ইলোরা সফর
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

এলাপুরমের আখ্যান

ড: শ্রাবনী চ্যাটার্জী

সেই কোন কালিদাসের কালে সহ্যদ্রির এক সুপ্ত গিরিকন্দরে মানবস্পর্শ পড়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চতুর্মাস যাপনের জন্য শত শত হস্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে রচিত হয়েছিল বিহার–চৈত্য শ্রেণী। তার পর এলেন এক বহুবিজয়ী রাজা, রাষ্ট্রকুট কুল-তিলক। তাঁর মহিষীর পণ, আরাধ্যর জন্য রচনা করতে হবে তাঁর আবাসস্থল, এক ভব্য মন্দির। তৈরি হল মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম অনুপম এক কীর্তি। একটি পাহাড় কেটে জন্ম নিল এক কাব্য। ত্রিগুণাতীত মহেশ্বরের মহত্তম আবাস কৈলাস। তার পর দেড় হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কালের অজস্র ক্ষতে আজ ক্ষত-বিক্ষত মহাকালের মন্দির। তবুও যা অবশিষ্ট আছে তা বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দর্শককে। আজকের ইলোরা শোনায় প্রাচীন সেই এলাপুরমের আখ্যান।

বৌদ্ধ গুহা শ্রেণি।

ইলোরা দর্শনের জন্য বেশি কাঠখড় পোড়াতে আমাকে হয়নি। আমার পতিদেব মেঘদূতের যক্ষের মতো মুম্বইয়ে নির্বাসিত। কাজেই বিরহ অপনোদনের সুযোগে এদিক সেদিক ঘোরাও হয়ে যায়। রাতের ট্রেনে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস মানে এখনকার ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে রওনা দিলাম ঔরঙ্গাবাদ। সেই শহরেরও আবার আজকাল নাম পাল্টে হচ্ছে শম্ভুজি রাজে নগর। সেখানে খুব ভোরে নেমে স্টেট ব্যঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গেস্টহাউসে একটু বিশ্রাম নিয়ে চললাম ইলোরার উদ্দেশ্যে।

ডাইনিং হল বা ৫ নম্বর গুহা।

যে রাস্তা দিয়ে ইলোরায় পৌঁছাতে হয় সেটা দেবগিরি বা দৌলতাবাদ দুর্গের পাশ দিয়েই গেছে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গাড়ি যেখানে নামাল সেখান থেকে কৈলাস সোজাসুজিই দেখা যায়। টিকিট কাউন্টারও সামনেই। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লেই প্রায় ২.৫-৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পাহাড়ের গায়ে ৩৪টি গুহার শ্রেণী বাঁ দিক থেকে ডান দিকে বিস্তৃত। প্রথম পর্যায়ের ১ থেকে ১২ নম্বর গুহা বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং এগুলোই সর্বপ্রাচীন। বাদামির চালুক্য বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতকে তৈরি এই গুহাগুলির মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় গুহা ১০ নম্বরটি। যেটি ‘বিশ্বকর্মা’ বা ‘কার্পেন্টার্স কেভ’ নামে পরিচিত। এটি একটি মহাযান পর্বের চৈত্য।

২০ টাকার নোটের ছবির সেই ধ্বজাস্তম্ভ।

গাইড ৫ নম্বর গুহাকে ‘ডাইনিং হল’ নামে চিনিয়ে দিলেন। তবে আমার মনে হল, এই জায়গাটা শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসেবেও হয়তো ব্যবহার হত। বিশ্বকর্মা গুহার বাইরে থেকে প্রথম যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল, এর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য করা গবাক্ষটি। মনে হয় পাথর নয়, কাঠ দিয়েই বুঝি চৈত্যটি বানানো হয়েছিল। ভিতরে ২৮টি থামযুক্ত বিরাট হলের মধ্যে ধর্মচক্র প্রবর্তন মুদ্রায় তথাগতের মূর্তি। কর্কট সংক্রান্তি ও মকর সংক্রান্তির দিন ওই গবাক্ষ দিয়ে সূর্যরশ্মি তথাগতের মুখের উপর অদ্ভুত মোহময়তা সৃষ্টি করে।

বিশ্বকর্মা গুহায় তথাগত।

এর পরবর্তী ১৩ থেকে ২৯ নম্বর গুহাগুলি ব্রাহ্মণ্য অর্থাৎ হিন্দুধর্মের। এগুলো খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম অব্দে মূলত রাষ্ট্রকূটদের রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল। জগৎ বিখ্যাত কৈলাস মন্দিরটি এই গুহারাজিতেই ১৬ নম্বরে। তার আগের ১৪ ও ১৫ নম্বর গুহা দু’টিও ‘রাবণ কি খাই’ ও দশাবতার নামে বেশ বিখ্যাত। তবে কৈলাসের মহিমা শুধু এ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ‘মনোলিথিক টেম্পল’ বলে নয়, এর অদ্ভুত নিখুঁত ভাস্কর্য দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এ মানুষের হাতে তৈরি। রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদুর্গের আদেশে তৈরি এই মন্দির দ্রাবিড় শিল্পকলার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। ৭০০০ শিল্পী প্রায় ২০০০ টন পাথর কেটে রূপ দিয়েছিলেন এই পাথরের মহাকাব্যকে। এর দেয়ালে দেয়ালে রামায়ণ, মহাভারত এবং শিব-পার্বতীর বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির বিন্যাস চোখে পড়বে। আর একটু নজর করলে এই মন্দিরের দ্বিতলে ম্যুরাল পেন্টিংও দেখতে পাবেন। যা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেননি।

ত্রিতল বৌদ্ধবিহার বা ১২ নম্বর গুহা।

তবে সর্বত্রই দেখলাম পর্যটকদের বেজায় ভিড়। বিশেষত ধ্বজাস্তম্ভটির সামনে। লোকজন পকেট থেকে ২০ টাকার নোট বার করছে আর সামনে ধরে পটাপট ছবি তুলছে। আমাদের গাইড ভদ্রলোক কথায় কথায় বললেন, “সত্যজিৎ বাবুকে কাহানি পর জো ফিলিম হুয়া থা না উসকে শুটিংকে বাদ সে বাংগালি লোগ জ্যাদা আনে লাগে হ্যায় য়াহা পর। ফির তো ইধার জি-২০ কে লোগ ভি আয়ে থে। তো ভিড় অউর বর গয়ি।“ মনে মনে রায়বাবুর জয়গান করে কৈলাসের পাশের গুহামন্দিরগুলো আর ‘সীতা কি নাহানি’ ঝরনা দেখে এবার ব্যাটারি কারের জন্য লাইন দিলাম।

উপর থেকে কৈলাসের ধ্বজাস্তম্ভ মণ্ডপ ও গর্ভগৃহ।

এর পরবর্তী পর্যায়ের জৈন গুহাগুলোয় যেতে গেলে ব্যাটারি গাড়ি ভরসা। নইলে ওই বিকট রোদে হেঁটে যেতে হলে নির্ঘাত মাথা ঘুরে চোখে চার-ছ’খানা সরষে ফুল দেখতে পাওয়া যাবে। ৩০ থেকে ৩৪ নম্বর জৈন গুহাগুলোও রাষ্ট্রকূটদের দাক্ষিণ্যে তৈরি। তবে সময়টা আরও পরের। এই গুহাগুলোর মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয় হল ৩২ নম্বরটি। যা ‘ইন্দ্রসভা’ নামে খ্যাত। যদি স্থাপত্য-ভাস্কর্যে কেউ কৈলাসের ধারে কাছে হয় তবে সে এই গুহামন্দিরটি। মন্দিরে জৈন তীর্থঙ্করদের পাশাপাশি মাতঙ্গ ও সিদ্ধয়িকার মূর্তিও দেখলাম। শুনলাম, এর এই সব আশ্চর্য সুন্দর কারুকাজের জন্য নাকি একে ‘মিনি কৈলাস’ বলে। নামের সার্থকতা আছে।

জম্ভলা ও হারিতি।

‘ব্যাটারি কার’ আবার যখন আমাদের ফিরিয়ে এনে গেটের সামনে দাঁড়াল তখন কৈলাসের চূড়ায় শেষ বেলার রোদ খেলা করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেই শোভনশোভা দেখলাম। যেমন আমার মতো অজস্র দর্শনার্থী রোজ দেখেন। তার পর পিছন ফিরে হাঁটা দিলাম গ্রীষ্ণেশ্বর মন্দিরের দিকে। যদিও দেবদর্শনের পূর্ণতা আমি পেয়ে গিয়েছি।

যা সুন্দর তাই তো শিব। আর যা দেখলাম তার থেকে সুন্দর আর কী হতে পারে?

ছবি— লেখিকা

কভারের ছবি— কৈলাস, গুহা নম্বর ১৬

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “এলাপুরমের আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *