ঝাড়গ্রাম
জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

ডুলুং পাড়ের পবিত্র অরণ্যে

দীপক দাস

টোটোয় চারজন যাত্রী। আমাদের ছোটবেলার মতো হাফ টিকিট ধরলে যাত্রী মাত্র সাড়ে তিনজন। টোটো বিবেক মোড় পেরিয়ে, একলব্য স্কুল ফেলে এগিয়ে চলেছে। জঙ্গল ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে পুরসভা এলাকা। আমরা জঙ্গল আর গাছপালা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। দলের খুদে সদস্যটা তালগাছ, খেজুর দেখেই খুশি। জানান দিচ্ছে, একটা তালগাছ, দু’টো খেজুর গাছ। দলেরই হাফ টিকিট ওই খুদেই। মাথা গুনতির সাড়ে। না, ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র কোনও সদস্য এই সফরে নেই।

জঙ্গলের মধ্যে বন দফতরের কেটে রাখা গাছ।

মনটা ক’দিন ঝাড়গ্রাম ঝাড়গ্রাম করছিল। প্রকৃতির টান নয়, ভাইপোর আহ্বান। বছর তিনেকের খুদেটাকে মায়ের কাজের কারণে ঝাড়গ্রামে থাকতে হয়। রোজ মোবাইলের ভিডিয়ো কলে দেখা পাওয়া। কিছুদিন আগে বলছিল, ‘‘জেঠু আমাদের বাড়ি আসবে।’’ সেই ডাক এড়ানো যায়নি। মাকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম ঝাড়গ্রাম। খুদের বাবা আর দাদুকে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব দিয়ে। মানে আমার ভাই আর বাবাকে। দু’দিনের ঝটিকা সফরের একদিন মা, ভ্রাতৃবধূ আর ভাইপোকে নিয়ে চিল্কিগড়ের দিকে যাত্রা। ঝাড়গ্রামে অনেকবার এসেছি। দল বেঁধে চলে গিয়েছি জেলার শেষ প্রান্তের দিকে। শহরের আশপাশ দেখা হয়নি। এবার সুযোগ হল। পুরনো ঝাড়গ্রাম থেকে চিল্কিগড় ১৪-১৫ কিলোমিটার।

ডুলুংয়ের পাড়ে।

ঝাড়গ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। যেতে যেতেই চারিপাশটা বেশ সুন্দর লাগে। আমরা চাষ জমি, জঙ্গল অল্প বসত পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। জমির বেশির ভাগই ফাঁকা। ধান উঠে গিয়েছে। ন্যাড়া মাঠ। কিছু দূর যাওয়ার পরে মাঠ ভরা সবুজ চোখে পড়ল। মাঠের পর মাঠ জুড়ে করলা আর উচ্ছে চাষ হয়েছে। এক সঙ্গে এত চাষ কোথাও দেখিনি। টোটোচালক দাদা বললেন, এখানকার করলা ভিন রাজ্যে চালান যায়। কয়েক জায়গায় করোলা বস্তা আর কাগজের প্যাকেট বন্দি হতে দেখেছিলাম।

নদীর স্পর্শ পেতে জলে।

এক সময়ে পার হলাম জামবনির কেন্দুয়া গ্রাম। এই গ্রামে একটি গাছে বহু শামুকখোল পাখি নির্ভয়ে বাস করে। বন দফতর বোর্ড এক জায়গায় বোর্ড লাগিয়ে সে কথা পথচারীকে জানান দিয়েছে। বোর্ডে লেখা, পরিয়ায়ী পাখিদের স্বর্গ কেন্দুয়া গ্রাম। এই গ্রামে একটি পরিবার পাখিদের রক্ষা করে। এ নিয়ে খবরও হয়েছিল। এক জায়গায় দেখলাম, বন দফতর কাঠ কেটে জমা করে রেখেছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বন দফতর কাঠ কাটে। বিক্রির লভ্যাংশ পান ওই এলাকার গ্রামের বাসিন্দারাও। চিল্কিগড়ের কাছাকাছি এলাকায় রাস্তা থেকে দূরে অদ্ভুত ধরনের বাঁশগাছ চোখে পড়ছিল। কেমন যেন ধূসর রং। মা আর ভ্রাতৃবধূ অনিতাও অবাক হচ্ছিল বাঁশগাছের এমন রঙের। হয়তো নতুন ধরনের কোনও বাঁশগাছ। টোটোচালক দাদার সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্তে এলাম। তখন কে জানত আমরা একটা বিরল দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। পরে সহকর্মী রঞ্জন পালের থেকে জানতে পারব, বাঁশগাছগুলোয় ফুল এসেছে। আফশোস করে গেল, কেন যে কাছ থেকে দেখে এলাম না।

এই ঢালু রাস্তাও গিয়েছে ডুলুংয়ের পাড়ে।

কনকদুর্গা মন্দির এসে গেল। প্রবেশপথটি বেশ সুন্দর। মন্দিরে যাওয়ার জঙ্গলে ঢোকার আগে ডান দিকের চত্বরে গাড়ি রাখার জায়গা। দোকানপাটে বেশ জমজমাট। আমরা জঙ্গল পথে ঢুকে গেলাম। জায়গায় জায়গায় হাতি, ডাইনোসর তৈরি করে দর্শক বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশ সাজানো এলাকা। জঙ্গল এলাকাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে মাঝে চলার পথ। বেশ কিছু দর্শক সমাগম হয়েছে। আমরা মন্দির চত্বরে পৌঁছে গেলাম। সেখানে আবার ভয়ের কারণ। মন্দিরের সামনে প্রচুর হনুমান। ভক্তদের ফলমূল, চালের প্রত্যাশী। হনুমানদের কেউ কেউ অতি সাহসী। একজন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল আমাদের দিকে। মা, ভ্রাতৃবধূ তো ভয়ে কাটা। হনুমানটা মায়ের কাপড় ধরে ফেলেছিল। তা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা হল। মায়েরা দেবী দর্শন করতে গেল। আমি চারপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম।

মন্দির চত্বর।

কনকদুর্গা মন্দিরের ইতিহাস বেশ পুরনো। তিনশো বছরের বেশি পুরনো মন্দির। জামবনির রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ স্বপ্নাদেশ পেয়ে কনকদুর্গা মন্দির তৈরি করেন বলে কথিত। পরে গোপীনাথের দৌহিত্র কমলাকান্ত ধবলদেব চিল্কিগড়ের রাজা হন। তাঁর বংশধরেরাই মন্দিরের সেবায়েত। চিল্কিগড় রাজ পরিবারের কুলদেবী কনকদুর্গা। দেবী মূর্তি ঘোড়ায় চড়া চার হাতের। প্রাচীন সোনার মূর্তি চুরি গিয়েছে। এখন রয়েছে অষ্টধাতুর মূর্তি।

সেই লোহার সাঁকো।

তবে মন্দিরের ইতিহাস থেকে আমার ভাল লাগে কনকদুর্গা মন্দিরের চারপাশের জঙ্গলের ইতিহাস। এই জঙ্গল ‘সেক্রেড গ্রুভস’ বা পবিত্র অরণ্য হিসেবে পরিচিত। পবিত্র অরণ্যের ধারণাটি ভারতে প্রচলিত ছিল। গ্রামবাসীরা কিছু অরণ্যভূমিকে নিজেরা বেঁচে থাকার তাগিদে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছেন বহু বছর ধরে। সে জন্য কিছু অরণ্যকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়। এই জঙ্গলের গাছ কাটা বা কোনও ক্ষতি মানুষ ভয়ে করত না। তাতে দেবতা রুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রাচীন যুগের বুদ্ধিমানেরা বুঝেছিলেন, অরণ্য বাঁচলে তাঁরা বাঁচবেন। পবিত্র অরণ্যের বিষয়টি প্রথম জনসমক্ষে আনেন ভারতের বন বিভাগের প্রথম জেনারেল ডিরেক্টর ডিয়েট্রিচ ব্র্যান্ডিস। তিনি একক ভাবে ভারতের পবিত্র অরণ্য নিয়ে সমীক্ষা করেন। ১৯০৬ সালে তাঁর বই বেরোয়, ‘ইন্ডিয়ান ট্রিজ’। ডিয়েট্রিচের চেষ্টায় ভারতের বন আইনের সূত্রপাত হয়। তিনি কেরল, কর্নাটক, খাসি পাহাড় ও রাজস্থানের পবিত্র অরণ্যগুলো চিহ্নিত করেন।

নৌকা উঠে পড়েছে ডাঙায়।

কনকদুর্গা মন্দির লাগোয়া জঙ্গল শুধু পবিত্র অরণ্য নয়, জীববৈচিত্রে ভরপুর। এখানে এমন অনেক গাছপালা বা প্রাণী রয়েছে যেগুলো যেগুলো অন্য জায়গায় বিরল। এই কারণেই কনকদুর্গা সংলগ্ন অরণ্যকে জীববৈচিত্র ঐতিহ্য ক্ষেত্র (বায়োডাইভারসিটি হেরিটেজ় সাইট) ঘোষণা করা হয়েছে। দেখলাম, বহু গাছের গায়ে নাম লেখা বোর্ড। অনেক নামই প্রথম শোনা।

ডুলুংয়ের কজ়ওয়ে। বেশ সুন্দর।

দেবী দর্শন করে ফিরে এসেছিল মা, ভ্রাতৃবধূ। হনুমান দেখে ভাইপো আর কোথায় বসতে চাইছে না। ওকে কোলে নিয়ে ডুলুং নদীর দিকে চলে গেলাম আমরা। মন্দিরের কাছেই নদী। এখন শুকনো প্রায়। কিন্তু বর্ষায় বেশ তেজ দেখায়। অল্প জলের নদীতে নেমে গেল ওরা তিনজনে। চারটে বাচ্চা এসেও নদীতে নামল। ভাল লাগছিল ওদের। নদীর বুক থেকে উঠে এসে আমরা চলে গেলাম জঙ্গলের দিকে। একটা লোহার সাঁকো। সেটা পেরোতে ভয় পাচ্ছিল অনিতা। ভাইপো কিন্তু অকুতোভয়। সে অনায়াসে মায়ের হাত ধরে হেঁটে পার হয়ে গেল। সাঁকোর পরে ঘন জঙ্গল। জায়গাটা আরও নির্জন। মা আর অনিতা যেতে চাইল না। আমি কিছুটা এগোলাম। কিন্তু ভাইপো কাঁদতে শুরু করল। আমাকে যেতে দেবে না। ওদিকে সাপ আছে। জেঠুকে খেয়ে ফেলবে।

চিল্কিগড় রাজবাড়ির পাশে মন্দির আর কোনও নির্মাণ।

ডুলুংয়ে একসময়ে বোটিং চালু হয়েছিল। এখন বোধহয় বন্ধ। বোট দেখলাম ডাঙায়। ফিরে এলাম পার্কিংয়ের জায়গায়। কিছু খাওয়াদাওয়া হল সকলে মিলে। তার পর গেলাম চিল্কিগড় রাজবাড়ির দিকে। ডুলুংয়ের উপরে কজ়ওয়ে দিয়ে এগোলাম। কনকদুর্গা মন্দির থেকে একটুখানি। শহরে মল্লদেবদের রাজপ্রাসাদ এখন ঝাড়গ্রামের পরিচয়বাহী হয়ে উঠেছে। চিল্কিগড়ের রাজপ্রাসাদও বিশাল। তবে সংস্কারের অভাবে মল্লদেবদের প্রাসাদের মতো চকচকে নয়। ধবলদেবদের এই প্রাসাদও অনেকখানি এলাকা জুড়ে। সামনে বিশাল চত্বর। রয়েছে মন্দিরও।

চিল্কিগড় রাজবাড়ি চত্বর।

দেখেশুনে, ছবি তুলে ফেরার পালা। রাজপ্রাসাদ ছাড়িয়ে এসে এক জায়গায় রাস্তা সারাই হচ্ছিল। ভাইপো মহারাজ রোড রোলার দেখে উত্তেজিত। ও অবশ্য এগুলোকে জেসিবি বলে চেনে। জেসিবি দেখেটেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। আমরা টোটোচালকদাদার সঙ্গে পরিবেশ, মানুষ নিয়ে কথা বলতে বলতে ফিরতে লাগলাম ঝাড়গ্রামের দিকে।

তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

কভারের ছবি— জঙ্গল থেকে কনকদুর্গা মন্দির চত্বর

ছবি— লেখক ও অনিতা দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *