দীপক দাস
মনটা ভীষণই জঙ্গল জঙ্গল করছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে। তখন মার্চ মাসের শেষের দিক। জঙ্গলযাত্রার সুসহ সময় নয় মোটেই। কিন্তু বেরনো হচ্ছিল না দীর্ঘদিন ধরে। এদিকে ঘরে বসে কাজ। সকালের দিকে বেরিয়ে কোথাও ঢুঁ মেরে আসব তারও উপায় নেই। গৃহবন্দি হয়ে জ্বলা দুপুর দেখতে দেখতে দিন কাটছিল। পোড়া কালে সতেজ সবুজ না হলে মন ভাল হবে না। শালের পাতা খসানোর দিন পেরিয়ে এসেছি। দেরি করলে কচিপাতার কালও শেষ হয়ে যাবে। তাই একদিন বেরিয়ে পড়া।
এবং একাই। দলের সকলেই কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত। সময় দিতে পারবে না কেউ। একা একা দূরের সফরে ভালও লাগবে না। তাই কাছের জঙ্গল ঝাড়গ্রাম বা মেদিনীপুর। এই লাইনেই পড়ে রাধামোহনপুর। সেখানে একটা কাজ ছিল। সেসব সেরে ট্রেনে চড়ে বসলাম রাধামোহনপুর থেকে। মুশকিল হল, সেদিন আবার কোনও কারণে ট্রেনের গোলমাল। সরাসরি মেদিনীপুরের ট্রেন নেই। খড়্গপুর পর্যন্ত। কিন্তু পরের ট্রেন পেতে বিস্তর অপেক্ষা।
যাত্রাপথে।
মেদিনীপুর স্টেশনে যখন নামলাম তখন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে। ট্রেনে বসে ফোন করে নিয়েছিলাম সহকর্মী আইচদাকে (কিংশুক)। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কোন দিকে গেলে একটু জঙ্গল দর্শন হবে। মোটামুটি হদিশ মিলল, গুড়গুড়িপালের জঙ্গলই কাছে হবে। কিন্তু আইচদা ৫টার আগে বেরোতে পারবেন না। কাজে ব্যস্ত। মেদিনীপুরে নেমে ফোন করেছিলাম আরেক সহকর্মী বরুণকে (দে)। বরুণ জানাল, স্টেশন থেকে বেরিয়ে সেতুর নীচ দিয়ে গিয়ে রাঙামাটি থেকে বাস ধরতে।
সেতুর নীচ দিয়ে হাঁটছি, ফোন এল আইচদার। কোথায় আছি জেনে নিয়ে রাঙামাটির মোড়ে দাঁড়াতে বললেন। ওখান থেকে আমাকে তুলে নেবেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। লোকাল গাইড পেলে সবসময়ই সুবিধে হয়। রাঙামাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। একটা চিন্তা হল, আইচদাকে চিনব কেমন করে? আমরা বছর চারেকের বেশি সহকর্মী। কিন্তু সামনাসামনি কেউ কাউকে দেখিনি। ভরসা বলতে ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের ডিপির ছবি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। চিনতে না পেরে আইচদা আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেলেন। তার পর দেখতে না পেয়ে ফোন।
যাত্রা দেখেছিলাম এমন আজব খারাপ বাসের সারি।
যাত্রা শুরু হয়েছিল রাঙামাটি থেকে। কিছুটা এগোতেই জঙ্গল শুরু হল। গোধূলি বেলায় বাইক ছুটেছে জঙ্গলের রাস্তায়। দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে রাস্তা ভিজে। শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে বাইকে করে যেতে ভালই লাগছিল। কিছু দূর যেতে এল গোপগড়। মেদিনীপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে একটা কলেজও আছে। রাস্তার পাশে গোপনন্দিনীর মন্দির। এর নামেই এলাকার নাম। দেবীর বিস্তৃত পরিচয় দিতে পারলেন না আইচদা।
যেতে যেতেই আইচদা বলছিলেন, ‘‘বাসে করে আসবেন বলছিলেন, কিছুই দেখতে পেতেন না। এদিকে সন্ধ্যার পরে বাস কমে যায়। ফিরতে বেগ পেতে হত। তার উপর হাতি বেরোয় এদিকে।’’ জঙ্গল দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলাম। ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছি। কিন্তু সিদ্ধান্ত ভুলই ছিল। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, জঙ্গলের দেশে সন্ধের পরে যানবাহনের হাল কী রকম হয়! জেদের কাছে অভিজ্ঞতা হার মেনেছিল।
বটগাছের জাল।
আরেকটু এগোতে আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল। এসবিএসটিসি-র একটা বাস ক্রেনে করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুটা পরে আরেকটা বাস। তার পরে আরেকটা। এরকম খানসাতেক বাস লাইন দিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের আরেকটা জঙ্গল পথে ঢুকে গেল। আমরাও পিছু নিলাম। আইচদার ফটোগ্রাফার সত্তা তখন জেগে উঠেছে। ছবি তুললাম আমিও। একযোগে এত খারাপ বাস কোথায় চলেছে? আইচদা বললেন, কাছেই কোনও ডিপো আছে। সেখানে যাচ্ছে হয়তো। সময় ছিল না বলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।…
শালিখা নামে একটা জায়গায় সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে একটা বটগাছ। ভাল করে দেখব বলে আইচদাকে বাইক থামাতে বললাম। আইচদা বললেন, ‘‘ফেরার সময়। সন্ধে হয়ে গেলে জঙ্গলের কিছুই দেখা যাবে না।’’ জামশোলায় দেখলাম, জঙ্গলের বিস্তীর্ণ এলাকা পোড়া। আগুন লাগানো হয়েছে। আগুনের উত্তাপে বেশ কিছু গাছের ডালপালা ঝলসে গিয়েছে। জঙ্গলে আগুন লাগানো এই সব অঞ্চলের ভয়ঙ্কর ব্যাধি। অনেক সচেতনতা প্রচার করেও থামানো যাচ্ছে না। দেখে খারাপই লাগল।
জঙ্গলে আগুনের পোড়া চিহ্ন আর ঝলসে যাওয়া গাছপালা। চলন্ত বাইক থেকে তোলা।
গুড়গুড়িপাল পৌঁছে গেলাম। বাইক মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে বাঁক নিল। কিছুটা যেতেই গুড়গুড়িপাল ইকোপার্ক। শীতে এখানে পিকনিক করা যায়। শালগাছ ঘেরা জায়গা। খুব সুন্দর। আইচদা জানালেন, এলাকায় প্রায়ই হাতি আসে। কিছু রেসিডেন্ট হাতি থাকে। পার্কের সামনে একটা খেলার মাঠ। খেলছে কতকগুলো বাচ্চা। কিন্তু দর্শকই বেশি। মাঝে মাঝেই তারা অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করে উঠছে।
গুড়গুড়িপাল ইকো পার্ক।
জঙ্গল দর্শন হল। কচি পাতা তখনও শালগাছে। এ রূপ দর্শনের ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। ঝটিকা সফর হলেও জঙ্গলের সান্নিধ্যে এসে মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে থামলাম সেই বটগাছটার কাছে। ন্যগ্রোধ পরিমণ্ডল বোধহয় একেই বলে। সম্ভবত গাছ একটিই। ঝুরি নামিয়ে অনেকখানি এলাকায় নিজেকে ছড়িয়ে নিয়েছে। আসার পথে নেপুরা নামে একটা জায়গা দেখিয়েছিলেন আইচদা। কংসাবতী নদীর পাড়ের এই জায়গায় প্রচুর আনাজ, শাক চাষ হয়। মেদিনীপুর শহরকে আনাজ জোগায় নেপুরা।
জঙ্গলপথে।
অভিযানটা জঙ্গল দিয়েই শেষ হত। হল না আইচদার জন্যই। একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় আইচদা ঝাল রসগোল্লা নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এই রসগোল্লা তৈরি হয় মেদিনীপুরে। আইচদার কাছে আবদার করতে স্টেশন রোডের কাছে একটি দোকানে নিয়ে গেলেন। কিনে দিলেন রসগোল্লা। দাম দিতে দিলেন না কিছুতেই। ঝাল রসগোল্লা মানে রসে গোটা গোটা লঙ্কা দিয়ে ফোটানো। তাতে রসগোল্লার মিষ্টির সঙ্গে একটা ঝাল স্বাদ পাওয়া যায়। লোকে নাকি এই রসগোল্লা এখন পছন্দ করছেন।
লঙ্কা দেওয়া রসগোল্লা। মিষ্টিতে ঝালের ফিউশন।
মেদিনীপুর স্টেশনে পৌঁছে ফোন করেছিলাম আরেক সহকর্মী সোমেশদাকে। সৌমেশ্বর মণ্ডল। স্টেশনের কাছেই বাড়ি। তিনজনে নিজস্বী তুলে, চা খেয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। তার পর দুই সহকর্মীকে বিদায় জানিয়ে রূপসী বাংলা ধরে বাড়ির পথে।
কভারের ছবি— গুড়গুড়িপাল ইকোপার্কের কাছে
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)