দীপক দাস
‘এই শ্মশানের বুকে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো শত শত মানুষের দেহের কংকাল, মাথার খুলির উপর আনন্দ নিকেতনের প্রতিষ্ঠা, সেই অসহায় মানুষগুলির স্মৃতির উদ্দেশ্যে আনন্দ নিকেতন উৎসর্গিত হল’। প্রবেশপথের তোরণের ডান পাশে লেখা কথাগুলো। নীচে একটা নাম, অমল গাঙ্গুলি। শব্দগুলো থেকে অমল গাঙ্গুলি নামে ব্যক্তিটির মন পড়ে ফেলা যায়। মানুষের কথা ভাবা এক মানুষ। এমনকি অনেক অপ্রাপ্তি নিয়ে যাঁরা এই মনুষ্য সমাজ ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন, তাঁদের কথাও তিনি ভোলেননি। তাঁদের অসহায়ত্বের সহায় হওয়া আর সম্ভব নয়। অন্তত সম্মানটুকু তো দেওয়া যেতে পারে মনুষ্য সমাজে থেকেও বঞ্চিত হওয়া মানুষগুলোকে!
সপ্তাহ কয়েক ধরে ছটপটানিটা টের পাচ্ছিলাম। মনের পাখা ডানা ঝাপটাচ্ছে। নিত্য খোঁচাচ্ছে, ‘বেরিয়ে পড় রে’। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটা জায়গা ঠিক করলাম। কিন্তু ট্রেনের অবিশ্বাস্য বিলম্ব, বৃষ্টি ইত্যাদির প্ররোচনায় সফর বাতিল করতে হল। কোথায় যাওয়া যায়? পরামর্শ চেয়েছিলাম বন্ধু তরুণ সিংহ মহাপাত্রের কাছে। ইনি কম কথার মানুষ। তিনটি শব্দ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেন, ‘আনন্দ নিকেতন কীর্তিশালা’। তাই তো! আমাদের হাওড়াতেই তো! ট্রেনে, বাসে সব পথেই যাওয়া সম্ভব। ট্রেনে হাওড়া-খড়্গপুর শাখার ঘোড়াঘাটা স্টেশনে নেমে যাওয়া যায়। কিন্তু তাতে আমার যেখানে বাড়ি সেখান থেকে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। তাই আমাদের আমতা শাখার আমতা পর্যন্ত গেলাম ট্রেনে। আমতা থেকে বাসে বাগনান। বাগনান বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোয়। অটোয় যেখানে নামিয়ে দিল সেখান থেকে অল্প হাঁটায় আনন্দ নিকেতন রাস্তার পাশেই। রাস্তা থেকে স্কুলটা চোখে পড়ে। ভিতরে ঢুকলে ধীরে ধীরে এর ব্যাপ্তিটা বোঝা যায়। আমার গন্তব্য অবশ্য কীর্তিশালা মানে সংগ্রহশালাটি। স্কুল থেকে একটুখানি দূরে।
প্রবেশপথ। সামনেই স্কুল।
সংগ্রহশালার চারপাশের পরিবেশ বেশ সুন্দর। ঘাসে ঢাকা চত্বর। মাঝে সুন্দর রাস্তা। সংগ্রহশালার হাতায় বড় বড় গাছ আছে। দফতরে ছিলেন কাঞ্চন রায় কাঞ্জিলাল। শিল্পী এবং সংগ্রহশালার কর্মী। সেদিন একাধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছিল আনন্দ নিকেতনের বিভিন্ন বিভাগে। ফলে সংগ্রহশালা ঘুরিয়ে দেখানোর কর্মীরাও সেখানে ব্যস্ত ছিলেন। কিউরেটর বন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কাঞ্চনবাবু একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেন। চুপচাপ বসে না থেকে ওঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম।
অমল গঙ্গোপাধ্যায়ের মূর্তি।
আনন্দ নিকেতন আসলে একটি বিশাল ছাতা। যার নীচে বহু প্রতিষ্ঠান। অথবা একটি বটবৃক্ষ। যার অনেক ঝুরি নেমে স্তম্ভমূলে পরিণত হয়ে মূল বৃক্ষকে সুদৃঢ় করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রপাত অমলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন অমলবাবু বাগনানের নবাসন নামে অনুন্নত গ্রামে সমাজসেবা ও গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন সঙ্গীদের নিয়ে। প্রেরণা রবীন্দ্রনাথের গ্রাম পুনর্গঠনের আদর্শ। অবহেলিত গ্রামটির বাসিন্দারাও সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। গ্রামের শ্মশান ও সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শুরু হয় আনন্দ নিকেতনের পথ চলা। কাজের শুরু একটি চিকিৎসালয় তৈরি দিয়ে। এটি বীজ। তার পর ক্রমশ বেড়েছে শাখা প্রশাখা। একই চত্বরে একে একে তৈরি হয়েছে হোমিও এবং অ্যালোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল ও ছাত্রাবাস, গ্রন্থাগার, গো ও মুরগি পালন কেন্দ্র এবং সংগ্রহশালা।
সংগ্রহশালার পরিবেশ।
কীর্তিশালার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৬২ সালের ১৪ জানুয়ারি। উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ নির্মলকুমার বসু। শুরুর দিকে এটির নাম ছিল ‘আনন্দ নিকেতন সংগ্রহশালা’। নির্মলবাবু প্রস্তাব দেন নামটি ‘আনন্দ নিকেতন কীর্তিশালা’ হওয়াই কাম্য। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, ‘অতীত দিনের সভ্যতার যে নিদর্শনই আমরা সংগ্রহ করি না কেন, সেগুলি আমাদের পূর্ব-পুরুষেরই মহান কীর্তি’। গোটা আনন্দ নিকেতনের প্রাণপুরুষ অমল গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু কীর্তিশালাটির প্রাণ বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরা। জনৈকের দেওয়া কয়েকটি প্রত্নদ্রব্য নিয়ে কীর্তিশালার পথ চলা শুরু হয়েছিল। তার পর বহুজনের দানে সমৃদ্ধ হতে থাকে। তারাপদ সাঁতরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কীর্তিশালার জন্য বহু কিছু সংগ্রহ করে আনেন।
কাঠের সেই দুর্গা।
কথার ফাঁকে একবার উঠেছিলাম। সংগ্রহশালায় ঢোকার মুখেই একটা কাঠের দুর্গা রাখা। ২০১০ সালে চোরবাগান সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রতিমা এটি। শিল্পী ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। দুর্গা সপরিবারে রয়েছেন। ছবি তুলতেই কাঞ্চনবাবু জানালেন, এখানে ছবি তোলা নিষেধ। ফিরে এসে আমার কাঞ্চনবাবুর সামনে বসলাম। কীর্তিশালার কিছু বইপত্র আছে। কাঞ্চনবাবু বেশ কিছু বই বার করে আনলেন। বেশ ভাল বই। আর দামের সস্তা। সংগ্রহশালার প্রদর্শিকার দাম মাত্র দু’টাকা। ইংরেজি সংস্করণ ২৫ টাকা। তারাপদ সাঁতরার ‘লোক-উৎসব ছড়া-প্রবাদে গ্রামবাংলার সমাজ’ পেলাম। আমার সংগ্রহ সমৃদ্ধ হল। সংগ্রহশালার টিকিট লাগে পাঁচ টাকা।
ততক্ষণে কর্মীরা চলে এসেছেন। সুকান্ত মণ্ডল, সনাতন সাঁতরা, অমিয় বেরা। আমাকে দ্বিতল সংগ্রহশালার বিভিন্ন কক্ষ দেখাতে শুরু করলেন সুকান্ত মণ্ডল। ধাতুশিল্প, বাংলার শিল্প, নৃতত্ত্ব, মধ্যযুগের বাংলার মন্দির ফলক ইত্যাদি ১১টি কক্ষে নিদর্শন ঠাসা। সংগ্রহের বহু কিছু তারাপদ সাঁতরার ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা। ভিন রাজ্যের সংগ্রহও আছে। যেমন ওড়িশার বেলেপাথরের সপ্তম শতকের ব্রহ্মা, বিহারের অভয় মুদ্রার বিষ্ণু। একটা দরজা আছে সংগ্রহে। কাঠের কী অনন্য সব কাজ তাতে। শিল্পী চোকুরাম মিস্ত্রি ১৩৪০ সালে তৈরি করেছিলেন দরজাটি। দুর্গা, কমলে কামিনী, বিশ্বকর্মা, দুই পালোয়ান, পাহারাদার আরও কত কাজ দরজার উপরে।
কয়েকটি নিদর্শন দেখে ব্যক্তিগত টান অনুভব করলাম। ২০০৭ সালে জগৎবল্লভপুর ব্লকের গোবিন্দপুরের খটির মাঠে শ্রীকান্ত দাস পুকুর কাটাতে গিয়ে একটি মূর্তি পান। সেটি ছিল কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তি। গ্রামের লোক মূর্তি পেয়ে পুজো করতে শুরু করেছিলেন। পুলিশ ৫ জুন গিয়ে মূর্তিটি উদ্ধার করে জগৎবল্লভপুর থানায় এনেছিল। এই মূর্তিটি কীর্তিশালায় দেখলাম। মূর্তি উদ্ধারের খবরটি ‘যুগের খবর’ নামে এক পাক্ষিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পুতুলের সংগ্রহে দেখলাম চাকা লাগানো নৌকা ছিল। এরকম পুতুল আমার গ্রাম পাতিহালে একসময়ে তৈরি হত। তারাপদবাবু আমাদের গ্রামে এসে সেই পুতুল দেখে এসেছিলেন। সংগৃহীত পুতুলের সংগ্রহের স্থান লেখা নেই। তবুও ভাল লাগল। বাংলার পট বিভাগে দুখুশ্যাম চিত্রকরের অনেকগুলো পট রয়েছে। মসনদলী, বন্যার বিবরণ, সাবিত্রী সত্যবান। অসাধারণ এই পটশিল্পীর নামটির সঙ্গে কাজের সূত্রে পরিচয় ছিল।
ঘোরা শেষে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছি, থমকালাম অমল গঙ্গোপাধ্যায়ের মূর্তির সামনে। আরেকবার সেই ফলকের সামনে। মনে হচ্ছিল, আনন্দ নিতেতন এক প্রতিষ্ঠান নয়। এক সম্মানস্তম্ভ। দুই কীর্তিমান সম্মান দিয়েছেন নামহীন বহুজনকে। একজন শিক্ষায়, হাতের কাজে পিছনে থাকা মানুষগুলোকে সামনে আনতে চেয়েছিলেন। আরেকজন নাম না জানা নানা শিল্পী, কারিগরকে।
তথ্যসূত্র: আনন্দ নিকেতন কীর্তিশালা প্রদর্শিকা
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)