সোয়ালুক। হুগলি।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

সোয়ালুকের রাধা-গোপীনাথ মন্দিরে

দীপক দাস

সে একদিনের কথা। যেদিন প্রসাদ আর প্রকৃতির সন্ধানে বেরিয়েছিলাম আমরা। আমাদের সফরে প্রসাদ মানে দু’টো অর্থ হয়। এক তো মন্দির সফর। দুই, সঙ্গে অবশ্যই দীপ্তেন্দু আছে। প্রসাদ প্রিয় বালক। তাতে একটা সুবিধে হয়। গ্রামে গঞ্জে ঘোরার সময়ে দুপুরের ভোজনের একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এবং ভাল রকম ভোজন।

বেরিয়ে পড়া গিয়েছিল এরকম একদিন। প্রসাদ ও প্রকৃতির সন্ধানে। যদিও আরেকটি সন্ধানও ছিল। সে কথা হবে অন্য সময়ে। দীপ্তেন্দুদের জেলা হুগলির চাঁপাডাঙার দিকটা খুব বেশি ঘোরা নেই। সেই কবে চাঁপাডাঙা পেরিয়ে জঙ্গলপাড়া গিয়েছিলাম। দামোদর পাড়ের সৌন্দর্য দেখতে। সেই সুন্দর স্থানের পাশ কাটিয়েই এবারের যাত্রা। গ্রামটা জঙ্গলপাড়ায়। যে জায়গায় দীপ্তেন্দু নিয়ে গেল সেটা কুণ্ডুপাড়া। বাঁধের পাকা রাস্তা থেকে নেমে একটু ভিতর দিকে ঢুকতে হয়।

কু্ণ্ডুপাড়ার শিবমন্দির বা চণ্ডীমন্দির। মনোযোগী দীপ্তেন্দু।

কুণ্ডুপাড়া দামোদরের তীরে। কাছেই মুণ্ডেশ্বরী নদীও রয়েছে। গ্রামে বন্যার জল ঢোকে মুণ্ডেশ্বরী থেকে। বন্যার জল, সময়ের স্রোত বাঁচিয়ে কুণ্ডুপাড়ায় একটি মন্দির বেঁচে রয়েছে। ঠিক বেঁচে না বলে মৃতপ্রায় বলাই ভাল। দীপ্তেন্দু বলল, শিবমন্দির। কিন্তু স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি জানালেন, এলাকায় এটি চণ্ডীমন্দির হিসেবে পরিচিত। মুমূর্ষু মন্দির হলেও গায়ে আভিজাত্যের ছাপ। কারুকাজ ছিল গা ভরা। পোড়মাটির কাজ। এখন বহু কাজ খুলে পড়েছে। হারিয়ে গিয়েছে। একটু খুঁজে দেখলে বেশ কিছু কাজ নজরে পড়ে। আমাদের পড়েনি। দীপ্তেন্দুর অভিজ্ঞ চোখ খুঁজে খুঁজে দেখাল, মন্দিরের গায়ে লঙ্কা যুদ্ধ, নৌকাবিলাস, বিদেশি বণিকদের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের প্রান্তে রয়েছে নকাশি কাজ। মানে অলংকারে যে কাজ থাকে।

গ্রামবাসী ভদ্রলোক আমাদের একটা তথ্য দিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য মন্দির সংক্রান্ত নয়। সেটা হল এ গ্রামের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর কথা। তিনি বগলাচরণ কুণ্ডু। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে এঁদের কাঁসা পিতলের দোকান রয়েছে। বড় ব্যবসায়ী।

কুণ্ডুপাড়া ফেলে আমাদের বাইক রওনা দিল সোয়ালুকের দিকে। পুরশুড়া থানার সোয়ালুকের গোস্বামী পাড়ায় রয়েছে গোপানীথ জিউয়ের মন্দির। বৈষ্ণব কৃষ্ণদাস ঠাকুরের শ্রীপাট। এই মন্দিরেই দুপুরে প্রসাদ গ্রহণের ইচ্ছে ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা থেমে থেমে ঘুরতে ঘুরতে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। মন্দিরও বন্ধ। প্রসাদ পাওয়া তো দূরের কথা রাধা গোপীনাথের দারুমূর্তি দর্শনও হল না। তাঁদের শয়ান করিয়ে পুরোহিত চলে গিয়েছেন। মন্দির বিকেলের আগে খুলবে না। আরেকটা বিষয় জানা গেল, আগে থেকে না জানালে প্রসাদের ব্যবস্থা হয় না।

খালি পেটে ফিরতে হবে। তা বলে খালি খাতাতেও ফিরব? একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, রাস্তার পাশেই যে বাড়িটি দেখা যাচ্ছে সেটি মন্দিরের এক সেবায়েতের। গিয়ে ডাকাডাকি করতে বেরোলেন দিলীপ গোস্বামী। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। তাঁদের পরিবারের পালা চলছে। দিলীপবাবুর কাছ থেকে আর স্মৃতিস্তম্ভের লেখায় গোপীনাথ মন্দির নিয়ে কিছু তথ্য পেলাম। স্মৃতিস্তম্ভ অনুযায়ী, নিত্যানন্দের সহচর অভিরাম গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন কৃষ্ণদাস ঠাকুর। তাঁর নামের আগে ‘বাঙ্গাল’ বিশেষণ রয়েছে। কৃষ্ণদাস আনুমানিক ৮৫০-৯০০ বঙ্গাব্দের কোনও এক সময়ে সোয়ালুকের গোস্বামী পাড়ায় ভজন কুঠি স্থাপন করেন। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাধা গোপীনাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেটি ছিল প্রথম মন্দির। দীপ্তেন্দু অবশ্য অনেকটাই জানত। কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভের সাল নিয়ে আপত্তি জানাল। ওর মতে, এ সবই ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা।

দিলীপবাবু জানালেন, কৃষ্ণদাস ঠাকুর মুণ্ডেশ্বরীর সোঁতা ধরে সোয়ালুকে পৌঁছেছিলেন। প্রথম মন্দির কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে যায়। পরে তৈরি হয় পঞ্চরত্ন মন্দির। এটি দ্বিতীয় মন্দির নামে পরিচিত ছিল। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ ছিল। কিন্তু মন্দির মেরামতের সময়ে ঠিকাদার পোড়ামাটির কাজের প্লেট খুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মন্দিরে লাগাননি। সেই সময়ে সরকার থেকে মন্দির সারানো হয়েছিল। এখন যে মন্দিরটি রয়েছে এটি তৃতীয় মন্দির।

স্মৃতিস্তম্ভ। গোস্বামী পাড়ার শ্রীপাটে।

রাধা গোপীনাথকে ঘিরে বহু উৎসব হয়। দোল, রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমী। দোল হয় প্রতিপদে। অর্থাৎ পরের দিন। কিন্তু এখানে রথ হয় না। কোনও এক সময়ে পুকুরে রথের চাকা বসে গিয়েছিল। তার পর থেকে এই উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। উৎসবের দিনগুলোতে প্রবল ভিড় হয় গোপীনাথ মন্দিরে। কৃষ্ণদাস ঠাকুর বর্ধমান মহারাজের কাছ থেকে ৫০০ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন দিলীপবাবু। তাঁদের সেবায়েত পরিবার এখন বহু শাখায় বিভক্ত। ২৫টি পরিবার সেবায়েতের দায়িত্বে। দিলীপবাবুদের বছর তিন পরে পালা আসে।

শ্রীপাটের দোলমঞ্চ।

রাধা গোপীনাথের মন্দির যখন ছাড়ছি তখন তিনটি প্রশ্ন মনে। আরেকবার আসতে হবে মন্দিরে। বৈষ্ণবদের পায়েস এবং মালপোয়া দারুণ হয়। এখানে কি ভোগে দেওয়া হয়? কৃষ্ণদাস ঠাকুরের নামের আগে কেন ‘বাঙ্গাল’ বিশেষণ? আর খানাকুলের কৃষ্ণনগরে যে গোপীনাথ জিউয়ের মন্দির সেটির সঙ্গে সোয়ালুকের মন্দিরের সম্পর্ক আছে। কী সম্পর্ক? খানাকুলের কৃষ্ণনগরে অভিরাম গোপালের শ্রীপাট। আর সোয়ালুকেও অভিরাম গোপালের পাদস্পর্শ হয়েছিল বলে স্মৃতিস্তম্ভে লেখা। এই দু’টো প্রশ্নের উত্তর দীপ্তেন্দু ভাল বলতে পারবে।

রাধা গোপীনাথের শ্রীপাট।

কভারের ছবি— রাধা গোপীনাথের মন্দির

ছবি— দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *