দি চারুচন্দ্র দত্ত
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মাতৃভোগের স্বাদ সন্ধানে

দীপক দাস

রাজধানীর সঙ্গে যোগ থাকা দরকার। সে দেশের হোক বা রাজ্যের। অনেক ক্ষেত্রেই না হলে হালে পানি মেলে না। রাজধানীতে পড়তে গেলে গৌরবের। চাকরি করলে সম্মানের। ব্যবসা থাকলে সমৃদ্ধির। জেলার প্রতিভারাই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজধানীর গৌরব বাড়ান। এ যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সত্য তেমনই মিষ্টির জগতেও। ‘মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে’ বছর কয়েক ধরে ঘোরার পরে এমন কথা মনে হয়েছে। জেলার বহু বিখ্যাত মিষ্টি চেখে তো দেখা হয়েছে। কিন্তু কলকাতার নামীরা? তার সন্ধানেই কলকাতায় সপ্তাহ কয়েক ঘোরাঘুরি। রাজধানীর অলিগলিতে ঘোরার অভিজ্ঞতা বলছে, সামাজিক ক্ষেত্রের মতোই জেলার প্রতিভার জৌলুসে উজ্জ্বল রাজধানীর মিষ্টিমহলও।

খোঁজে গিয়েছিলাম মাতৃভোগের। নামটা পড়া ছিল। কিন্তু তেমন দাগ কাটেনি স্বাভাবিক কারণেই। তখন জেলার দিকে মন। তা ছাড়া মিষ্টিটির নাম যে উৎস থেকে পাওয়া সেখানে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। কিন্তু একটি সূত্র থেকে পাওয়া খবরে মনে হল, দেরি করা ঠিক হবে না। তা হলে হয়তো মাতৃভোগের আস্বাদ অধরাই থেকে যাবে। সূত্রটি ফেসবুকের এক শুভানুধ্যায়ীর। তিনি জানালেন, মাতৃভোগ করা দোকানগুলো পরপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অবশিষ্ট দোকানটিও যদি না থাকে! শুভানুধ্যায়ী ঠিকানা দিয়েছিলেন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের (লেবুতলা)। সেখান থেকে জেলে পাড়ায় গিয়ে চারুচন্দ্রের মিষ্টির দোকানের খোঁজ করতে হবে।

দোকানে খাওয়ার জন্য নিয়েছিলাম দু’টো মাতৃভোগ।

শুভানুধ্যায়ী সম্ভবত শিয়ালদহ থেকে গিয়েছিলেন। তাই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার দিয়ে যেতে বলেছিলেন। হাওড়ার দিক থেকে গেলে কলেজ স্ট্রিট ধরা বেশি সুবিধা। মেডিক্যাল কলেজ পার করে কিছুটা গেলে অক্রুর দত্ত লেন, ধীরেন ধর সরণী, ঠাকুর দাস পালিত লেনের সংযোগস্থলে দোকানটা। আমি আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে সন্তোষ মিত্র ধরায় বিস্তর পদচারণা ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে পৌঁছতে পেরেছিলাম।

দোকানের নাম ‘দি চারু চন্দ্র দত্ত’। ঠিকানা ১৮ ঠাকুর দাস পালিত লেন, কলকাতা-১২। দোকানের নামের সঙ্গে ‘দি’ শব্দটি ভাবায়। বোঝাই যায়, নিজের সময়ে মিষ্টিমহলের কেউকেটা ছিলেন চারুচন্দ্র দত্ত। বিকেলের দিকে পৌঁছেছিলাম। তখন দোকানে মালিক পক্ষের কেউ ছিলেন না। ছিলেন কর্মী রবীন্দ্রনাথ ভুঁইয়া। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে। ১২ বছর ধরে দোকানে আছেন। আর ছিলেন সুজয় মোদক। হুগলির আরামবাগে বাড়ি। কলকাতার প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে মিষ্টির দোকান ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চারুচন্দ্রে কাজ করছেন।

মাতৃভোগের আদি ভান্ডার। ঠাকুরদাস পালিতের দোকান।

অভ্যাস মতো খাওয়া দিয়ে শুরু হল। মাতৃভোগের স্বাদ নিলাম। নরম প্রকৃতির বেশ স্বাদু মিষ্টি। আকার চাকতির মতো। মিষ্টি ভাঙলে চাকতির মাঝে রঙিন একটা অংশ দেখা যায়। বোঝা যায়, রসগোল্লা বা পান্তুয়ার মতো এ মিষ্টির ভিতরে কোনও কিছুর গুটি দেওয়া। দোকানে মেলে ১২ টাকা ও ৭ টাকা দামের মাতৃভোগ। রবীন্দ্রনাথবাবু জানালেন, পুজো বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে অর্ডার দিলে ২০ বা ২৫ টাকা দামের মাতৃভোগও করে দেওয়া হয়।

মাতৃভোগকে পান্তুয়া পরিবারের মিষ্টি বলা যেতে পারে। স্বাদ ও দাম জানা গেল। এবার মাতৃভোগের উৎসের ইতিহাস। কিন্তু সেটা মালিক পক্ষের কাছ থেকে শোনাই ভাল। দোকানে বর্তমানে বসেন চারুচন্দ্রের নাতি সুবীর দত্ত। তাঁর নম্বর নেওয়া হল।

ফোন করেছিলাম চারুচন্দ্রের নাতি সুবীর দত্তকে। তাঁর কাছ থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল। চারুচন্দ্রের উত্থান আর মাতৃভোগের সৃষ্টি। চারুচন্দ্রের বাড়ি বর্ধমান জেলার আউরিয়া গ্রামে। কাটোয়া থেকে ৮-১০ কিলোমিটার ভিতরে গ্রামটি। এই গ্রাম থেকে কলকাতায় কাজের খোঁজে এসেছিলেন চারুচন্দ্র। মিষ্টির ভাল কারিগর ছিলেন। একসময় নিজেই মিষ্টির দোকান খোলেন। ভাল কারিগর হওয়ায় মিষ্টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা ছিল। সেই ভাবনাচিন্তারই ফসল মাতৃভোগ। তবে মিষ্টি তৈরির সালটি বলতে পারেননি সুবীরবাবু।

মিষ্টির সৃষ্টি দু’টো সাধারণ পথে হয়। কারিগরের খেয়াল আর ফরমায়েশি সৃষ্টি। মাতৃভোগ প্রথম পথের পথিক। বছর পঁয়ষট্টির সুবীরবাবু জানালেন, তাঁর দাদু চারুচন্দ্রের মনে হয়েছিল, নতুন ধরনের কিছু করা দরকার। তাই তিনি মাতৃভোগ তৈরি করেন।উপকরণ— ক্ষীর, ছানা, ময়দা, ঘি আর মাওয়া বাদাম। মাওয়া বাদাম মানে আমন্ড। ক্ষীর, ছানা, ময়দা ভাল করে মেশাতে হয়। মণ্ডটা গোল করে তার ভিতরে দেওয়া হয় গুটি। এই গুটি তৈরি হয় ক্ষীর আর মাওয়া বাদাম দিয়ে। মাওয়া বাদাম তেলে ভেজে নিয়ে গুঁড়ো করতে হয়। তার পর ক্ষীর আর গোলাপি খাবার রং অল্প করে দিয়ে বাদাম গুঁড়ো মেখে নেওয়া। গুটি ভিতরে দিয়ে প্রথমে গোল করে পাকানো হয় মণ্ডটি। তার পর হাতের চাপে চ্যাপ্টা চাকতির আকার দেওয়া হয়। এর পর দম আঁচে ঘিয়ে ভাজতে হয় চাকতিটি। বাদামি রং ধরলে ভাজা নামিয়ে ছল রসে ডোবানো। ছল রস মানে পাতলা রস। পাতলা রসে ডুবিয়ে রাখলে ভাজা মাতৃভোগ নরম হয়। তার পর ডোবাতে হয় মোটা রসে।

রসের সাগরে মাতৃভোগ।

মাতৃভোগ প্রসিদ্ধি দিয়েছিল চারুচন্দ্রকে। তাঁর দোকানও নানা মিষ্টির গুণমানের কারণে নাম করে। ব্যবসা জমে গিয়েছিল চারুচন্দ্রের। ঠাকুরদাস পালিতের দোকানটি আদি। এ ছাড়াও শাঁখারিটোলা এবং গোবিন্দ সরকার লেনে আরেকটি দোকান ছিল। তিনটি দোকানেই ঠাকুরদাস পালিতের কারখানা থেকেই মিষ্টি যেত। শেষের দু’টি দোকান করোনা অতিমারির সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। আদি দোকানটি বহাল তবিয়ত। চারুচন্দ্র আউরিয়ায় সম্মানিত ছিলেন। গ্রামে তাঁর নামে স্কুল হয়েছে। স্কুলের নাম আউরিয়া চারুচন্দ্র দত্ত বিদ্যানিকেতন। ২০১৯ সালে স্কুলটি সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছে।

যেদিন দোকানে গিয়েছিলাম সেদিন স্থানীয় এক ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়েছিল। প্রবীণ ক্রেতা জানিয়েছিলেন, তাঁরা ছোটবেলা থেকে মাতৃভোগ খেয়ে আসছেন। খুব নাম। পুরনো যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁরা এলাকায় ফিরলে মাতৃভোগের খোঁজ করেন। নিয়েও যান বাইরে। তাঁদের সূত্রেই মাতৃভোগ সারা ভারতে গিয়েছে। এ দোকানে আবার খাবো সন্দেশও ভাল। ভাল নোনতা খাবারও। বিকেলে কচুরি আর ছোলার ডাল মেলে। খেয়ে দেখেছিলাম। স্বাদ ভাল। সকালে মেলে আলু ভাজি আর কচুরি। দোকানে যতক্ষণ ছিলাম, বেশ কয়েকজনকে কচুরি খেতে দেখেছি। মাতৃভোগও।

পুঁটিরামেও নাকি মাতৃভোগ পাওয়া যায়! যে উৎস থেকে প্রথম মাতৃভোগের নাম জেনেছিলাম সেখানে এমন উল্লেখ ছিল। গিয়েছিলাম কলেজ স্কোয়ারের কাছে সূর্য সেন স্ট্রিটের দোকানে। মাতৃভোগ করেন না বলে জানিয়েছিলেন এক কর্মী।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *