গোসাবা
ইতিহাস ছুঁয়ে জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

বেকন বাংলোয় একবেলা

ইন্দ্রজিৎ সাউ

একেই বুঝি বলে রথ দেখা আর কলা বেচা। আমরা এখন এই ভরদুপুরে আছি গোসাবায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বেকন সাহেবের বাংলোতে। তো যা বলছিলাম। বেশ কিছুদিন ধরে সুন্দরবন ঘোরার প্রস্তুতি চলছে, তবে প্ল্যান বা প্রোগ্রাম যাই বলুন সেটা আমার নয়। সবটাই করেছে সুব্রত। ওকে নিয়মিত একটা হাসপাতালে ডায়লিসিস করাতে হয়। সেখানকার ডায়লিসিস ইউনিটের বেশ কিছু নার্স দিদি আর টেকনিশিয়ান সুন্দরবন যেতে চান। কিন্তু লোকজন কম পড়েছে। তাই সুব্রত আমাকে ধরেছে। আমিও দলভারী করতে জুড়ে গিয়েছি হাসপাতালের দলের সঙ্গে। তার আগে বন্দোবস্ত করার দরকার।

আর আমরা গোসাবায় এসেছি অশোকের সঙ্গে দেখা করে পুরো ব্যাপারটা পাকাপোক্ত করতে। ইন্টারনেটে চরম যুগে আমরা চাইলেই সবকিছু অনলাইন করতে পারতাম। কিন্তু ঘোরার এমন সুযোগ দু’জনের কেউ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। ২০১৬ সালে শেষ আমরা এখানে এসেছিলাম।

গোসাবার খেয়াঘাট।

পরিকল্পনা মতো, সকাল ৭.২০ মিনিটের আমতা লোকাল ধরে চলে গেলাম সাঁতরাগাছি। ওখান থেকে এক্সাইড মোড় বাসে। তার পর ঠিক ছিল মেট্রো করে নিউ গড়িয়া যাওয়ার। কিন্তু দিনটা যেহেতু রবিবার, মেট্রো চলে দেরিতে। অগত্যা আমরা ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম বালিগঞ্জ স্টেশনে। সবে ওভারব্রিজে উঠেছি হুড়মুড়িয়ে ৯.১৮ ক্যানিং লোকাল ঢুকে পড়ল। আমরা দু’জনে দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে শেষের আগের বগিতে উঠলাম। রবিবার হলে কী হবে বেশ ভিড়। কয়েকটা স্টেশন যাওয়ার পর হাফসিট মানে চার নম্বরে বসতে পেলাম।

সাড়ে দশটায় ক্যানিং। নেমেই প্রথমে খেয়ে নিলাম। না খেলে আমার মাথা কাজ করে না। তার পর ম্যাজিক গাড়ি ধরলাম গদখালির উদ্দ্যেশে। তবে এখন বাসও চলে। আমরা প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাব বলেই ম্যাজিক গাড়ি ধরা। এর আগে যখন এসে ছিলাম তখনও দেখেছিলাম দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ। রাস্তা আগেও ভাল ছিল। এখন আরও ভাল হয়েছে। ২৯ কিমি রাস্তা পৌঁছে গেলাম মাত্র ৫৫ মিনিটে। এতই ফাঁকা আর ভাল রাস্তা।

বেকন বাংলো চত্বর।

গদখালি নেমে চলে এলাম নদী ঘাটে ফেরি ধরার জন্য। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই একটা নৌকা ঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা দু’জনে উঠেও পড়লাম। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ পর ছাড়বে? মাঝি জানতে চাইল আমরা কোন ঘাটে নামব? আমরা গোসাবা বলায় দূরে আসা একটি নৌকা দেখিয়ে বলল, আপনারা ওটায় যান। ওটা সোজা গোসাবা যাবে। এটা দু’তিনটে ঘাট হয়ে তার পর গোসাবা যাবে। বেশ মজার ব্যাপার। নৌকাতেও ট্রেনের মতো ভায়া হয়ে গন্তব্যে পৌঁছনো।

গোসাবায় আগে থেকেই অশোক অপেক্ষা করছিল। আমরা গোসাবায় বাজারের মধ্যে একটি মন্দিরের সামনে বসার চাতালে গিয়ে বসলাম। দিনক্ষণ তো আগেই ঠিক ছিল। বাকি বিষয় ঠিক করে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর চললাম আমাদের দ্বিতীয় যে উদ্দেশ্য আসা অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বেকন বাংলো দেখতে। এই বাংলোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’দিন রাত্রি যাপন করেছিলেন। মাঝে নাকি বাংলোর দুর্দশা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটাও জীর্ণ হয়ে যায়। এখন সব আবার ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের মূর্তি।

বেকন বাংলোর একটা ইতিহাস আছে। নাম বেকন হলেও এটা তৈরি করেছিলেন ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন নামে এক সাহেব। ইনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। ১৯০৩ সালে হ্যামিল্টন গোসাবায় আসেন। এসেছিলেন নাকি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে। সম্রাট অশোকের আদর্শে প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে জল-জঙ্গলের ‘দেশ’ গোসাবা, রাঙাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া দ্বীপ ইজারা নিয়ে বাসিন্দাদের উন্নততি কাজ শুরু করেন। তিনি সমবায়ও গড়ে তোলেন। তৈরি করেন রাইস মিল। ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ১৯০৬ সালে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেন। তাই তাঁর নামের আগে ‘স্যার’। প্রজাদের আর্থিক মানোন্নয়নে হ্যামিল্টন এই অঞ্চলে এক টাকার কাগজের নোটও প্রচলন করেছিলেন।

যেন স্থানীয় মানুষের প্রতিনিধি।

পরিবারের লোকজন আর অতিথিদের জন্য গোসাবায় দু’টি বাসস্থান তৈরি করান তিনি। একটি বেকন বাংলো নামে পরিচিত। অন্যটি হ্যামিলটন বাংলো। হ্যামিল্টনের আমন্ত্রণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসেছিলেন। আসার সময়, ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। রবীন্দ্রনাথ সমবায় আন্দোলন দেখতেই এসেছিলেন। হ্যামিল্টন বাংলোর নামের উৎস বোঝা গেল। কিন্তু বেকন বাংলো কেন? জানতে পারলাম না। আমরা অবশ্য হ্যামিল্টন বাংলোয় যাইনি।

এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় আমরা বাস ধরেছি। সুন্দরবন এসেছি আর বাঘের গল্প শুনব না এটা হয় না। বাসে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের বাঘের গল্প শোনালেন। শহর থেকে এক মাসিমা বাঘ দেখতে এসেছেন। লঞ্চে ওঠা ইস্তক মাসিমা তাঁর বোনপোকে বলে চলেছেন, ‘‘বাবু বাঘ দেখাতে পারবি তো?’’ ‘‘কই তোর বাঘ?’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সবে লঞ্চ খাঁড়িতে ঢুকেছে জঙ্গলে খুব কাছেই এক বাঘ বাবাজি হালুম করে ডাক ছেড়েছে। আর এদিকে মাসিমা দাঁত কপাটি এবং লঞ্চের মেঝেয় দড়াম। বাঘ না দেখেও যে মানুষ অজ্ঞান হতে পারে এ অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমার প্রথম সুন্দরবন সফরে দেখেছি।

বাংলোর চত্বরে আলাপচারিতায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথ ও হ্যামিল্টন। তৈরি করা হয়েছে এমন আবহ।

ক্যানিংয়ে নেমে আমরা প্রথমে গেলাম মাছের বাজারে। সুব্রত ওখান থেকে প্রায় দু’কেজি সাইজের একটা পদ্মার ইলিশ নিল। ট্রেনে করে চলে এলাম গড়িয়া। এখান থেকে আমরা মেট্রো ধরব। টিকিট কেটে সুব্রতকে বললাম চল দেখি। কিন্তু বাবু নড়ে না। কী হল রে? সুব্রত যা বলল তাতে তো আমিও ঘাবড়ে গেলাম। মাছ মাংস হাতে নিয়ে নাকি ওঠা যায় না মেট্রোয়। গেটে দাঁড়ানো রেল পুলিশ ওকে বলেছে। তখন সুব্রতর মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। আমি গিয়ে কথা বললাম, ‘‘স্যার বাড়ির জন্য ইলিশ নিয়ে যাচ্ছি। কী করব বলুন তো?’’ আমাদের অবস্থা দেখে উনিই উপায় বাতলে দিলেন। বললেন, ‘‘আপনি ক্যামেরার ব্যাগের আড়ালে মাছের ব্যাগটা নিয়ে নিন।

হাঁফ ছেড়ে দু’জনেই একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মেট্রো ধরলাম।

কভারের ছবি— বেকন বাংলো

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *