হাওড়ার পুতুল
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কুমোরপাড়ার গল্পস্বল্প— রানিপুতুলের কাহিনি

দীপক দাস

পাড়ায় ঢোকার মুখে চোখে পড়ে পণটা। গোলাকার উনুনের মতো। কিন্তু বিশাল। কুমোরপাড়া বোঝা যায় যে কয়েকটা চিহ্ন দিয়ে পণ তার অন্যতম। এতেই কুম্ভকারদের তৈরি মাটির জিনিসপত্র পোড়ানো হয়। পাড়ায় ঢুকতেই পণ দেখতে পেয়ে ভালই লাগল। তার মানে মাটির কাজ হয় এখনও।

হাওড়া জেলার কুমোরপাড়াগুলো ঘোরার ইচ্ছে হয়েছিল একবার। সেই সূত্রেই জগৎবল্লভপুর ব্লকের নরেন্দ্রপুরে আসা। এখানকার কুম্ভকার পাড়া বেশ প্রাচীন। কিন্তু এখন কী অবস্থায় রয়েছে? একদিন দীপু আর আমি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম।

পণের আগেই একটা ঘর। ঘরের দরজার কাছে বসে কাজ করছিলেন মৌমিতা পাল। মাটির বোকা ভাঁড় তৈরি করছিলেন। যেগুলো লক্ষ্মীর ভান্ডার নামে পরিচিত। এ পাড়ার বৌমা তিনি। মৃৎশিল্পী জহর পালের স্ত্রী। বছর ২৮ হল বিয়ে হয়েছে। বাপের বাড়িতে মাটির কাজ ছিল না। স্বামীর কাছে কাজ শিখেছিলেন। শির বানিয়ে, খুন্তি চাপড়ে হাত পাকিয়েছেন। জহর কাজ শিখেছেন মা কানন পালের কাছে। মৌমিতার যখন বিয়ে হয় তখন মাটির কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন কানন। মাটির কাজ নিজেরা পোড়াতে না পারলে পয়সা নেই। মাটির কাজ পোড়ানোর ব্যবস্থা ছিল না তাঁদের।

মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর পণ।

এখন অবশ্য অনেক কিছুই তৈরি করতে পারেন মৌমিতা। পুজোর বাসন, মালসা, গামলা, দইয়ের হাঁড়ি, বোকা ভাঁড়। বাচ্চাদের নানা খেলনা তৈরি করেন। হাঁড়ি, কড়া, বেলন, চাটু, বালতি, ঘোড়া ইত্যাদি। আর তৈরি করেন পুতুল। একটা কুমোরদের চিরাচরিত টেপা পুতুল। মেয়ে পুতুল, ছেলে পুতুল। এটা হাতে তৈরি করেন। আরেক ধরনের পুতুল তৈরি করেন ছাঁচে। মৌমিতা জানালেন, পুতুল তৈরির মরসুম হল মুন্সিরহাটের ফতে আলির যাতের মেলার সময়। সেই সময়ে ৫০০ পুতুল করেন। মেলায় যা বিক্রি হল। বাকিটা সারা বছর ধরে বিক্রি হয়। পরে চাহিদা থাকলে আরও খান পঞ্চাশেক পুতুল বানিয়ে ফেলেন।

বোকা ভাঁড় তৈরি করছেন মৌমিতা।

মাটির জিনিসপত্র বিক্রির জন্য জহরবাবুর মুন্সিরহাট বাজারে দোকান আছে। সারা বছরই টুকটাক বিক্রি হয়। মিষ্টির দোকানগুলোয় দইয়ের হাঁড়ির চাহিদা রয়েছে সারা বছরই। কুমোর পাড়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তাঁদের চাক। জহরবাবুদের চাক নেই। এখন হাতে যে সব জিনিস তৈরি করা যায় সেগুলোই করেন। যেমন, হাঁড়ি ইত্যাদি তৈরির জন্য কলসির উল্টো দিক ব্যবহার করা হয়। উল্টো দিকে মাটি দিয়ে চাপড়ে চাপড়ে একটা আকার তৈরি হয়। পরে শির তৈরি করে তা জল দিয়ে লাগানো হয়।

মাটির সমস্যা আছে বলে জানালেন মৌমিতা। মাটি কেনেন বস্তা হিসেবে। একজন দিয়ে যান প্রয়োজনীয় মাটি। বৈশাখ মাসে মাটি কিনে রাখতে হয়। এখন আর নদী, খাল থেকে নিজেরা মাটি সংগ্রহ করতে পারেন না। সরকারি নিষেধ রয়েছে। কেনা মাটিতেই ভরসা। মাটির জোগান কম বলে জিনিসপত্র বেশি তৈরি করতে পারেন না তাঁরা। অনেক জিনিস অন্য জায়গা থেকে কিনে আনতে হয়।

মৌমিতার হাতে ছাঁচের পুতুল তৈরির ছাঁচ।

পরের প্রজন্ম কি মাটির কাজে আগ্রহী? মৌমিতা জানালেন, তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে এমএসসি পাস। ড্রয়িংয়ের কাজ শিখতে মুম্বই গিয়েছেন। মাটির কাজ করে না কেউ।

দুই

নরেন্দ্রপুর কুমোরপাড়াতে তিন ভাইয়ের সন্ধান মিলল। তাঁরা সকলেই মৃৎশিল্পী। বড় বছর সত্তরের শ্যামাপ্রসাদ পাল পালাপার্বণে যে সব মাটির তৈজসপত্র তৈরি হয় সেগুলো করেন। হাঁড়ি, মালসা ইত্যাদি। করেন লক্ষ্মীর ভান্ডারও। মেজো দিবাকর পাল নানা জিনিস তৈরি করতে পারেন। তাঁর সুনাম বেশি পুতুল তৈরিতে। সেজো আশুতোষ পাল ঠাকুর তৈরি করেন। মুন্সিরহাট কালিকা সিনেমা হলের কাছে তাঁর ঠাকুর তৈরির কারখানা রয়েছে। গত বছরে জগৎবল্লভপুর ব্লকে কালী প্রতিমা তৈরিতে প্রথম হয়েছেন।

মাটির কাজে ব্যস্ত শ্যামাপ্রসাদ পাল। তৈরি হচ্ছে বড় বড় লক্ষ্মীর ভান্ডারও।

দিবাকর পাল মাধ্যমিক পাশ করার পরে চাকের কাজ শিখেছেন। নানা জিনিস তৈরির সঙ্গেই তিনি ধীরে ধীরে মাটির পুতুল তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তৈরি করেন মেয়ে পুতুল, ছেলে পুতুল। এগুলো কুম্ভকারদের চিরাচরিত টেপা পুতুলের রীতির। এ ছাড়াও তৈরি করেন ঘোড়া, পালকি, শালতি। এগুলো চাকা লাগানো হয়। আবার কিছু ঘোড়া তৈরি হয় বিভিন্ন দেব, পিরস্থানে দেওয়ার জন্য। মুন্সিরহাটের ফতে আলির যাতে মাটির ঘোড়ার চাহিদা থাকে। অনেকেই পিরের দরগায় ঘোড়া দেন। তবে দিবাকরবাবুর বেশি সুনাম রানিপুতুল তৈরিতে। এই পুতুলের বিক্রি বেশ। ভিন রাজ্যেও যায় তাঁর তৈরি রানিপুতুল। আগে হাতেই তৈরি করতেন রানিপুতুল। এখন ছাঁচে তৈরি করতে হয়। না হলে জোগান দেওয়া যায় না। একটা রানিপুতুলের দাম ৩০ টাকা। কিন্তু তৈরি করতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। পরতায় পোষায় না। ছাঁচে তৈরি হলে অনেক বেশি পুতুল তৈরি সম্ভব। তবে ছাঁচে তৈরি হলেও রানিপুতুলের শৈল্পিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না। কারণ ওই ছাঁচটি দিবাকরবাবু নিজেই তৈরি করেন।

শুকোচ্ছে নানা ধরনের টেপা পুতুল।

কুমোর বাড়িতে মেয়েরাও ঘরের কাজের ফাঁকে মাটির কাজে হাত লাগান। এই তিন ভাইয়ের বাড়িতেই গৃহিণীরা সে কাজ করেন। আশুতোষ পালের বাড়ির সামনে অনেক কাঁচা ছেলে পুতুল, মেয়ে পুতুল রোদে দেওয়া রয়েছে দেখলাম। দিবাকর পালের স্ত্রী কল্পনা পাল হাঁড়ি, কলসি, খেলনা তৈরি করেন।

তিন

রানিপুতুলের পাড়ায় সমস্যা কী? মাটি একটা বড় সমস্যা। আর সেই সমস্যার রূপ নানা রকম। মাটির সমস্যার কারণেই চাক তুলে দিতে হয়েছে। তিন পরিবারের কারও চাক নেই। আশুতোষ পাল চাকের কাজ ছেড়েছেন বছর ৩৫ হল। এক সময়ে এই পাড়ায় চাকের কাজ করতেন ১৫-১৬ জন। এখন একজনও চাকের কাজ করেন না। কারণ চাক তৈরিতে পরিষ্কার মাটি লাগে। সবচেয়ে ভাল হয় চাষের জমির মাটি। কিন্তু জমির মালিক মাটি দিতে চান না। আগে জমি থেকে মাটি নিলেও কুমোরদেরই ভরাট করে দিতে হত। অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে। কিন্তু ঠিক মতো ভরাট না হলে চাষের সময়ে লাঙল বা ট্রাক্টর দিতে সমস্যা হয়। তখন মৃৎশিল্পীদের গালমন্দ করেন জমির মালিক। মাটির কারণেই চাক তুলে দিতে হয়েছে।

দিবাকরবাবুর তৈরি ছেলে পুতুল, মেয়ে পুতুল এবং রানিপুতুল।

এই এলাকায় রয়েছে কানা নদী বা কৌশিকী। রয়েছে খালও। কিন্তু পরিবেশের কারণেই নদী বা খালের মাটি তোলা এখন বন্ধ। শ্যামাপ্রসাদ, দিবাকর পালেরা পুকুর, ডোবার মাটি কেনেন। মাটি তোলার সময়ে মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে থাকতে হয়। কারণ পুকুরের গভীরের এবং উপরের, উভয় স্তরের মাটিই লাগে। তাই চিনিয়ে দিতে হয় মাটি কাটার লোকেদের। ব্যবসায়ীরা সে মাটি চিনতে পারেন না।

আশুতোষ পাল প্রতিমা শিল্পী। কুমোরটুলিতে কাজ শিখেছেন। তাঁর মাটির সমস্যা আবার অন্যরকম। প্রতিমা তৈরির নানা পর্যায়ে নানা রকম মাটি লাগে। এক মেটের মাটি পাওয়া যায় পাড়া গাঁয়েই। কিন্তু দু’মেটের কাজে গঙ্গামাটি লাগে। আর তা আসে বালি-উত্তরপাড়া থেকে। সেখানে নানাজনের ‘দাদাগিরি’ সয়ে মাটি কিনতে হয়। মাটি আনতে হয় গাড়ি ভাড়া করে।

দিবাকরবাবুর হাতে নানা ধরনের পুতুল।

বংশ পরম্পরায় যে সব শিল্প টিকে থাকে তার একটি সাধারণ সমস্যা দেখা যায়। নতুন প্রজন্ম কাজে আগ্রহী হয় না। এই তিন মৃৎশিল্পী পরিবারের চিত্রটা একটু আলাদা। শ্যামাপ্রসাদবাবুর ছেলে বিশ্বজিৎ, দিবাকরবাবুর ছেলে শুভজিৎ মাটির কাজ করেন। আশুতোষবাবুর ছেলে অভিজিৎ ঠাকুর গড়েন বাবার কারখানায়। শুভজিৎকে কাজে নামতে হয়েছিল দিবাকরবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়। স্নাতক স্তরের পড়া ছেড়ে পারিবারিক কাজে নেমে পড়তে হয়েছে তাঁকে। মাটির জিনিসপত্র বিক্রির দোকান রয়েছে দিবাকরবাবুর। এখন শুভজিৎই বসেন। ছোটদের আগ্রহী করে তুলতে শুভজিৎ মাটির গ্যাস সিলিন্ডার, রেডিয়ো ইত্যাদি তৈরি করছেন। যাতে আরেকটু বিক্রি বাড়ে।

সমস্যা আরও রয়েছে। শ্যামাপ্রসাদবাবু জানালেন, ঋণ পাওয়ার তেমন সুবিধা মৃৎশিল্পীদের নেই। মৃৎশিল্পীদের ঋণ দিতে চায় না সরকার। তাঁদের শিল্পী কার্ড করাতেও সরকার আগ্রহ দেখায়নি। অন্য কাজ নেই। তাই ‘জাত ব্যবসা’ আঁকড়ে ধরে জীবন চালাচ্ছেন এ পাড়ার মৃৎশিল্পীরা।

অথচ মৃৎশিল্পের বাজার তৈরি করার সুযোগ ছিল। মাটির তৈরি জিনিসের মতো পরিবেশবান্ধব তো আর কিছু হয় না। মৃৎশিল্পীদের পুতুলের বাজারের অনেকটা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক। যা পরিবেশ দূষণ করে। রয়েছে বিপণনের অভাব। রানিপুতুলের কথা লোকমুখে যেটুকু ছড়ায় তার ভরসাতেই কাজ করেন দিবাকরবাবু। অবশ্য সরকারি ভাবে তাঁকে বিভিন্ন কর্মশালায় ডাকা হয়েছে।

শুভজিতের তৈরি মাটির গ্যাস সিলিন্ডার।

মাটির অভাবে চাক বন্ধ, অতি সত্য। আবার মাটির হস্তচালিত চাকে কাজ করাও বেশ কঠিন। কারণ বেশ ভারী। একটু বয়স বা অসুস্থ হলে তা ঘোরানো কষ্টকর হয়। এখন হস্তচালিত চাক বেরিয়েছে। এর ব্যবস্থা করতে সরকারি পদক্ষেপ দরকার। চাক চালু হলে খুড়ি, হাঁড়ি, কলসি যাবতীয় করা যাবে। মাটির জিনিসে ফুটিয়ে তোলা যাবে নকশাও। অনুষ্ঠান বাড়িতে প্লাস্টিকের জলপাত্রের বদলে অনায়াসে ব্যবহার করা যাবে মাটির খুড়ি। চাকে নকশা ফুটিয়ে তোলা গেলে তা মনোগ্রাহী হবে। বিক্রি বাড়ার সম্ভাবনা মাটির জিনিসের। কম বয়সি যাঁরা মাটির কাজে আসছেন তাঁরাও সহজে বেশি জিনিস তৈরি করতে পারবেন। নানা সমস্যার কারণেই এই পাড়ার মৃৎশিল্পীদের বাইরে থেকে কিছু জিনিস কিনে খদ্দের ধরে রাখতে হয়।

হাল ফেরাতে দরকার মাটি। আর দরকার সরকারি উদ্যোগ।

কভারের ছবি— দিবাকর পালের তৈরি রানিপুতুল

ছবি— দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *