বাগনান। শিঙাড়া।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

খুদে শিঙাড়া মিনি মিষ্টি

দীপক দাস

হইহই শিঙাড়া। এমনই নাম ছিল। মাথায় চ্যাঙাড়ি করে বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন একজন। ছোটবেলার স্মৃতি। তখন প্রথম শ্রেণি বা দ্বিতীয় শ্রেণি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি গয়লাপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন শিঙাড়াওয়ালা। সকালে ৭টা সাড়ে ৭টার সময়ে টিউশন পড়তে যাওয়ার সময়ে দেখা হত। হন্তদন্ত হয়ে চ্যাঙাড়ি মাথায় করে চলেছেন। পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করতেন। আবার স্কুল যাওয়ার সময়ে দেখতাম তিনি খালি চ্যাঙাড়ি নিয়ে ফিরছেন।

সৃষ্টিধর হাইত নিজেই শিঙাড়ার নাম দিয়েছিলেন হইহই। কারণ হইহই করে বিক্রি হত। হবে নাই বা কেন? ছোট ছোট শিঙাড়া। খোলা সমেত সুপুরির আকারের একটু বড় ছিল। দাম ১০ পয়সা, ২০ পয়সা। একসময়ে পাঁচ পয়সা, ১০ পয়সাতেও দিতেন। ছেলেরা শিঙাড়া তৈরিতে সাহায্য করতেন। কিন্তু বিক্রি হলেও শেষের দিকে একদমই লাভ থাকত না। বলছিলেন তাঁর ছোট ছেলে ভোলা। পাতিহাল গ্রামের বাসিন্দা ভোলাবাবু বললেন, ‘‘সেই কারণেই বাবাকে শেষে আর শিঙাড়া নিয়ে বেরোতে বারণ করতাম।’’ খাটুনিটাই সার।

তপনবাবুর শিঙাড়ার লেচি বেলা চলছে।

বাগনান বাসস্ট্যান্ডে থেকে নুন্টিয়ার অটোতে বসে হইহই শিঙাড়ার কথাই মনে পড়ছিল। ফেসবুক থেকে খবর মিলেছিল নুন্টিয়ার কাছে হরিনারায়ণপুর বাজারে এখনও নাকি খুদে খুদে শিঙাড়া মেলে। দাম মাত্র দু’টাকা। একটা কাজে বাগনানে এসেছিলাম। শিঙাড়া সন্দর্শন সেরে যাওয়াই উচিত বলে মনে হল। মাগগি গন্ডার বাজারে কোন জাদুবলে এখনও শিঙাড়া এত সস্তা? লাভ রাখেন কী ভাবে?

বড় রাস্তা থেকে হরিনারায়ণপুর বাজার একটু ভিতর দিকে। অটোর সহযাত্রী কোথায় নামতে হবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে টোটো ধরতে হবে। অটোচালক জায়গা মতো নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান তখন একটা প্যাডেল ভ্যান দাঁড়িয়েছিল। অটোচালক ওতেই চলে যেতে বললেন। প্যাডেল ভ্যান খারাপ নয়। একা যাত্রী। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। জানালাম, তপন সামন্তের দোকানে যাব। প্রথমে একটু যেন থমকালেন। চেনেন না নাকি! চেনানোর জন্য আরেকটু সুতো ছাড়তে হল। বললাম, হরিনারায়ণপুর বাজারে যে দোকানে দু’টাকা দামের শিঙাড়া পাওয়া যায় সেখানে নিয়ে চলুন। এবার বুঝতে পারলেন, ‘‘ও তপনদার দোকানে!’’

কড়াইয়ে যেতে প্রস্তুত।

প্রচুর গাছগাছালিতে ভরা গ্রাম হরিনারায়ণপুর। বারবার বৃষ্টি নামছিল সেদিন। একটি স্কুলে শিক্ষক দিবস পালন হচ্ছিল। ঘোষণা হচ্ছিল অনুষ্ঠানের। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম দোকানে। একদম ছোটখাটো দোকান। এক বয়স্ক ভদ্রলোক চুপ করে বসেছিলেন। ইনিই তপন সামন্ত। জিজ্ঞাসা করলাম, ছোট শিঙাড়া পাওয়া যাবে কিনা? উনি জানালেন, ভাজতে হবে। তবে অভয়ও দিলেন বেশিক্ষণ লাগবে না। ভ্যানচালকদাদাকে ধরে রেখেছিলাম। বাগনান গিয়ে তার পর বাস ধরে আমতা থেকে ট্রেন ধরার তাড়া আছে। এরকম গ্রামের ভিতর থেকে কিছু না-ও মিলতে পারে।

তপনবাবু তেলে শিঙাড়া দিলেন আর আমার কথা শুরু হল। এলাকাটা অনেক পুরনো। আগে এর নাম ছিল অশ্বিনীবাবুর বাজার। জমিদার চৌধুরীদের কোনও এক কর্তাব্যক্তির নামে। তখন নুন্টিয়া বাজার হয়নি। অশ্বিনীবাবুর বাজারই ছিল ভরসা। বহু দূর থেকে লোকজন আসতেন। তপনবাবুর সাড়ে চার দশকের দোকান তাঁর। দোকানের বয়সের হিসেবটা রেখেছেন পুরনো পদ্ধতিতেই। বললেন, ‘‘বন্যা যত বছরের তত বছরের দোকান।’’ বন্যা মানে ১৯৭৮ সালের বন্যা। নিজেরা ময়রা নন। তবে মিষ্টির দোকানে কাজ শিখেছিলেন। বাবা শীতলার গান করতেন। তবে দাদুর বাগনান স্টেশনের সিঁড়ির কাছে দোকান ছিল। রসগোল্লা, পান্তুয়া, দানাদার, সন্দেশ তৈরি হত দোকানে। সেখানেই ১৬ বছর বয়সে কাজে ঢুকে গিয়েছিলেন। বাড়িতে অভাব। পাঁচ ভাই, দুই বোনের বিরাট সংসার।

নামছে এক ঝাঁক।

অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। তাই দামের একটা তুলনামূলক ইতিহাস জানালেন। ১৯৭৮ সালে তাঁদের দোকানে রসগোল্লার দাম ছিল চার আনা। শিঙাড়া ১৫ পয়সা। পরোটা বিক্রি করতেন ১৫০ গ্রাম এক টাকা। এখন পরোটা ১০০ গ্রাম ১২ টাকা। প্রমাণ আকারের রসগোল্লা পাঁচ টাকা। দোকান অনুযায়ী দামের তারতম্য হয়। কিন্তু তপনবাবুর দোকানে কিছু খাবারের দাম যেন থমকে আছে। এখনও তিনি শিঙাড়া বিক্রি করেন দু’টাকায়। মিষ্টি শিঙাড়া তিন টাকা। রসগোল্লার দাম তিন টাকা, পাঁচ টাকা। পান্তুয়া ল্যাংচাও মেলে তিন ও পাঁচ টাকায়। তপনবাবুর দোকানে গজা, দানাদার, দরবেশও মেলে। তবে তা বাজারের দামের মতোই পাঁচ টাকা করে।

আমাদের প্লেটে গুটলি শিঙাড়া।

কড়ায় এক ঝাঁক ভাজা হচ্ছিল। তপনবাবু আরেক ঝাঁক ছাড়ার জন্য লেচি বেলছিলেন। কথাও চলছিল। এত সস্তায় দেন কী করে শিঙাড়া, মিষ্টি? লাভ থাকে? তপনবাবু জানালেন, তাঁর দোকানের শিঙাড়া, মিষ্টি অন্য দোকানের থেকে ছোট তাই কম দামে দিতে পারেন। আর কারিগর নেই, নিজে করেন। ফলে ফলে কম উপকরণ আর কারিগর না থাকায় গড়পরতায় লাভ থেকে যায়।

কথা চলছিল। শিঙাড়া ভাজা হচ্ছিল। তার মাঝে মাঝে খদ্দেরও আসছিল। বেশ কয়েকজন শিঙাড়ার খদ্দের এলেন। ১০-১২টার কমে কিনছিলেন না কেউ। আমি আর ভ্যানচালকদাদাও শিঙাড়ার স্বাদ নিলাম। ময়দার খোল। কড়া করে ভাজা। কুড়মুড়ে খোল। ভিতরে আলুর পুর মাখা নয়। টুকরো টুকরো আলু। বাদাম আর মশলাও ছিল। শীতে মাঝে মাঝে ফুলকপি পড়ে শিঙাড়ায়। জানালেন তপনবাবু। কুড়মুড়ে খোলার জন্য অনেকটা ঘরে ভাজা নিমকির স্বাদ। এইটুকু বাদে বাঙালি শিঙাড়ার মতো। আকারে বাঙালি শিঙাড়ার থেকে বেশ কিছুটা ছোট।

মিনি রসগোল্লা।

শিঙাড়ার পরে মিনি মিষ্টি চাখা। রসগোল্লা খেলাম। তিন টাকা দামের। নরম রসগোল্লা। স্পঞ্জ নয়। ছানা ভাল। কোথা থেকে ছানা আসে? তপনবাবু জানালেন, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। বললাম, রাধামণি থেকে? সায় দিলেন তিনি। রাধামণির ছানার বিষয়ে জানা ছিল। ছোলার সন্দেশের খোঁজে পাঁশকুড়ায় গিয়েছিলাম। ওই স্টেশন থেকে প্রচুর ছানাওয়ালাকে ট্রেনে উঠতে দেখেছিলাম। তাঁরা রাধামণির বাসিন্দা। রাধামণির সন্দেশের নাম রয়েছে। ছোলার সন্দেশও ট্রেনে বিক্রি করেন রাধামণির বাসিন্দারাই।

মিনি রসগোল্লা।

ঝাল-মিষ্টির একটা দারুণ স্মৃতি নিয়ে ফিরেছিলাম হরিনারায়ণপুর বাজার থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অম্লও জুটে গেল। আমাদের বটানিবাবু মিস্টার ঘাসপুস কোথা থেকে খবর নিয়ে এসেছিলেন নিজবালিয়া বাজারে নাকি দু’টাকা দামের শিঙাড়া মেলে। শুনে তো লাফিয়ে উঠেছিলাম। আমাদের ঘরের কাছেই মেলে! আর কত দূর গিয়েছি? এই মঙ্গলবারে চলে গেলাম দীপুকে নিয়ে। দোকানে ছিলেন এক তরুণী আর এক বয়স্ক ভদ্রলোক। দু’টাকা দামের শিঙাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে এমন ভাবে হাসলেন যে অ্যাসটেরিক্স কমিকসের কথা মনে পড়ে গেল। রোমানরা গলদের হাতে প্রচুর পেটানি খায়। এক রোমান সৈন্য আক্ষেপ করে জানিয়েছিল, প্রতিবার যুদ্ধের আগে গলেরা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসে। তার পর রোমানদের কী দুর্দশা!

আমাদের হাসির সঙ্গে হূল বেঁধানো বাক্যের দুর্দশাও ছিল।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *