বেগোর মোড়।
জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

এখানে বিচ্ছিন্ন হয়েছে দামোদর-মুণ্ডেশ্বরী

দীপক দাস

‘যে স্থানে নৌকা আসিয়াছে, সে প্রকৃত মহাসমুদ্র নহে, নদীর মোহনা মাত্র, কিন্তু তথায় নদীর যে রূপ বিস্তার, সেরূপ বিস্তার আর কোথাও নাই’।— কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

ইলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গম। এখন অবশ্য প্রয়াগরাজ নাম ইলাহাবাদের। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীর মিলনস্থল।

লোকে সঙ্গমস্থল দেখতে যায়। নদী-সমুদ্রের মিলনস্থল, মোহনা। তিন নদীর মিলনস্থল ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রচুর ভিড় হয়। আরেক সঙ্গমস্থল দেখে লোকে উচ্ছ্বসিত হয়। সেটা নবদ্বীপে। ভাগীরথী ও জলঙ্গি নদীর সঙ্গমস্থল। নবদ্বীপ থেকে খেয়ায় ইস্কনের মায়াপুরে যেতে দেখা যায়। ভাগীরথীর কর্দমাক্ত আর জলঙ্গির ঈষৎ সবুজাভ ধারার মিশলেও আলাদা অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।

কিন্তু আমরা সঙ্গম নয়, বিচ্ছেদ দেখতে বেরিয়েছি। বিচ্ছেদ সিনেমায়, সাহিত্যে ভাল বিকোয়। কিন্তু চোখের সামনে ঘটতে থাকলে বড় অসহ্য হয়। আমাদের কিছু করার ছিল না। স্থানীয় পথ প্রদর্শক আমাদের সফরে এক বিচ্ছেদ স্থলকে দ্রষ্টব্য করে রেখেছেন। ঘুরতে বেরিয়ে আমরা কখনও পথপ্রদর্শকের সঙ্গে পাঁয়তাড়া করি না। হামবড়া বহু পর্যটকই যাহা করিয়া থাকেন অমানবিক। ভিন রাজ্যে এই বিষয়ে বাঙালি পর্যটক কিঞ্চিৎ সুনাম করিয়াছেন বলে শোনা যায়।

খুশিগঞ্জের কাছে দামোদরের রূপ।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, দীপ্তেন্দু কিন্তু প্রচলিত অর্থের পথপ্রদর্শক নয়। ও আমাদের বন্ধু। দলের নতুন সফরসঙ্গী। ও গত এপ্রিলের সফর-মানচিত্র ঠিক করেছিল। আর তাতে রেখেছিল দামোদর-মুণ্ডেশ্বরীর বিচ্ছেদস্থল। ভিন ধারার ধারা-বাহিকতা দেখতে রাজি হয়েছিলাম আমরা। বেরিয়ে পড়েছিলাম। চারজনের দল— দীপ্তেন্দু, দীপু, বাবলা আর আমি। আমরা পাতিহাল থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর দীপ্তেন্দু যোগ দিয়েছিল চাঁপাডাঙা থেকে। মূল সফর চাঁপাডাঙা থেকেই ধরতে হবে।

দীপ্তেন্দুর ঠিক করা পথে অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু এটা যেহেতু প্রকৃতি সফর তাই অন্য কথা বাদ থাকবে। যাত্রাপথের অনেক অংশই সুন্দর। চাঁপাডাঙার মোড় থেকে জঙ্গলপাড়ার দিকে দামোদরের বাঁধের রাস্তার দু’ধারের প্রকৃতি অসাধারণ। এ পথে আমি আর ইন্দ্র আগে এসেছিলআম। সে বর্ণনা রয়েছে অন্য লেখায়। শুকিয়ে যাওয়া নদের জলে দেখলাম কিছু পরিযায়ী পাখি। বাংলার অতিথি হয়ে এসে স্থায়ী ভাবে থেকে গিয়েছে। বাইকে বসে আমি সরালের ওড়াউড়ি দেখলাম।

নৌকা বাঁধা ওপারে। খুশিগঞ্জ।

প্রথম যে অচেনা জায়গা নজর কাড়ল সেটা খুশিগঞ্জ খেয়াঘাট। হুগলিতে। নামে খেয়াঘাট হলেও গরমে পার হতে হয় বাঁশের সাঁকোয়। হাওড়ার পশ্চিম প্রান্তে, হুগলি আর মেদিনীপুরের কিছু অংশে এটাই রীতি। বর্ষাকালে নদ-নদী জলে ভরে উঠলে সাঁকো খুলে নেওয়া হয়। তখন নৌকায় পারাপার। খুশিগঞ্জে দামোদর শুকনো। তবুও রূপবান। দামোদর এখানে সোঁতার মতো। প্রায় গতিহীনই বলা যায়। সাঁকো বেয়ে নদের বুকের মাঝে দাঁড়ালে তিরতির করে একটা স্রোত চোখে পড়ে। খুবই অল্প। সে স্রোত সহস্র শৈবাল দাম সরাতে পারে না। তাই শ্যাওলা জমেছে প্রচুর। ছোট ছোট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে স্রোতের প্রতিকূলে, শ্যাওলার লম্বা সারির মাঝ দিয়ে।

খুশিগঞ্জে দামোদরের দু’পারের রূপ দু’রকম। যে পাড় দিয়ে এলাম সেদিকটা সবুজের আভা জোরাল। পাড়ে ধান চাষ হয়েছিল। ধান-সহ কিছু গাছ রয়ে গিয়েছে। ওপারে শুধু বালি। অনেকটা অংশে সজীবতা নেই। বালিয়াড়ির মতো। নেমে দেখেছি, বালিতে পা ডুবে যায়। সাঁকোর কিছুটা দূরে একটা নৌকা। এত সুন্দর জায়গায় একটাই মুশকিল। বালির জায়গায় জায়গায় মনুষ্য কৃত কর্মের ফল ফলে আছে। সুন্দর জায়গা নষ্ট করতে বাঙালিই বোধহয় পারে। সার্বিক স্বাস্থ্যবিধান, যাঁহা সোচ বাহা শৌচালয়— অবাধ্যতায় ভেসে গিয়েছে।

অমরপুরের কাছে খেয়াঘাট।

অনেক জায়গায় যাওয়ার আছে। দীপ্তেন্দু তাড়া দিচ্ছিল। খুশিগঞ্জ পার করে কিছুটা গিয়েই পূর্ব বর্ধমান ঢুকে পড়ল আমাদের বাইক। ধাপধাড়া-হরগোবিন্দপুর হয়ে শুঁড়ে কালনা। সেখানে মুধর এক কাজ মিটিয়ে এগিয়েছিলাম। কোনদিকে আর মনে ছিল না। লেখার সময়ে দীপ্তেন্দুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সব জানতে হল। এটাই ওর শাস্তি। এই সফর ও লিখবে বলেছিল। কিন্তু নানা অজুহাতে শেষ পর্যন্ত হাত তুলে নেয়। তাই এই সফরের যে অংশই লিখি না কেন ওকে নানা প্রশ্ন করে জ্বালাই। কিছু লিখে রাখিনি এটাও সত্যি। দীপ্তেন্দুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমরা শুঁড়ে কালনা থেকে তারকেশ্বরের পাকা সড়ক ধরে ৫-৭ কিলোমিটার এগিয়েছিলাম। তার পর ডান দিকে জাড়গ্রামের পথ ধরি। অমরপুরের কাছে একটা খেয়া ঘাট পার হয়েছিলাম। এই ঘাটের পারাপারেও সাঁকো আছে। সাঁকোর কাঠামোটা বাঁশের, উপরের পাটাতনটা কাঠের। নদে খনন চলছে। ফলে একটা খোবলানো রূপ দেখতে পেলাম।

এই সেই বিচ্ছেদস্থল।

এর পর পৌঁছলাম গন্তব্যে। দামোদর-মুণ্ডেশ্বরীর বিচ্ছেদস্থল। নদ-নদীকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। সারা চর জুড়ে খোবলানোর দাগ। ডাঁই হয়ে আছে মাটি। বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু মেটে রং। অনেকটা দূরে জলধারার চিহ্ন। একসময়ের বাণিজ্যপথ দামোদরের এ রূপ দেখলে কষ্ট হয়। একটা কথাই মনে হয়, কাহারও দিন সমান যায় না। নদী-প্রকৃতি-মানুষ কারও নয়। দীপ্তেন্দু বলল, জায়গাটার নাম বেগো বা বেগোর মোড়। গ্রামের নাম মুইদিপুর। জেলা পূর্ব বর্ধমান।

কিন্তু কোন ধারাটা দামোদর আর কোনটা মুণ্ডেশ্বরী? জলধারা দু’দিকে ভাগ হয়ে বয়ে চলেছে। পথপ্রদর্শকও আমাদের এমন প্রশ্নে একটু দোটানায় পড়ল। বিভিন্ন দিকে দেখা দামোদর-মুণ্ডেশ্বরীর বয়ে চলা স্মরণ করে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছিল। তেমন সুবিধে করতে পারল বলে মনে হয় না। আমাদের বলল, ‘‘মনে হয় এটা দামোদর আর এটা মুণ্ডেশ্বরী।’’ মনে হওয়া দিয়ে কোনও কাজ হয় না। নিশ্চিত জানানোর দাবি উঠল। বিচ্ছেদস্থলে অনেক ঘুরতে আসেন। এদিন গোধূলি বেলাতেও দু’চারজন ছিলেন। তাঁদের একজনকে জিজ্ঞাসা করল দীপ্তেন্দু। তিনি বললেন, বাঁধের দিকেরটা মুণ্ডেশ্বরী। বাঁ দিকে দামোদর। নিশ্চিত হলাম। কিন্তু মুশকিলে পড়ল দীপ্তেন্দু। ব্যাটা গাইড পারে নে বলে শুরু হল নানা মজা। বন্ধুদের কেউ বেশি জেনে জ্ঞান ফলাবে এটা মন থেকে মানা শক্ত। তবে ও রসিক। অল্প কথায় রস সঞ্চার করে। মজায় সায় দিল। দীপু আর বাবলা খুনসুটি শুরু করল। দীপ্তেন্দুকেও নানা ভাবে খোঁচাচ্ছিল বাবলা। ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে।

এই এক চিলতে সবুজ অন্য দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে। বিচ্ছেদস্থলে, বেগোর মোড়।

মেটে রঙের গালিচা হলেও জায়গাটার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। মেটে রঙ, জলের ধারা, বাঁধ, গোধূলি বেলার আকাশ সব মিলেমিশে একটা ভাল লাগা তৈরি করে। চরের মাঝে একটা খড়ের ছাউনি রয়েছে। সেটা অন্যরকম দৃশ্যকল্প তৈরি করছে। আবার নদ বা নদীর বুকে (ভাগাভাগিটা কে করে!) অল্প ফসল চাষ হয়েছে। ধূসরের মধ্যে এক চিলতে সবুজ অন্যরকম লাগছিল। এই সৌন্দর্যের জন্যই বোধহয় অনেকে ঘুরতে আসেন। অনেকটা সৈকত সৈকত ভাব জাগে। এক অল্প বয়সি দম্পতিও ঘুরতে এসেছে দেখলাম।

নদ-নদীর বিচ্ছেদস্থলে মিলনের এক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ভাল লাগল এটাও।

কভারের ছবি— দামোদর-মুণ্ডেশ্বরীর বিচ্ছেদস্থল

ছবি— দীপু, বাবলা, দীপ্তেন্দু

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *