মুর্শিদাবাদের মোমো
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

শীতের সিক্ত সন্ধ্যায় পাহাড়ি মোমোর খোঁজে

ফারুক আব্দুল্লাহ

৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালের বিকেল। মুর্শিদাবাদে সবে একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। এর মাঝেই নিম্নচাপ মিগজাউমের প্রভাবে আকাশ মুখভার করে আছে। মাঝে মাঝেই দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরছে। সব মিলিয়ে শীতের সূচনা লগ্নে মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। সেদিন সারাদিনের ক্লাস নেওয়ার পর বেশ কয়েকজন টিচার্স রুমে আড্ডা জমিয়েছিলাম। পাহাড় থেকে আসা নতুন শিক্ষিকা বসুন্ধরার সঙ্গে পাহাড়ের জীবন যাপন নিয়ে নানান কথা হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক দীপকদা আলোচনায় যোগ দিলে নতুন মাত্রা যুক্ত হল।

দীপকদা এক মজার মানুষ। সাহিত্যের লোকেদের রসবোধ খুব প্রখর হয়। দীপকদা এই কথার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দাদা যে কোনও সাধারণ বিষয়কে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। দাদার সঙ্গে তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া যায় কোনও রকম বিরক্তি ছাড়াই। দীপকদার আরও একটি গুণ, তিনি অসম্ভব রকম খাদ্য রসিক।

ক্রিম মোমো।

সেদিন বিকেলে টিচার্স রুমে বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে মনোরম কথোপকথন চলছিল। বাইরে তখন সবার অজান্তে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নানান কথা প্রসঙ্গে দীপকদা একবার বসন্ধুরাকে মোমোর কথা জিজ্ঞাসা করে বসেন। বসুন্ধরার উত্তরের অপেক্ষা না করে দাদা নিজেই বলে ওঠেন, মুর্শিদাবাদ শহরের পিলখানা মসজিদের পিছন দিকে নাকি এক খাঁটি পাহাড়ি মোমোর দোকান রয়েছে। আমরা ইচ্ছে করলেই একবার টেস্ট করে দেখতে পারি। আমাদের হতাশ করবে না। দাদা আলোচনার মধ্যেই আমাকে বলেন “ভাই চল, আজকে কলেজ থেকে বেরিয়েই মোমো খেতে যাবো। একবার ওদের তৈরি মোমো খেলে তোর আর অন্য মোমো খেতে ইচ্ছে করবে না।’’ দাদা আরও জানালেন তিনি বেশ কয়েক বছর থেকে নিয়মিত যান সে দোকানে। মুর্শিদাবাদ জেলায় একমাত্র সেই দোকানেই নাকি আসল স্বাদের পাহাড়ি মোমো পাওয়া যায়।

দীপকদার সঙ্গে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪টে বেজে গিয়েছে। টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি চলছে। আমাদের কারও কাছেই ছাতা ছিল না। দাদা তাই কলেজের ভিতর থেকে একটি পুরনো ছাতা জোগাড় করে এনে স্কুটিতে বসে আমাকে ধরিয়ে দিল। কলেজে থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। দোকানে ঢুকতেই দেখি, এক বয়স্ক দোকানদার দাদাকে বিনয়ের সঙ্গে অ্যাপায়ন করে দোকানে বসালেন। দাদা মোমোর অর্ডার দিলে তিনি হাসি মুখে নরম গলায় বললেন, “একটু সময় লাগবে স্যার, আশা করি এখন আপনাদের কোনও তাড়া থাকবে না।’’

এর মধ্যেই সন্ধ্যা নেমেছে। শীতের মরসুম, নিম্নচাপের বৃষ্টিতে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। হঠাৎ দেখি বাইরের রাস্তার ধারে দোকানের নাম লেখা একটি বক্সে আলো জ্বলে উঠল। বক্সে স্পষ্ট দোকানের নাম লেখা আছে, ‘মামাজ মোমো’। তবে এটাকে ঠিক দোকান বললে বোধহয় ভুল হবে। রাজ্য সড়কের ধারে নিজ বাসভবনের সামনের ছোট্ট গাড়ি বারান্দার মাথায় ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দোকানটি। কয়েকটি প্লাস্টিকের টেবিল ও টুল রাখা আছে। বাড়ির ভেতরে একটি ছোট্ট ঘরে মোমো তৈরি করা হচ্ছে।

আচারি মোমো।

মোমো আসতে দেরি হবে। কবিতার বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা, জীবনানন্দ দাশ নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হয়। বৃষ্টির জোরও বেড়েছে। এমন মনোরম পরিবেশে গুলাম আলি বা জগজিৎ সিংয়ের গজলের অভাব খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। এর মধ্যেই টেবিলের সামনে মোমোর প্লেট হাজির। দীপকদা শুধুমাত্র খেতেই ভালবাসে না, খাওয়াটাও যে একধরনের শিল্প সে কথা বোঝা যায় দাদার সঙ্গে খেতে বসলে। দোকানে একটি বিশেষ মোমো পাওয়া যায়। এক প্লেটে ছয় ধরনের মোমো দু’টো করে থাকে। যেন মোমোর থালি। আমি যেহেতু প্রথম তাই দোকানের জনপ্রিয় মোমোর স্বাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই দাদা এই বিশেষ প্লেটের অর্ডার করেছিল। মোমো চোখে পড়তেই মন ভাল হয়ে গেল। আমি মোমোর ভক্ত নই। তবে খেতে মন্দ লাগে না। দাদা বললেন, “কোনটা থেকে শুরু করবি বল?” সত্যিই বলতে এই বিষয়ে কোনও ধারণা ছিল না। দাদাকেই বলি, ‘‘তুমি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষ তুমিই শুরু করো।’’ দাদা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন “তাহলে স্টিম মোমো দিয়ে শুরু করা যাক।” তার পর একে একে তন্দুরি মোমো, কোঠে মোমো, চিজ মোমো, ডিপ ফ্রায়েড মোমো, সবার শেষে ক্রাঞ্চি মোমো দিয়ে শেষ করলাম।

হরিয়ালি ও আফগানি মোমো। সঙ্গে আচারি আর তন্দুরিও রয়েছে।

মোমোগুলো খাওয়ার পর মনে হল, এত ভাল স্বাদ ও মানের মোমো আমি ইতিপূর্বে কোথাও খাইনি। প্রতিটা মোমো এক কথায় অসাধারণ। আমাদের সব ক’টা চিকেন মোমো ছিল। এখানকার সবথেকে ভাল ব্যাপার হল, মোমো তৈরিতে কোনও বাড়াবাড়ি নেই। মশলার আধিক্যও নেই। আবার খেতেও খুব সুস্বাদু।

প্লেট শেষ করতেই দাদা বললেন “বল, এবার কোনটা খাবি?’’ আসলে দাদা কম্বো প্লেট অর্ডার করেছিল আমাকে মোমোর স্বাদ যাচাই করাতে। দাদার কথায় দ্বিধায় পড়ে যাই। কারণ সব মোমোই খুব ভাল লেগেছিল। আলাদা করে বলার উপাই ছিল না। দাদাই ঠিক করে দিলেন, কোঠে মোমো। এবার অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম গরম কোঠে মোমো চলে এল। সঙ্গে ছিল ঠান্ডা পানীয়। কোঠে মোমো খেয়ে এবার শুধু মন নয় পেটও ভরে গেল। দাদা আবার বলে উঠল, “বল, এবার আর কী খাবি?” সত্যিই বলতে তখন পেটে আর কোনও জায়গা ছিল না।

তন্দুরি মোমো।

এমন ভাল পাহাড়ি মোমো খেয়ে মোমোওয়ালাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। তাছাড়া বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই সুযোগে খেজুরে আলাপ জমাতে দোকানের কাউন্টারে বসে থাকা সেই ভদ্রলোকের কাছে গেলাম।তিনি জানালেন তাঁর নাম সন্তোষকুমার ঠাকুরি। তিনি অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ জওয়ান। ভদ্রলোক আদতে দার্জিলিংয়ের মানুষ। দীর্ঘদিন সপরিবারে তাঁরা মুর্শিদাবাদেই বসবাস করছেন। তাঁর শ্বশুরমশাইও বিএসএফে চাকরি করতেন। তাঁর শেষ পোস্টিং ছিল মুর্শিদাবাদে। অবসরের পর মুর্শিদাবাদে বিএসএফ ক্যাম্পের কাছে শ্বশুরমশাই বাড়ি কিনে চিরস্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। সন্তোষবাবুও শ্বশুরবাড়িতেই সপরিবারে বসবাস শুরু করেন।

নবাবি খানা আর বিরিয়ানির দেশে মোমোর ব্যবসা শুরু করলেন কেন? সন্তোষবাবু হেসে জানালেন, তাঁদের দার্জিলিঙে মোমো খুব জনপ্রিয় খাবার। ভদ্রলোকের বড় ছেলের বিয়ের দিন দার্জিলিংয়ের আত্মীয় স্বজনদের কথা ভেবে মোমোর স্টল দেওয়ার কথা ভাবা হয়। বহরমপুরের এক মোমো বিক্রেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই মোমোওয়ালার মোমো নাকি একেবারেই খেতে ভাল হয়নি। বরং তাঁদের বাড়িতে তৈরি মোমোই নাকি খেতে বেশি সুস্বাদু হয়। তাই তিনি একদিন ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন, বাড়িতেই মোমোর দোকান খুলবেন। তাঁর ছোট ছেলে পেশায় শিক্ষক। তিনিও এই বিষয়ে আগ্রহী হন। ভদ্রলোকের ছোট বৌমা বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়েই পড়াশোনা করেছেন। তিনিও শ্বশুরমশাইকে উৎসাহ দেন। সন্তোষবাবু ছোট পুত্র ও বৌমার সহযোগিতায় মোমোর দোকান শুরু করেন কয়েক বছর আগে।

সন্তোষকুমার ঠাকুরি

ভদ্রলোককে প্রশ্ন করেছিলাম, জেলায় এখন অজস্র মোমোর দোকান। মোমোপ্রেমীরা আপনার দোকানে কেন আসবে? সন্তোষ ঠাকুরি জানিয়েছিলেন, কারণ তিনি যে মানের, যে ভ্যারাইটির এবং যে স্বাদের মোমো খাওয়াতে পারবেন তা সমগ্র জেলায় এখন পর্যন্ত আর কেউই খাওয়াতে পারবেন না। তিনি আরও জানান, তাঁর দোকানে দার্জিলিং থেকে মোমো তৈরির দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরদের নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁরাই দোকানের সমস্ত ধরনের মোমো তৈরি করে থাকে। সন্তোষবাবু জানান, তাঁর দোকানে চিকেনের স্টিম মোমো, কোঠে মোমো, ডিপ ফ্রায়েড মোমো, ক্রাঞ্চি মোমো, ট্যাংগি ফ্রায়েড মোমো, স্পাইসি কোঠে মোমো, চিলি মোমো, হট গার্লিক মোমো, তন্দুরি মোমো, পিৎজা মোমো, ক্রিম মোমো, চটপটে মোমো, তাইপো মোমো, থুপকা মোমো ইত্যাদি পাওয়া যায়। চিকেনের পাশাপাশি ভেজ মোমোও রয়েছে। যেমন আফগানি মোমো, হারিয়ালি মোমো, আচারি মোমো প্রভৃতি।

মোমো বিক্রেতা অবসরপ্রাপ্ত জওয়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু বাইরে তখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টি একটু কমলে বেরিয়ে পড়লাম। দাদা আমাকে পিলখানা মোড়ে নামিয়ে দিয়ে ছাতা মাথায় এগিয়ে চললেন বাড়ির পথে। বৃষ্টি ভেজা অন্ধকার রাস্তা তখন জনশূন্য। দূরের একটি দোকান থেকে গান ভেসে আসছে… ‘রুখে রুখে সে কদম রুক কে বার বার চলে,/ করার লে কে তেরে দার সে,/বেকারার চলে’।

ছবি লেখক

কভারের ছবি— মোমোর থালি

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *