বনমালিপুর, মলয়পুর, আরামবাগ, হুগলি।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটে হুগলির বনমালিপুরে

দীপক দাস

বীরসিংহের সিংহপুরুষ তিনি। আমরা ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি। আর বীরসিংহ গ্রামটি মেদিনীপুরে। জেলা ভাগের পরে এখন পশ্চিম মেদিনীপুরে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পারিবারিক শিকড় আসলে বনমালিপুরে। এ গ্রাম আবার হুগলি জেলায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম। তার পর খোঁজখবর।

সে বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। স্মৃতি থেকে মুছেও গিয়েছিল বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটে। মাস ছয়েক আগে হঠাৎ ইন্দ্রজিৎ একটা লিঙ্ক পাঠাল। ওই বনমালিপুরের। দেখে পাণ্ডিত্য ফলানোর চেষ্টা করেছিলাম, ‘‘জানি তো!’’ পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘‘আমরা যাইনি কেন?’’ ভেবেছিলাম, পাণ্ডিত্যে প্রভাবিত হবে। পরিবর্তে কৈফিয়ৎ চেয়ে বসবে ভাবিনি। এর উত্তর কী দিই! বিষয়টি চাপা দেওয়ার জন্য বলেছিলাম, ‘‘একদিন গেলেই হয়।’’

সেই যাওয়াটা হল সম্প্রতি। গত ২৩ জুলাই। অনেকদিন বেরনো হয়নি। এ দিকে দীপু গবেষণার থিসিস পেপার জমা দিয়ে অনেকটা মুক্ত। এতদিন কাজ কাজ করে হাঁফিয়ে উঠেছিল। কিন্তু বেরনোর জন্য যতবার পরিকল্পনা করেছি ততবারই কোনও না কোনও কারণে বাতিল করতে হয়েছে। ২৩ জুলাই, মঙ্গলবার, সব বাধা পেরিয়ে পথে। চাঁপাডাঙা দিয়ে যাব আমরা। তাই দীপ্তেন্দুবিকাশকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর পরীক্ষা ছিল সামনে। ফলে আমরা তিনজন দু’টি বাইকে।

বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটেয় ঢোকার রাস্তা।

আমাদের লক্ষ্য কাবলে বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে মলয়পুর। যাব গজার মোড়, চাঁপাডাঙা পেরিয়ে। দীপ্তেন্দুই পথনির্দেশ দিয়েছিল। এবং জানিয়েছিল, গণপরিবহণ নয়, বাইকে যাওয়াই ভাল। ওর কথায় কাবলে খুব বেশি দূর মনে হল না। কিন্তু মলয়পুরের বনমালিপুরের আন্দাজ ছিল না। কাবলে থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে। জিজ্ঞাসাবাদ করে করে পৌঁছনো গেল মলয়পুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে। এটাই ভূমি-চিহ্ন (ল্যান্ডমার্ক) ছিল আমাদের। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল বিদ্যাসাগরের বাড়ি আর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কথা। তিনি দেখিয়ে দিলেন সোজা। পৌঁছলাম মাঠের মাঝে একটা সাদা রঙের বাড়ির কাছে। পাশের জমিতে চাষ করছিলেন কয়েকজন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, আবার ফিরতে হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে। পাশ দিয়ে যে আধ কাঁচা রাস্তাটা ঢুকে গিয়েছে ওটা ধরে কিছুটা গেলেই পড়বে বিদ্যাসাগরের ভিটে।

কাঁচা রাস্তায় ঢুকে আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে পিছিয়ে এলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, যাঁর বাড়িতে মূর্তিটি রয়েছে তিনি বর্ধমানে। ছেলের কাছে গিয়েছেন। সপ্তাহখানেক পরে আসবেন। এতদূর এসে ফিরে যেতে হবে? ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলাম, কাছাকাছি কোনও দোতলা বাড়ি নেই? যেখান থেকে উঠে একটু ভিটেটা দেখা যাবে? ভদ্রলোক বললেন, ‘‘দেখবেন? আসুন।’’ আমরাও আশায় আশায় পিছু নিলাম। একটা বাড়িতে ঢুকে তিনি মই বার করে নিয়ে এলেন। পাশের পাঁচিলের গায়ে ঠেকিয়ে বললেন, ‘‘পাঁচিলের ওপাশে রয়েছে মূর্তিটা।’’

পাঁচিলে উঠে লেখক আর দীপুর মূর্তির ছবি তোলার চেষ্টা।

পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে হয়। মইয়ে চড়ার অভ্যাস বহু পুরনো। উঠে পড়লাম। কিন্তু প্রথম ধাপেই মালুম হল, মইয়ের একদিকটা পাঁচিলের গায়ে ঠিক বসেনি। পা দিতেই কাত হয়ে যাচ্ছিল। ইন্দ্রকে বলা হল মই ধরতে। ও ধরল। তবে যে দিকটা কাত হচ্ছিল সেদিকেই। ও মুখে অবশ্য অভয় বাণী ছিল, ‘‘কিচ্ছু হবে না। তুমি ওঠো।’’ মই থেকে পাঁচিলে। ওপাশে বাগানের এক কোণে সিমেন্টের একটা ছাউনি করা জায়গায় বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি। ছাউনির পাশ দিয়ে একটা দড়ি গিয়েছে। ছবি তুলতে গেলে দড়িটা এড়ানো যাচ্ছিল না। মোবাইলে ছবি ভাল উঠবে না। তাই ক্যামেরা নিয়ে মইয়ে উঠল দীপুও।

যিনি মই দিয়ে সাহায্য করলেন তিনি উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরের পরিবারের সন্তান। তিনি জানালেন, এইখানে ২৪ শতক ভিটে ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের। পরিবারের অনেক ঠাকুর। ফলে আত্মীয়স্বজনদের কয়েকজনকে এনে বসিয়েছিলেন পরিবারের কর্তারা। বাম আমলে বিদ্যাসাগরের ব্রোঞ্জের মূর্তিটি বসানো হয়েছিল। সেই সময়ে বিডিও থেকে লোকজন জিপে করে এসে মূর্তিতে মালা দিয়ে যেতেন। ঢোকার মুখে রাস্তা কাঁচা ছিল। কাদা হত। তখনই ঢালাই করা হয় একটু অংশ। এখন আর বিডিও থেকে কেউ আসেন না। তবে আশ্বিন মাসে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে অনুষ্ঠান হয়। মূর্তির ফলক অনুযায়ী, বিদ্যাসাগরের ১৭৯তম জন্মদিবসে ব্রোঞ্জের মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা প্রাক্তন বিধায়ক বিনোদ দাশ। উদ্যোগে ছিল আরামবাগ মহকুমা সার্বিক সাক্ষরতা ও জনস্বাস্থ্য পর্ষদ এবং আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতি। তারিখ ২৬/৯/১৯৯৮।

পাঁচিল থেকে তোলা অশোকবাবুর বাড়ির প্রাঙ্গণে মূর্তির ছবি।

বনমালিপুরের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যোগ কী? উত্তমবাবুর দেওয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বংশলতিকা অনুযায়ী, বনমালিপুরে তাঁদের প্রথম পুরুষ ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। তাঁর পুত্ররা হলেন, নৃসিংহরাম, গঙ্গাধর, রামজয় তর্কভূষণ, পঞ্চানন এবং রামচরণ। রামজয় তর্কভূষণ হলেন বিদ্যাসাগরের ঠাকুরদা। তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবী। দম্পতির দুই ছেলে— ঠাকুরদাস ও কালিদাস। চার মেয়ে মনমোহিনী, দিগম্বরী, মন্দাকিনী, ভদ্রকালী।

বনমালিপুর পৈতৃক ভিটে হলে বীরসিংহ কেন বিদ্যাসাগরের গ্রাম হিসেবে প্রসিদ্ধ হল? এ বিষয়ে ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখছেন, ‘পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ কোনও পারিবারিক বিবাদে উত্যক্ত হইয়া স্বীয় পত্নী দুর্গাদেবীকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক কিছুকালের জন্য দেশান্তরী হইয়া গিয়াছিলেন। দুর্গাদেবী নিরাশ্রয় হইয়া বীরসিংহ গ্রামে স্বীয় পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন’। জ্যেষ্ঠপুত্র ঠাকুরদাস সেই সময় হইতে ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিয়া জীবন-সংগ্রাম আরম্ভ করেন’।

কোনও অনুষ্ঠানে বিদ্যাসাগরে মূর্তি। ছবি উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে

বিবাদটির স্বরূপ নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছিলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর লেখা অনুযায়ী, স্বামীর অনুপস্থিতির সঙ্গে দুই ভাসুরের অত্যাচারেই দুই ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছিলেন দুর্গাদেবী। তাঁর কাছে শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার শুনে বাবা উমাপতি মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের দায়িত্ব নেন। তবে বাপের বাড়িতেও স্বস্তি ছিল না পরে। প্রথমের দিকে বিদ্যাসাগরের মামা আদর যত্ন করলেও একসময় প্রবল অশান্তি শুরু হয়। উমাপতি অসুস্থ হওয়ার পরই সমস্যার শুরু। একসময় দুর্গাদেবী বাপের বাড়ি ছেড়ে বীরসিংহ গ্রামেই বাবার দেওয়া জমিতেই ছোট কুটির তৈরি করে বাসবাস করতে শুরু করেন। একসময় বনমালিপুরে ফেরেন রামজয়। স্ত্রী বাপের চলে গিয়েছে শুনে তিনিও বীরসিংহে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। সেই থেকে বিদ্যাসাগরেরা বীরসিংহে।

যে বাড়ির প্রাঙ্গণে বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি রয়েছে সেটি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই বাড়িতেই কেন মূর্তিটি স্থাপন হল? অভিজিৎবাবুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যাসাগর বনমালিপুরে গ্রামে অনেকবার এসেছিলেন। সেই সময়ে মুণ্ডেশ্বরী নদীর একটি শাখা গ্রামের ভিতর দিয়ে বইত। বন্যা হত প্রায়ই। বন্যায় বিদ্যাসাগরের পরিবারের পুরনো ঘর ভেঙে গিয়েছিল। তিনি গ্রামে এসে একটি মাটির বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। বাড়ির জায়গাটির স্মৃতি রক্ষায় সেখানে বিদ্যাসাগরের মূর্তি বসানো হয়েছে।

উত্তমবাবু বলছিলেন, বনমালিপুরে বিদ্যাসাগরের ঠাকুরদা রামজয়ের ভাই রামচরণের বংশধরেরা থাকেন। অশোকবাবু উত্তমবাবুর তুতো কাকা। মজা করে একটা কথা বলেছিলেন উত্তমবাবু। তাঁদের পরিবারের সকলেই ভীষণ রগচটা। এর একটি উন্নততর ভাষ্য মিলছে ‘রামতনু লাহিড়ী…’তে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘যে ব্রাহ্মণকুলে তিনি (বিদ্যাসাগর) জন্মিলেন, তাঁহারা গুণগৌরবে ও তেজস্বিতার জন্য সে প্রদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন’।

চলে আসার সময়ে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন উত্তমবাবু। সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিদ্যাসাগরের পাড়া পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা মোটেও ভাল নয়। কোনও একসময়ে মোরাম পড়েছিল। কিন্তু এখন আর তার অস্তিত্ব বিরল হয়েছে। বৃষ্টিতে কাদা হয়েছে জায়গায় জায়গায়।

বাঁদিকে পোস্টের গা দিয়েই ঢুকতে হয় বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটেয়। আমাদের সঙ্গে উত্তমবাবু।

বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটে দেখেই আমাদের যাত্রা শেষ হয়নি। উত্তমবাবুর একটা কথা মাথায় ঘুরছিল। বিদ্যাসাগর নাকি মলয়পুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের মাতব্বরেরা সেই স্কুল ভেঙে দেন। গ্রামের মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক তা তাঁরা চাননি। বনমালিপুর মলয়পুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে। যেখানে স্কুলটি হয়েছিল সেখানে নাকি এখন মলয়পুর ২ নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়। খুঁজে খুঁজে গেলাম। এক শিক্ষক জানালেন, এমন তথ্য তাঁর জানা নেই। তবে স্কুলে একটা বহু পুরনো কাঠের আলমারি রয়েছে। তাতে বালিকা বিদ্যালয় লেখা রয়েছে। আমরা আলমারিটা দেখতে চাইলে শর্ত দিলেন, ছবি তোলা যাবে না। আমি আর দীপু মোবাইল ইন্দ্রর কাছে রেখে স্কুলে ঢুকলাম। সত্যি ছোটখাট আলমারিতে খোদাই করা আছে, মলয়পুর বালিকা বিদ্যালয়। কেন বালিকা বিদ্যালয়ের নামে আলমারি? সেই বিদ্যালয়টি কোথায়? সেটিই কি এই প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে? রহস্যের সমাধান হল না। এই এলাকায় কেশবপুর মহেন্দ্র ইনস্টিটিউশন আর মলয়পুর হাইস্কুল আছে। কিন্তু বালিকা বিদ্যালয়? শিক্ষক মহাশয় মলয়পুর তিন নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে বললেন। সেই স্কুল নাকি আগে মেয়েদের স্কুল ছিল। তিন নম্বরে গিয়ে প্রধানশিক্ষককে পেলাম না। তিনি তখন ১ নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশ্ন নিতে এসেছেন। ১ নম্বরের পাশ দিয়েই গিয়েছিলাম। আবার ফিরলাম। দেখা হল প্রধানশিক্ষক দেবাশিস ঘোষের সঙ্গে। তিনি তেমন কিছু জানেন না বললেন। তবে তাঁর এক শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করে জেনে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ইন্দ্র পরের মঙ্গলবার হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল তথ্য জানতে। প্রধানশিক্ষক জানিয়েছেন, গ্রামের প্রবীণদের জিজ্ঞাসা করেছেন। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি।

তা হলে বিদ্যাসাগরের স্কুল কোথায় ছিল? আবার সময় নিয়ে খোঁজ করতে হবে।

কভারের ছবি— বনমালিপুরে বিদ্যাসাগরের মূর্তি

ছবি- দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটে হুগলির বনমালিপুরে

  1. একেবারে নতুন এক তথ্যের সন্ধান। বাকিটুকুর জন্য অপেক্ষা করব।

    1. অনেক ধন্যবাদ দাদা। ওই স্কুলটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করব আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *