দীপক দাস
একদিন হঠাৎই ইন্দ্রর ঘোরায় পেয়ে বসল। ঘরে বসে থাকবে না সে। যেখানে হোক বেরোতেই হবে। এদিকে অন্যদের কারও পাত্তা নেই। তাই আমাকেই ধরেছে, আজ মঙ্গলবার। ঘরে থাকার দিন নয়। কিন্তু চটজলদি কোথায় বেরোব? ভাবতে একটু সময় দিতে হবে তো! ঠিক করা হল, আমতার দাদখালি দয়ের পাশের বাঁধ ধরে যত দূর যাওয়া যায় যাব। তার পর খুঁজে নেব কোনও গন্তব্য।
বাইক বাঁধের কাছে কিছুটা এগনোর পরে জিজ্ঞাসাবাদ। আর তাতেই ধরা পড়ল আমাদের ঘরের কাছের জায়গা না চেনার বুরবকামি। এই বাঁধের রাস্তা নাকি গিয়ে পেঁড়োয় গিয়ে মিশছে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের এই পাণ্ডুয়ায় আমরা হরবখত যাতায়াত করি। ঘুরেফিরে আবার পেঁড়ো যাব!
পোড়ামাটির কাজে ভরা মন্দির গাত্র।
মনে পড়ল একবার ঝিখিরায় রাউতাড়া গ্রামে গিয়েছিলাম। অনেকগুলো মন্দির সে গ্রামে। সুন্দর এবং কারুকাজে খচিত। কিন্তু সেদিন রাউতাড়ার কাছের আরেক গ্রামে যাওয়া হয়নি। সে গ্রামেও পুরনো মন্দির আছে। গ্রামের নাম অমরাগড়ি। বাইক বাঁক নিল অমরাগড়ির দিকে। গাছগাছালি খাল, জলাশয়ে ভরা গ্রামটি বেশ সুন্দর। কিন্তু মন্দিরগুলো অবস্থান ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একজন জিজ্ঞাসাও করলাম। তিনি সামনের একটা দিক দেখিয়ে জানালেন, এটাই এখানকার সবচেয়ে পুরনো মন্দির। যেদিকটা দেখালেন সেদিকটা সাদা রঙের একটা চকচকে মঞ্চ দেখা যাচ্ছে। তার সামনে একটা মন্দির আছে বটে। কিন্তু বড্ড আধুনিক ধাঁচের। আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। একদম মাঠের মাঝে। পথ ভুল করেছি। জিজ্ঞাসা করে আবার পিছিয়ে আসা। সেই সঙ্গে জেনে নিয়েছিলাম মন্দিরের অবস্থানটাও।
নানা অলংকরণ।
রাস্তা থেকে একটু ভিতর দিকে মন্দিরটা। প্রচুর কারুকাজ মন্দিরের গায়ে। পোড়ামাটির কত রকমের যে ফলক! কোনও ফলকে রামায়ণ কাহিনি। লঙ্কাযুদ্ধ, কুম্ভকর্ণ খেয়ে নিচ্ছে রাম সেনাকে, দশমাথা রাবণ যুদ্ধ করছে। কোথাও সেতুবন্ধন। আবার রয়েছে শিকার দৃশ্য। হাতে বন্দুক রয়েছে। একটা ফলকে এক অশ্বারোহী বিদেশিদের মতো টুপি পরে। একটা রথের দৃশ্য আছে। তাতেও টুপি পরা আরোহী। এক রথে মহিলাও রয়েছে। দুর্গার মূর্তিও রয়েছে ফলকে। মহিষাসুরকে বধ করছেন। আরও কত রকম দৃশ্যের ফলক। একটা ফলক দেখে আশ্চর্য হলাম। পোড়ামাটির মিথুন দৃশ্যের ফলক। হাওড়ার কোনও মন্দিরে আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
এই প্যানেলে রয়েছে বিদেশি রথারুঢ়, শিকার এবং মিথুন দৃশ্য।
আমরা মন্দির দেখছি। একজন এলেন সাইকেলে করে। তাঁর নাম সুনীল রায়। তাঁদের বংশেরই মন্দির। তিনি বললেন, দধিমাধবের মন্দির। গ্রামের লোকেরা দামোদরজিউ বলছিলেন। বিগ্রহ শালগ্রামশিলা। নিত্যপুজো হয়। এছাড়া দোলের সময় মন্দিরে উৎসব হয়। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নরোত্তম রায়ের নাম বলছিলেন সুনীলবাবু। নরোত্তম রায় তাঁর ৮-১০ ঊর্ধ্বতন পুরুষ। নরোত্তমের আদিবাড়ি মুর্শিদাবাদের সোমরাজপুরে। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। জলপথে বাণিজ্য করতে এই এলাকায় এসে পৌঁছন। বর্ধমান মহারাজের থেকে গ্রামের জমিদারি পরের পুরুষ। তাঁর নাম বলতে পারলেন না সুনীলবাবু।
গজলক্ষ্মীর পুরনো মন্দির। বাঁ পাশে নতুন মন্দির।
সুনীলবাবুর কথা মতো, জমিদারি পাওয়ার আগেই মন্দির তৈরি হয়েছিল। মন্দিরের গায়ে প্রতিষ্ঠা সাল লেখা, ‘শুভমস্তু শকাব্দা ১৬৮৬’। অর্থাৎ ইংরেজি ১৭৬৪ সাল। মন্দিরের গায়ে প্রহরীর মূর্তি আছে। বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে। রাজ্য সরকারও সংস্কার করেছে। নীল রঙের সরকারি বোর্ডও আছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নামে।
এই বংশেরই আরেকটি মন্দির রয়েছে। কয়েক হাত দূরেই। সেটি গজলক্ষ্মীর মন্দির। রায় বংশের আরেক কর্তা অমরেন্দ্র রায়ের বংশধরদের মন্দির এটি। এক সময় হয়তো এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে যাওয়া যেত। এখন মূল রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। গজলক্ষ্মীর পুরনো মন্দিরটি জীর্ণ। পরিত্যক্তও। মন্দিরের একদিকটায় লম্বা ফাটল। পতন উন্মুখ। পোড়ামাটির কাজ ছিল মন্দিরের গায়ে। উপরের অংশের ফুল, মন্দিরের ছবিগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু নীচের দিকের কাজগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি। অনেক পোড়ামাটির প্যানেল হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নয়তো খুলে নেওয়া হয়েছে। তারাপদ সাঁতরা জানাচ্ছেন, এই মন্দিরেও মিথুন দৃশ্য ছিল। কিন্তু ‘সেগুলি ইচ্ছা করেই নষ্ট করা হয়েছে’। ইন্দ্র আক্ষেপ করছিল, কী সম্পদ ছিল। সব নষ্ট হয়ে গেল।
জীর্ণ মন্দিরে ক্ষয়াটে পোড়ামাটির কাজ।
মন্দিরের সামনে ফোন করছিলেন একটি ছেলে। পরিচয় করলাম। অল্প বয়সি ছেলেটির নাম সায়ন রায়। তিনি জানালেন, গজলক্ষ্মীর বিগ্রহ পাশের নতুন মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মন্দিরের চাবি খুলে আমাদের দেখালেনও। গজলক্ষ্মী মূর্তিটি চতুর্ভুজা। উপরের দু’হাতে কিছু একটা ধরা। নীচের ডান হাত খালি। বাম হাতটি কাপড়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। গজলক্ষ্মী ডান পায়ের উপরে বাম বা তুলে বসে রয়েছেন। এই দেবীর বিষয়ে আগে কিছু জানতাম না। এখনও তেমন কিছু জানি না। তারাপদ সাঁতরা মূর্তির বিষয়ে কিছু লেখেননি। শুধু জানিয়েছেন, মন্দির থেকে ‘বিগ্রহ বর্তমানে স্থানান্তরিত’।
গজলক্ষ্মী মন্দিরটি ১৬৫১ শকাব্দে তৈরি হয়েছিল। ইংরেজি ১৭২৯ সালে। কে তৈরি করেছিলেন সেটা সায়ন বলতে পারলেন না। গজলক্ষ্মী নিয়ে ইন্টারনেট ঘাঁটলাম একটু। জানা গেল, ইনি সমৃদ্ধির দেবী। সমুদ্র মন্থনে উঠেছিলেন। ইন্দ্রের হারানো সম্পদ ফেরত দিয়েছিলেন। ইলোরার গুহাচিত্রে গজলক্ষ্মীর মূর্তি রয়েছে। ওড়িশার বিভিন্ন মন্দিরেও রয়েছে। তবে ইন্টারনেটে পাওয়া মূর্তির সঙ্গে অমরাগড়ির মূর্তির খুব একটা মিল পেলাম না। হাতে ধরা বস্তুগুলো যদি পদ্ম হয় তাহলে একটা মিল রয়েছে যদিও। তিনি পদ্মের উপরে বসে রয়েছেন কিনা বুঝতে পারিনি কাপড় ঢাকা থাকায়। তবে গজ মানে হাতি দেখতে পেলাম না।
গজলক্ষ্মীর মূর্তি। (নীচে)
সায়ন জানালেন, মূর্তিটি বহু আগে নাকি চুরি হয়েছিল। তার পর এই মূর্তিটি বানিয়ে নেওয়া হয়। কত আগে সেটা বলতে পারলেন না। দেখা হয়েছিল চিন্ময়ী রায়ের সঙ্গে। যিনি সম্পর্কে সায়নের ঠাকুমা। উনি জানালেন, তাঁর বিয়ে হয়েছে ৫০ বছর। তারও আগে মূর্তিটি চুরি হয়েছিল সম্ভবত। ঠিকঠাক জানেন না বিষয়টা। এখন নতুন মন্দিরের সামনে একটা স্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়েছে। তাতে গজলক্ষ্মী মন্দিরের বয়স ৩০০ বছর লেখা রয়েছে। যদিও শকাব্দের হিসেবে বছর ছয়েক কম পড়ছে ৩০০ থেকে।
অমরাগড়ির এই দু’টো মন্দির হাওড়ার প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর অন্যতম। তারাপদ সাঁতরা দধিমাধব মন্দিরের অনন্য এক শিরোপা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘শুধু সামনের দেওয়ালে নিবদ্ধ পোড়ামাটি-সজ্জার উৎকর্ষে এটি যে হাওড়া জেলার শ্রেষ্ঠ মন্দির তাতে সন্দেহ নেই’। মন্দিরের গায়ের শিকার দৃশ্যগুলো নিয়ে তাঁর মত, ‘শিকারদৃশ্যগুলি পশ্চিমবঙ্গের এ শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ পোড়ামাটি-সজ্জার সঙ্গে তুলনীয়’।
কভারের ছবি— দধিমাধবের মন্দির
ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)