দীপক দাস
‘‘কাঁচা বাদাম সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।’’ কথাটা শুনে ধাক্কা লাগল। ইন্দ্র বললে মানা যেত। ছেলে খাই-খাই করে বটে। কিন্তু সহ্যশক্তি কম। প্রমাণ পেয়েছি ভাল মতোই। কিন্তু এখন বলছে কে! আমাদের ছোটা ডন। মানে বাবলা। ও তখনও মাঝে মাঝে মাঠে যেত। ক্লাবের হয়ে ফুটবলও খেলত। বয়সও কম। বাদামের চাটনি হজম করতে পারবে না!
বাদামের চাটনির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। তুলিনে গিয়ে। এরকম হয় মানুষের জীবনে। হঠাৎই ‘তিল তুলসি দিয়ে’ নিজেকে সমর্পণ। আমি তো মানুষ!
ঘটনা তুলিনের। গত পুজোয়। তিন মক্কেল বেরিয়ে পড়েছিলাম দুর্গাপুজোর দিনে আমাদের বাৎসরিক ঐতিহ্যবাহী সফরে। তুলিন বাজারে গোস্বামীবাবুর গেস্ট হাউস লীলা নিবাসের অতিথি। এ নিবাস শুধু বাসের। আশের ব্যবস্থা পাশের হোটেলে। দু’দিনের জন্য আসা। সময় নষ্ট করা যাবে না। খাবার অর্ডার দিয়ে এক পাক ঘুরে এসেছিলাম আমি। একটা অটো জোগাড় হয়েছিল। আশপাশটা ঘুরে দেখব। তার আগে খেয়ে নিতে হবে। বাবলা প্রস্তাব দিয়েছিল, সারা রাত ট্রেনের ধকল। ভাল ঘুম হয়নি। এখন ভাত খেলে শরীর এলিয়ে পড়বে। ঘুরতে ভাল লাগবে না। রুটি খেয়ে নেওয়া যাক। ভাল প্রস্তাব। সায় দিলাম আমরা।
রুটির সঙ্গী হয়ে আসা বাদামের সেই চাটনি।
রুটি এল। সঙ্গে সুন্দর স্বাদের ফুলকপি আলুভাজা, মিক্সড ভেজ পনির আর ফুলকপির তরকারি। দিল স্যালাডও। তাতে জলজিরা আর বিট নুন ছড়ানো। আর ছিল বাদামের চাটনি। দারুণ খেতে। স্বাদে মুগ্ধ হয়ে হোটেল মালিকের থেকে জেনে নিয়েছিলাম চাটনি তৈরির পদ্ধতি। কাঁচা বাদাম আর মুগ ডাল বেটে চাটনিটা তৈরি হয়। দিনে রাতে যতবার খেয়েছি ততবারই বাদামের চাটনি দিয়েছিল। প্রতিবার আমি আরেকবার চেয়ে নিয়ে খেয়েছি। এমনকি বাবলার থালারটাও। ও ব্যাটা এমন স্বাদের ভাগ দিচ্ছিল দেখে অবাক হয়েছিলাম।
নতুন জায়গায় গেলে খাবারের স্বাদ নিতে হয়। তাতে কত কিছু নতুন মেলে। সামান্য ঝালমুড়ি এলাকা ভেদে কেমন আলাদা হয়ে যায়। সারাদিন ঘুরেটুরে এসে সন্ধেবেলা বাজার এলাকায় ঘুরছিলাম তিনজনে। উদ্দেশ্য একটু টিফিন হবে। আর ইন্দ্রর ঝোঁক চেপেছে দেশি মুরগি খাবে। জঙ্গল পাহাড়ের কোনও এলাকায় গেলে ওর এরকম ঝোঁক চাপে।
আমাদের খাবার টেবিল।
আমরা টিফিন খুঁজব। চপ মুড়ি পেলে বেশি ভাল হয়। নয়তো অন্য যা মিলবে। কিন্তু মুড়ি মিলল না কোথাও। খুচরো মুড়ির কোনও চল নেই। মুড়ি কোথায় মিলবে? বাজারে জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই দোকান দেখিয়ে দিয়েছেন। একজন তো মুড়ির কারখানায় যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারখানা প্রথমেই বাতিল হয়েছিল। কিন্তু দোকানেও প্যাকেট কিনতে হবে। ৫০০ গ্রামের প্যাকেট। অত মুড়ি নিয়ে কী করব? ট্রেনে ঝালমুড়ি করে বেচতে হবে নাকি? চপের দোকানেও মুড়ি বিক্রি হয় না।
ভাগ্যিস মুড়ি খোঁজার সঙ্গেই শিঙাড়া খেয়েছিলাম। তাই ইন্দ্র কিছুক্ষণ টিকতে পারল। না হলে আমাদের গালাগাল শুরু করত। তুলিন বাজারে শিঙাড়া খাওয়ার পদ্ধতি আলাদা। চাটনি সহযোগে শিঙাড়া খাই। ঘুগনি দিয়ে শিঙাড়া খেতে দেখেছি। তুলিন বাজারে পেলাম ঘুগনি আর চাটনি দিয়ে শিঙাড়া। একজন ঠেলায় করে বিক্রি করছিলেন। খারাপ লাগল না নতুন পরিবেশনা।
ঘুগনি, চাটনি সঙ্গী করা সেই শিঙাড়া।
মুড়ির খোঁজ করতে করতে দেশি মুরগির খোঁজও চলছিল। কিন্তু দোকান বেশির ভাগই বন্ধ। এর কারণও আছে। পুজোর চারদিন এখানে মাংস খাওয়ার চল কম। তাই বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। একটা দু’টো খোলা ছিল। কিন্তু ব্রয়লারই নেই তো দেশি! হাঁটতে হাঁটতে তখন আমরা অনেকটা চলে গিয়েছি। আসার সময়ে দেখেছিলাম, এক দোকানে লেখা ছিল হাঁসের মাংস পাওয়া যায়। ইন্দ্রর দেশি অন্বেষণ থামাতে লোভ দেখালাম। কিন্তু ওর হাঁস পছন্দ নয়। অগত্যা আবার হাঁটা। প্রায় কিলোমিটার দেড়েক হাঁটার পর থামানো হল ইন্দ্রকে।
হাঁটতে হাঁটতে শিঙাড়া পেটের কোন তলদেশে সেঁধিয়েছে। আরও কিছু খেতে হবে। বাজার এলাকায় ফিরে একটা ঠেলাওলার থেকে চিড়ে মাখা খাওয়া হল। ডিম সেদ্ধও। পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, চাট মশলা সহযোগে সেদ্ধ ডিম পরিবেশন করলেন ঠেলাওয়ালা। তাতেও বোধহয় পেট ভরেনি আমাদের। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেস্ট হাউসের দিকে আসতে একটা তেলেভাজার দোকান চোখে পড়েছিল। খাওয়া হল চপ। কিন্তু কেমন যেন মনে হল, ফুলুরির ভিতরে পুর দেওয়া। আমাদের এলাকার চপের থেকে একেবারেই আলাদা।
তৈরি হচ্ছে বোঁদের লাড্ডু।
নতুন এলাকায় গিয়েছি। মিষ্টির দোকান দেখব না তা কখনও হয়! কিন্তু বেশির ভাগ দোকানেই শুকনো মিষ্টি। আর সেগুলো সব চেনা। নতুন কিছু নয়। আমরা একটা দোকান থেকে বোঁদের লাড্ডু খেয়েছিলাম। দরবেশও বলতে পারেন। কিন্তু দোকানি বোঁদের লাড্ডুই বলছিলেন।
পরদিন সকাল সকাল যাত্রা। গাড়িচালক সোনু আমাদের পতরাতু ভ্যালি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভ্যালিতে ঢোকার আগে খেয়ে নেওয়া হবে ঠিক হয়েছিল। সোনু একটা রেস্তরাঁয় নিয়ে গেলেন। বেশ বড়সড়। অনেক কিছু মেলে। সোনুকে বোঝানো হয়েছিল, আমরা স্থানীয় কিছু খাবার দিয়ে জলখাবার খেতে চাই। ওঁর পরামর্শ ছিল, ধুসকা খাওয়ার। তখন কি জানতাম আমরা ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয়তম টিফিন বা নাস্তা খাচ্ছি?
এই সেই ধুসকা। ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় জলখাবার।
ধুসকা তৈরি হয় চাল, ছোলার আর বিউলির ডাল বেটে বড়ার মতো ভেজে। কোনও তরকারির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। আমরা খেলাম আলু, ছোলার তরকারি দিয়ে। ধুসকা খেতে বেশ ভাল। চাল-ডাল থাকায় ভারীও। পেটে থাকে অনেকক্ষণ। সেদিন ওই রেস্তরাঁয় আরও কিছু খাওয়া হয়েছিল। ছোলা বাটোরা আর মিষ্টি। মিষ্টি যে যার পছন্দ মতো। এতে একটা সুবিধে হয়। অনেক রকম খাবার চাখা যায়। আমরা নিয়েছিলাম পান্তুয়া, ছানার টোস্ট আর গুড়ের রসগোল্লা। ছানার টোস্টটা একটু আলাদা লেগেছিল। আমি আর দীপু মৌচাকের বিখ্যাত ছানার টোস্ট খেয়েছি। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের এই দোকানের ছানার টোস্টকে নোড়া আকারের লাল রসগোল্লা বলা হল। অনেকটা বাংলাদেশের বালিশ মিষ্টির মতো দেখতে। বালিশ মিষ্টির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। ছবিতে দেখে তুলনা টানা।
ছোলা বাটোরার বাহার।
পতরাতু থেকে ফিরে হুড্রু জলপ্রপাতে। ইন্দ্র যে দেশি মুরগির শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি বোঝা গেল হুড্রুতে এসে। ধুসকার পরে কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে খাওয়া দরকার। এদিকে ট্রেন ধরারও তাড়া। হুড্রুতে সারি সারি হোটেল। কোন ফাঁকে ইন্দ্র দেশি মুরগির দাম করে এসেছিল। দর হেঁকেছে ৮০০ টাকা কিলো। গোটা ওজন হবে। তার পর কেটেকুটে রান্না। রান্নার মাসুল আলাদা। বাপ রে! দেশি মুরগি নাকি ডোডো পাখি! আসলে এই দরের জন্য পর্যটকেরা দায়ী। পাহাড়, জঙ্গল, আদিবাসী বসত এলাকায় এলেই দেশি দেশি করে এমন হেদায়! ইন্দ্রর মতোই সব। ব্যবসায়ীরা বুঝে গিয়েছেন। তাই দামে গলা কাটার ব্যবস্থা। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখেছি, দেশির নামে যা খাওয়ায় তা বিদেশি মুরগি। আমাদের এলাকায় এগুলো সব পাইকারি দরে অস্ট্রেলিয়ান নামে পরিচিত। এসব অঞ্চলে স্বনির্ভরতার জন্য পঞ্চায়েত থেকে বিভিন্ন পরিবারকে ছাগল, মুরগি বিলি করা হয়। খোলা ভাবেই পালন করা হয় মুরগিগুলো। চরে বেড়ানো এই মুরগিগুলোই দেশির নামে চলে কিনা কে জানে!
রেস্তরাঁয় আমাদের মিষ্টির প্লেট।
দেশির দাম শুনে ইন্দ্র নাকি চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসেছিল। না, তুলিন সফরে দু’দিন আমরা ভাত খাইনি। কে বলে বাঙালির ভাত ছাড়া চলে না! হুড্রু থেকে দ্রুত ফিরে বিকেলে ট্রেন ধরার আগে লীলা নিবাসের পাশের সেই হোটেলেই খেয়েছিলাম। রুটি পনির, মিক্সড ভেজ তরকারি।
আর অবশ্যই বাদামের চাটনি।
কভারের ছবি— রুটির সঙ্গী বাদামের চাটনি
ছবি— বাবলা, ইন্দ্র, লেখক
(সমাপ্ত)