছি। এক ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, এদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি নেই। কিন্তু সুমন ওই রাস্তারই একটা ঝোপজঙ্গলে ভরা জায়গা দেখিয়ে বলল, এখানেই এক সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি ছিল।
এখন গায়কের বাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমরা শুধু রোমাঞ্চিত হলাম, এখানে গায়ক একসময় থাকতেন এই কথা ভেবেই। ফেরার সময়ে বহড়ু উচ্চ বিদ্যালয়ের ছবি তুললাম আমি। এই স্কুলে তিনটি ব্লক তিন স্বনামধন্য ছাত্রের নামে। ভবনের দেওয়ালে লেখা রয়েছে নামগুলো। মাঝের ব্লকের দেওয়ালে লেখা, ‘গ্রামের ছেলে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ব্লক’, ডান দিকে ‘ডাঃ নীলরতন সরকার ব্লক’, বাঁ দিকে ‘কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ব্লক’। স্কুলের গর্বের কথা ভেবেই অবাক হলাম।
দীপকদা এর পর জিজ্ঞাসা করে করে একটা পুরনো বাড়ির সামনে নিয়ে গেল আমাদের। বিডিও অফিসের গায়েই। বলল, দেওয়ান নন্দকুমার বসুর বাড়ি ছিল নাকি এখানে। আর তাঁদের শ্যামসুন্দর মন্দিরও খুব বিখ্যাত। নন্দকুমার বসুর অট্টালিকার ভাঙাচোরা অবশেষ দেখতে পেলাম। দেখেই বোঝা যায়, এক সময় কী বিপুল সম্পত্তি ছিল তাঁর। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, শ্যামসুন্দর মন্দিরের দরজা বন্ধ। স্থানীয় একজন পাশের একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ওই বাড়িতে মন্দিরের চাবি থাকতে পারে। কিন্তু গিয়ে হতাশ হতে হল। চাবি পুরোহিতের কাছে। বাড়ি অনেকটাই দূরে। আসবেন সেই বিকেলে। ফলে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে যতটা পারা যায় দেখার চেষ্টা করলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা ঢুকিয়ে ছবিও তোলা হল। দরজাটার অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না।
নন্দকুমার বসু কে জানি না। দীপকদা বই খুঁজে (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি— বিনয় ঘোষ) দেখে বলল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন তিনি। কিছুদিন জয়পুরের দেওয়ান ছিলেন। নন্দকুমার নাকি চুনার থেকে পাথর আনিয়ে এবং জয়পুর থেকে চিত্রশিল্পীদের এনে এই শ্যামসুন্দরের মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। তিনি একটি দোলমঞ্চও তৈরি করিয়েছিলেন। দোলমঞ্চের সামনে দেখা হয়েছিল বীরেশ্বর সেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, শ্যামসুন্দরের মন্দিরের ভিতরে নাকি ফ্রেস্কোর কাজ আছে। আমরা কিছুই দেখতে পাইনি। বীরেশ্বরবাবু আরও তথ্য দিলেন। জানালেন, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি ছিল বহড়ুতে। স্টেশনের গায়েই বাড়িটা। আর জানালেন, বহড়ু স্কুলের ছাত্র ছিলেন মেট্রো রেলের প্রথম জিএম-ও। রত্নখনি কি আর এমনি বললাম!
বহড়ু বাজারের কাছে অটো ছেড়ে দিয়ে টোটো ধরলাম। স্টেশনে যাব শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি। প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটা পাইস হোটেলের মালকিন দেখিয়ে দিলেন বাড়িটা। পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। ডাকাডাকি করতে ছাদ থেকে উঁকি দিলেন একজন। জানালেন, এটাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি। তিনি খাচ্ছিলেন। হাত ধুয়ে নীচে নেমে এলেন। তাঁর নাম নিতাই গঙ্গোপাধ্যায়। কিছুক্ষণ গল্প হল। জানতে পারলাম, তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মামাতো ভাই। নিতাইবাবু জানালেন, কবির চার বছর বয়সে বাবা মারা যান। মেয়েকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। বহড়ু স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন কবি। তার পর কলকাতা চলে যান।
বাড়িটার উঠোনে একটা কুয়ো আছে। একটা দুঃখজনক ঘটনার পরে সেটি যদিও বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিতাইবাবুর এক দাদা গাছ থেকে পেঁপে পাড়তে গিয়ে কুয়োয় পড়ে গিয়েছিলেন। তার পর কুয়োটি বুজিয়ে ফেলা হয়। এই কুয়োর সঙ্গে কি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনও স্মৃতি জড়িয়ে আছে? নিতাইবাবু জানালেন, আছে। কিন্তু কোনও লেখার নাম বলতে পারেননি তিনি। কবির ‘কুয়োতলা’ নামে একটা উপন্যাস আছে। আমার পড়া নেই। বলতে পারব না তাতে এই কুয়োতলার কোনও স্মৃতি আছে কিনা। বহড়ুতে খোঁজ খবর করার সময়ে একজন বলেছিলেন, এই গ্রামে অভিনেতা শেখর গঙ্গোপাধ্যায়েরও বাড়ি। কোথায় সেটা বলতে পারেননি। নিতাইবাবু জানালেন, তাঁদের পরিবারেরই ছেলে অভিনেতা। নিতাইবাবুর দাদা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মামাতো ভাই।
ফেরার সময়ে খুব আনন্দ হচ্ছিল। যখন দলের সঙ্গে ঘুরতে যেতাম একটা কথা মনে হত, আমাদের গ্রামের দিকে কি কিছুই নেই? আজ একটা গ্রামে এতজন বিখ্যাতজনকে পেয়ে আমার আনন্দ হচ্ছিল খুব। তার উপর ইতিহাসখ্যাত নন্দকুমার বসু আর শ্যামসুন্দর তো রয়েইছেন।
কভারের ছবি— বহড়ুতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি
ছবি— দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)