পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল
জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

শিলাবতী সঙ্গমে চার বাইক আরোহী

দীপক দাস

ফিরে যাব! মিষ্টি পেয়ে এবং খেয়েই ফিরে যাব? মেনে নিতে পারছিল না দলের কেউই। যদিও বাঙালির শেষ পাতেই মিষ্টি পড়ে। মিষ্টি সমাপ্তি। কিন্তু এখনও অনেকটা সময় আছে। এলাকাটা একটু ঘুরে দেখা যেতেই পারে। সিদ্ধান্ত হতেই বাইকের চাকা ঘুরল আবার।

কাছাকাছি এলাকায় বন্দর নামে একটা জায়গা আছে। ঠিক হল, আমাদের বন্দরের কাল হবে শুরু। যেখানে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম সেই জায়গাটিও একসময়ে বন্দর ছিল। দোকানের ঠিকানা ফলকে পরিষ্কার লেখা, রাজহাটি বন্দর। কাছাকাছি দু’টো বন্দর! বেশ অবাক লাগল। এটা কি তবে স্থল বন্দর ছিল নাকি! এত ইতিহাস আমরা জানি না। রাজহাটি ছাড়ার আগে এখানকার প্রাচীন কোনও মন্দির আছে কিনা খোঁজ নিয়েছিলাম দোকানদারদের থেকে। তাঁরা জানালেন বাজারেই একটা আছে।

বন্দর এলাকার হুগলির দিকে ঘাট ধান্যঘরি।

কিন্তু মন্দিরের কাছে গিয়ে বড়ই কষ্ট হল। মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু একেবারে ময়ূরকণ্ঠী সংস্কার। বহুবিচিত্র রংয়ের পোঁচ মন্দিরের গায়ে। আর তাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার কাজ। রঙের ধাঁধা কাটিয়ে দেখতে পারলে দৃশ্যমান হয় রামায়ণ কাহিনির পোড়ামাটির কাজ। যুদ্ধ চলছে রাক্ষস আর বানর সেনার। কিছু পোড়ামাটির প্যানেল একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সঙ্গী দীপু আর বাবলা এমন সংস্কারের প্রচেষ্টায় ধাক্কা খেল। মন্দিরটি কাঁচা আনাজের বাজারের মধ্যে। ফলে বেশ নোংরা এলাকাটা। মন্দিরের চারপাশে বাড়িঘর, হাটচালা তৈরি হওয়ায় এলাকাটা বেশ ঘিঞ্জি।

রাজহাটি ছাড়ার পরে প্রশ্ন হল, এবার কী? বেলা দুপুরের দিকে গড়িয়েছে। ইন্দ্র স্পষ্ট করে দিল, খাওয়াদাওয়া। কারণ এই এলাকা ছাড়লে বাইক কোন পথে গিয়ে পড়বে বোঝা যাচ্ছে না। সারাদিন খাওয়া না-ও জুটতে পারে। ইন্দ্র সে ঝুঁকি নিতে নারাজ। তা ছাড়া ও একটা বিরিয়ানির দোকান দেখে ফেলেছে। সুতরাং আর পরিত্রাণ নেই। ইন্দ্রর সঙ্গে বেরোলে এই মুশকিল। স্থানীয় কিছু চাখার সুযোগ মিলবে না। কলকাতায় গেলে বিরিয়ানি, হাওড়ায় বিরিয়ানি, হুগলিতেও তাই।…

ঘাটের চিরকালীন দৃশ্য।

রাজহাটি বাজার এলাকা ছাড়িয়ে কিছুটা যেতে মেঠো পথ। বন্দর জিজ্ঞাসা করতে করতে এগনো হচ্ছিল। অবশেষে মিলল জায়গাটা। বন্দর বলে পরিচিত হলেও এলাকার নাম ধান্যঘরি। একটা নদীঘাট রয়েছে। সরু বাজার এলাকা, একটা স্কুল পেরিয়ে আমরা ঘাটে পৌঁছলাম। তার আগে অবশ্য ঘাটের জন্য টোল দিতে হল। কারণ আমরা নৌকায় চাপব বলে ঠিক করেছিলাম। এই এলাকাটা দুই জেলার সংযোগস্থল। হুগলির দিকের এলাকা ধান্যঘরি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের দিকের এলাকার নাম হরিশপুর। শিলাবতী নদী দুই জেলাকে জুড়েছে।

নদীর ঘাটটি বেশ সুন্দর। ঘাটের কাছেই একটা বটগাছ। তার গোড়া বাঁধানো। গাছে কত পাখি। দীপু ছবি তুলল। ইন্দ্র আমাদের ছবি তুলে দিল। ততক্ষণে নৌকা এসে ঘাটে লেগেছে। এখানে শিলাবতী খুব বেশি বড় নয়। নদী পার হতে বেশিক্ষণ লাগে না। দীপু আর বাবলার সঙ্গে আমরা নৌকায় উঠলাম। ইন্দ্র উঠতে রাজি হল না। ও হয়তো বাইকগুলো পাহারা দেবে বলে রয়ে গেল। নৌকায় চাপতে বেশ মজাই লাগে। তবে আমাদের নৌকা সওয়ারির অভিজ্ঞতা দীর্ঘ নয়। বেশির ভাগই খালের মতো চেহারার নদীতে এপার ওপার করা হয়েছে। শুধু জঙ্গিপুরে অনেকক্ষণ ধরে ভুটভুটি নৌকায় চেপেছিলাম। নদী বেশ চওড়া ছিল।

পশ্চিম মেদিনীপুরের দিক থেকে হুগলির দিকে।

হরিশপুর ঘাটটা বেশ উঁচু। অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ। আমরা পাকা রাস্তায় উঠে উদ্দেশ্যহীন ভাবে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। দু’জায়গার অটো ছাড়ছে। একটা ঘাটাল। আরেকটা কোথায় যেন। এখন আর মনে নেই। ‘‘অটোয় করে চলে যাবি নাকি কোথাও?’’ প্রস্তাবে রাজি হল না দীপু। ওর ইচ্ছে, শিলাবতীর সঙ্গে আরও দু’টো নদী যেখানে মিশেছে সেখানে যাবে। এমন জায়গার কথা ওপারের ঘাটে বটগাছের নীচে বসা লোকটি বললেন। তখন থেকেই দীপু শিলাবতী শিলাবতী করে খেপে উঠেছে। প্রস্তাবটা মনে ধরল। তা ছাড়া ইন্দ্র ওপারে রয়ে গিয়েছে। একটু দেরি হলেই ফোন করে করে অস্থির করে দেবে।

টুঙির ঘাটের বাঁশের সাঁকো।

ধান্যঘরির ঘাটে ফিরে যাত্রা শুরু হল শিলাবতীর সঙ্গমস্থলের দিকে। অনেকবার বাইক থামানো, বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা জায়গার নাম পাওয়া গেল। টুনির ঘাট। এ কেমন নাম? পরে অবশ্য সহকর্মী ঘাটালের বাসিন্দা অভিজিৎদাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারব, আসলে টুঙির ঘাট। কোনও একসময়ে এখানে হয়তো মাচার উপরে ছোট্ট ঘর বা টুঙি ছিল। সে ঘর হয়তো ঘাটোয়ালদের। অথবা কোনও জলটুঙি ছিল। সে ইতিহাস জানতে পারিনি। তবে ঘাট হলেও এখানে কোনও নৌকা চলছে না। একটা বাঁশের সাঁকো রয়েছে। তা দিয়ে লোকে হেঁটে পারাপার করছে।

সোজা দিকে ঝুমি। নৌকার দিকে দ্বারকেশ্বর।

টুঙির ঘাট জায়গাটা বেশ সুন্দর। প্রচুর গাছগাছালি, বাঁশঝাড়। অন্যরকম লাগছিল। একটা দোকানে কয়েকজন বসেছিলেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করা হল, এটাই কি শিলাবতীর সঙ্গমস্থল? তাঁরা জানালেন, টুঙির ঘাটে শিলাবতী নয়, ঝুমি নদী আর দ্বারকেশ্বর নদের সঙ্গমস্থল। ঝুমি ঘাটালের স্থানীয় নদী। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে নাম আছে। দ্বারকেশ্বর, শিলাবতীরও রয়েছে। কারণ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ‘কবিকঙ্কণ’ মুকুন্দ চক্রবর্তী যে এই এলাকাতেই বসবাস করতেন। তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে দেবী ভবানীর আদেশে কলিঙ্গ রাজ্য ভাসাতে নদ-নদীরা হুল্লোড় তুলেছিল। কবিকঙ্কণের ‘নদনদীগণের কলিঙ্গদেশ যাত্রা’ অংশে রয়েছে, ‘আমোদর দামোদর ধাইলা দারুকেশ্বর/শিলাই চন্দ্রভাগা’। আর আছে, ‘করিয়া দামাদামি ধাইলা ঝুমঝুমি’। দারুকেশ্বর হল দ্বারকেশ্বর। শিলাই শিলাবতী। আর ঝুমঝুমির স্থানীয় নাম ঝুমি।

দ্বারকেশ্বরের পাড় সুন্দর।

আমরা নদীর চর দিয়ে নেমে আরেকটা বাঁশের সাঁকো দিয়ে ওপারে চলে গেলাম। দেখলাম, দু’টো খালের মতো ধারা এসে মিলিত হয়েছে দু’দিক থেকে। ঝুমির দিকে একটা নৌকা বাঁধা। হয়তো বর্ষাকালে অন্যান্য জায়গার মতো বাঁশের সাঁকো খুলে নেওয়া হয়। নৌকা চলাচল করে। শেষ বিকেলের আলোয় প্রায় স্রোতহীন দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে বড়ই বিমর্ষ লাগছিল।

কিন্তু নদ-নদীর দুই পাড় আলো ঝলমলে। প্রচুর চাষবাস হয়েছে। দ্বারকেশ্বরের পাড়ে সরষে খেত। উজ্জ্বল হলুদ আভায় পাড়ের বিমর্ষতা কেটেছে। আসলে এই এলাকায় প্রতি বছরই বর্ষায় জল ওঠে। ফলে জমি বেশ উর্বর থাকে। আমরা দীর্ঘক্ষণ পাড়ে কাটিয়েছিলাম। প্রচুর ছবি তোলা হল। ক্যামেরা দেখে লোকজন জিজ্ঞাসা করছিলেন, সেতু হবে নাকি এখানে? এ প্রশ্ন আমাদের অনেক জায়গায় শুনতে হয়েছে। সে সব নদ-নদীর এলাকা। এঁদের সাঁকোময় জীবন। তাই বাইরের কেউ এলে পাকাপোক্ত ব্যবস্থার আশ্বাস খোঁজেন।

এবার ফেরার পালা। কিন্তু দীপুর তো ইচ্ছে পূরণ হয়নি। সে তিন নদীর মোহনা দেখবেই। আমরা ওকে খেপাচ্ছিলাম, গাছপালার খোঁজ রাখা ঘাসপুসের ডক্টর তুমি। হঠাৎ ভূগোল নিয়ে মেতেছ কেন? দোকানে বসে থাকা লোকগুলো জানালেন, ফেরার পথেই পড়বে ত্রিমোহিনী। ওখানেই তিনটে নদী মিলেছে।

এটাই ত্রিমোহিনী। শিলাবতীর সঙ্গমস্থল।

আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু। অবশেষে মিলল ত্রিমোহিনী। রাস্তার কাছেই। কিন্তু বেশ উঁচু পাড় দিয়ে নীচে নামতে হবে। নামার জায়গায় গাছের শিকড়ের জটলা। পা ফস্কে পতনের সম্ভাবনা। ধীরে ধীরে নামলাম তিনজনে। ইন্দ্র নামবে কী নামবে না, ভাবছিল। আমরা মার্শাল আর্টের বেল্টের দোহাই দিতে ধীরে ধীরে নেমে এল।

ঝুমি-দ্বারকেশ্বর আর শিলাবতীর মিলনস্থল ত্রিমোহিনী। নামেই সেটা বোঝা যায়। এখানেও নদীর স্রোত প্রায় নেই। মোহনার একদিকে চড়াও পড়েছে। বড় বড় গাছপালা সেই চড়ায়। শিলাবতী একসময়ে ঘাটালের বাণিজ্য পথ ছিল। এই নদী দিয়ে স্টিমারে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। দ্বারকেশ্বরও ছিল স্রোতবান। কিন্তু সময়ের স্রোতে সবই রুদ্ধ হয়। ‘অমর কে কোথা কবে?’

ত্রিমোহিনীর প্রকৃতি সুন্দর। কিছুক্ষণ কাটানোর পরে কে যেন দীপুকে বলল, ‘‘এবার খুশ? বাড়ি ফেরা যাক তাহলে?’’

কভারের ছবি— ঝুমি-দ্বারকেশ্বর সঙ্গমস্থলে

ছবি— দীপু, ইন্দ্র, বাবলা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *