কুমোরের চাক
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কুমোরপাড়ার গল্পস্বল্প— কালো কলসির পাড়া

দীপক দাস

খুব সম্ভবত লালুপ্রসাদ যাদব তখন রেলমন্ত্রী। তাঁর রেলমন্ত্রক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রেলের প্রতিটি স্টেশনে চায়ের দোকানগুলোয় মাটির ভাঁড়ে চা বিক্রি করতে হবে। এটা ২০০৪ সালের ঘটনা। লালুপ্রসাদ সফল হননি। প্লাস্টিকের কাপেই চা দেওয়া চলত রেলের জায়গার চায়ের স্টলে। স্টেশনে স্টেশনে ‘চা গ্রম’ হেঁকে বেড়ানো চাওয়ালারাও প্লাস্টিকের কাপই ব্যবহার করতেন। লালুপ্রসাদের পরে আবার চেষ্টা হয়েছিল করোনা অতিমারির সময়ে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ। রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের আমলে।

লালুপ্রসাদের সময়ে মাটির ভাঁড় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তের পিছনে পরিবেশের চিন্তা ছিলই। কিন্তু কুম্ভকারদের জীবিকার পুনরুজ্জীবনের ভাবনাও ছিল সেই সঙ্গে। অতিমারি আমাদের সচেতন করেছিল নানা ভাবে। বিশেষ করে পরিবেশের কথা বেশি করে ভাবতে। তাই পীযূষ গয়ালের মাটির ভাঁড় ফেরানোর পিছনে মূলত পরিবেশ রক্ষার দায়ই ছিল। কারণ ততদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে, একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক পৃথিবীর কতটা বোঝা! ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সিঙ্গল ইউজড প্লাস্টিক’, তা শুধু পৃথিবীর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি। কুম্ভকারদের জীবনের বোঝা বাড়িয়েছিল। তাঁদের আয় এক ঝটকায় কমে গিয়েছিল অনেকটা। চায়ের দোকান ছাড়াও মিষ্টির দোকানেও তাঁদের কদর কমেছিল। মাটির হাঁড়িতে মিষ্টি দেওয়া বন্ধ। এমনকি লোকে দোকানে দাঁড়িয়ে শ’খানেক দই খেতেন যে ছোট ভাঁড়ে তার জায়গাও প্লাস্টিক। এখনও সে জায়গা দখল মুক্ত হয়নি। শুধু দই বসানোর জন্য মাটির ভাঁড় কিনত মিষ্টির দোকানগুলো।

রোদে শুকোচ্ছে দইয়ের ভাঁড়।

অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনটাই চোখে পড়ল শঙ্করহাটির কুমোরপাড়ায় গিয়ে। একটা নয়, দু’টো পরিবর্তন। গিয়েছিলাম চাঁদমোহন পালের কারখানায়। আমি আর দীপু। চাঁদু পাল নামেই পরিচিতি বেশি। তিনি মাটির ভাঁড় তৈরি করছিলেন। দইয়ের ভাঁড়। ওই আড়াইশো গ্রাম দই দেওয়া হয় যে ভাঁড়ে। কারখানায় বেশ কিছু পোড়ানো চায়ের ভাঁড়ও রাখা। চাঁদুবাবু জানালেন, ভাঁড়ই তাঁর প্রধান আয়ের উৎস। অর্থাৎ প্লাস্টিকের কাপের বদলে মাটির ভাঁড়ের ব্যবহার বাড়ছে। তিনি ভাঁড় তৈরি করছিলেন চাকে। সে চাক হস্তচালিত নয়। যন্ত্রচালিত। কুমোরপাড়ার বৈশিষ্ট্যই হল চাক। কিন্তু চালানো কষ্টকর বলে এবং মাটির অভাবে হস্তচালিত চাক কুমোরপাড়া থেকে উঠেই যেতে বসেছে। চাঁদুবাবু চাকের পরিবর্তন করেছেন। এই চাক ছোট্ট মোটরে চলে। ফলে বেশি পরিশ্রম হয় না। হস্তচালিতের মতো আকারে বড় হয় না বলে বেশি জায়গাও লাগে না। এটাই দ্বিতীয় পরিবর্তন।

চাকের কাজে ব্যস্ত চাঁদমোহন পাল।

চাকের পরিবর্তনটা আনতে পেরেছেন বলে জীবিকার সমস্যা হচ্ছে না। তবে কুমোরপাড়ার সাধারণ সমস্যাগুলো থেকে তিনি বা তাঁর পাড়া মুক্ত নন। তাঁরও মাটির অভাব রয়েছে। শঙ্করহাটি একেবারে কৌশিকী নদী বা কানা দামোদরের তীরে। আগে নদী থেকেই মাটি নিতেন এই পাড়ার কুম্ভকারেরা। কৌশিকী সংস্কারের পরে পরিবেশের কারণেই নদী থেকে মাটি তুলতে দেওয়া হয় না। তাঁকে বাইরে থেকে মাটি কিনতে হয়। তাঁর মাটি আসে ডায়মন্ডহারবার থেকে। ফোনে বরাত দিতে হয়। ট্রেলারে করে মাটি আসে। এক লরি মাটির দাম ৪০ হাজার টাকা। এত টাকা দিয়ে একজনের পক্ষে মাটি কেনা সম্ভব নয়। হাওড়ার বিভিন্ন এলাকার কুম্ভকারদের বরাত একসঙ্গে পেলে মাটি দিয়ে যান ব্যবসায়ী। যাঁর যেমন লাগে ততটা কেটে কারখানার সামনে নামিয়ে দিয়ে যান ট্রেলার থেকে।

শঙ্করহাটি প্রাচীন কুমোরপাড়া। কিন্তু মাটির অভাবে এবং চাহিদা কমায় এই পাড়ার অনেকেই মাটির কাজে যুক্ত নন। অন্য পেশায় যুক্ত তাঁরা। যেমন কুম্ভকার কেষ্ট পালের মুদি দোকান রয়েছে। কাঠের কাজ করেন গণেশ পাল। গণেশ পালের বাবা টোকো পাল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। গোবর্ধন পাল মাটির কাজ করতেন একসময়ে। তবে চাঁদুবাবুর ভাইপো সঞ্জয় পাল এখনও মাটির কাজ করেন।

ভাঁড়ের সারি।

ব্যবসা বাড়ানোর জন্য কুম্ভকারেরা সরকারি সাহায্য তেমন পান না। তাঁদের সহজে সরকার ঋণ দিতে চায় না। চাঁদুবাবু জানালেন, বছর ২০ আগে তিনি একবার ঋণ পেয়েছিলেন। ১৮০০ টাকা। ঋণের অর্ধেকটা অনুদান। তাই শোধ করতে হয়েছিল ৯০০ টাকা। কুমোরদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেমন জরুরি তেমনই দরকার আরও বেশি যন্ত্রচালিত চাকের। তাতে উৎপাদনের গতি ও পরিমাণ বাড়বে। মৃৎশিল্পীদের কায়িক শ্রম কম হবে। তাঁরা অনেক বয়স পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন।

চাঁদুবাবু পুতুল তৈরি করেন না। এমনকি হাঁড়ি, সরাও নয়। তাঁর দোকানে কিছু হাঁড়ি, বোকা ভাঁড় ছিল। জানালেন, এগুলো পাতিহাল গ্রামের কুমোরদের থেকে কিনে এনেছেন। কারখানায় নকশা কাটা মাটির থালাও দেখেছিলাম। এগুলোও বাইরে থেকে কেনা। কিছু খদ্দের এগুলো চান। তাই রাখা। না হলে চাঁদুবাবু মাটির ভাঁড়ই শুধু তৈরি করেন। আমরা যখন কথা বলছিলাম তখন এক চায়ের দোকানদার ভাঁড় কিনতে এসেছিলেন। তিনিও জানালেন, মাটির ভাঁড়ই বেশি ব্যবহার করছেন। এক দু’জন খদ্দের প্লাস্টিকের কাপে চা খেতে চান। তাঁদের জন্য কিছু কাপ কিনতে হয়।

মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর পণ।

কী রকম দাম ভাঁড়ের? ছোট চায়ের ভাঁড় ১০০টি ৭০ টাকা। বড় চায়ের ভাঁড় ১০০ টাকা। দইয়ের আড়াইশো গ্রাম ভাঁড় ১০০টির দাম ২৫০ টাকা।

শঙ্করহাটির পালেদের মাটির কালো কলসি, হাঁড়ির একসময় নাম ছিল। মুন্সিরহাটে ফতে আলির যাতের মেলায় এই কালো কলসির চাহিদা ছিল। মেলার ঐতিহ্যের অন্যতম কালো হাঁড়ি, কলসি। এখনও মেলার আগে কালো হাঁড়ি তৈরি করেন চাঁদুবাবু।

কী ভাবে কালো কলসি তৈরি হয়? চাঁদুবাবু জানালেন, পোড়ানোর কায়দায়। পণে দমবন্ধ করে পোড়াতে হয় কাঁচা হাঁড়ি কলসি। প্রথমে পণে কাঁচা হাঁড়ি রেখে তার গা মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে। এ জন্য তৈরি রাখতে হবে ঝুরো মাটি। তা দিয়ে পুরো পণ ঢেকে দিতে হবে। জ্বালানির কাঠের সঙ্গে দিতে হবে ঘুঁটে। তাতে ধোঁয়া হবে। ঝুরো মাটির প্রলেপে চাপা থাকায় ধোঁয়া বেরোতে পারবে না। ঝুরো মাটি লেপায় কোনও ফাঁক থাকলে কিন্তু সেইখানের মাটির হাঁড়ি লাল হয়ে যাবে।

পোড়ানোর পরে চায়ের ভাঁড়।

আমরা এপ্রিল মাসে শঙ্করহাটি কুমোরপাড়ায় গিয়েছিলাম। তখন কালো হাঁড়ি তৈরির সময় নয়। তাই ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। ফতে আলির যাতের মেলা শুরু হলে তুলে রাখতে হবে।

কভারের ছবি— চাকের শৈলী

ছবি— দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *